আবারো এলো বৈশাখ । এলো নতুন বর্ষ । নববর্ষ উদযাপন বাঙালিদের প্রধান সামাজিক উৎসব। এই বৈশাখী উৎসবকে কেন্দ্র করে কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ মেতে ওঠে নতুন আশায়, নতুন আকাক্সক্ষায়। সব মানুষের মেলামেশার ক্ষেত্রে এই বৈশাখী উৎসবের মতো আর কোনো উৎসব আছে কি না জানি না। সম্ভবত বৈশাখী উৎসব বাঙালি ঐতিহ্যের মূল শেকড় বিধায় সেই শেকড়ের টানে আমরা সবাই ধর্ম-গোত্র-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে পরস্পরকে বুকে টেনে নিই। এটিই বাঙালির সম্প্রীতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অনেক আঁকাবাঁকা পথ, চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে আমরা বাঙালিরা আজকের অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বৈশাখকে আরও ঐতিহ্যমন্ডিত করেছে । লোকজ ধারায় বাঙ্গালির ঘরে ঘরের উৎসব বর্ণিল হয়ে উঠে এই উৎসব কে ঘিরে । বাংলাদেশে নববর্ষ এলে পুরো বাংলা মেতে উঠে আজ উৎসব আমেজে আনন্দের ধারায় । বাঙালি লোকসংস্কৃতির অন্যতম প্রধান উৎসব পহেলা বৈশাখ। চিরায়ত সংস্কৃতির পরিস্ফূট আÍচেতনায় বাঙালির নিজস্ব ধারা ও নানা পার্বণের মধ্য দিয়ে বাঙালিত্বের ঐতিহ্যকে বিশ্লেষণ বা উপস্থাপন করা হয়। এই চেতনাবোধকে সমনি¦ত রেখেই আমাদের ভবিষ্যতের দিকে এগুনো। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিতে বৈশাখী উৎসবের মধ্য দিয়ে উঠে আসে যাত্রা, জারি-সারি, পিঠা-পুলি, বলিখেলা, লাঠি খেলা, কাবাডি, হাডু ডু, গরুর লড়াই, বানর নাচ, সাপুড়ে নৃত্য, ঢোল, ঘুড়ি উৎসব, পুতুল নাচ, নাগর দোলা, লোকায়ত যান- হাতি, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, পালকি, লোক প্রযুক্তি : ঢেকি ইত্যাদি।
বর্ষ বরণের মধ্য দিয়ে নবর্ষের প্রথম দিন গ্রামে ও শহরে বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, ভাল খাবার খাওয়া, নানান পিঠা তৈরি করে আপ্যায়ন করা হয়। ধারণা করা হয় বছরের শুরুটা যদি মঙ্গলময় হয়, তাহলে হয়ত সারা বছরের দিনগুলোও তেমন মঙ্গলময় হবে। শতশত বছর ধরে চলে আসা ‘পহেলা বৈশাখ’ একটি শুভদিন হিসেবে প্রভাব রেখে চলেছে। নববর্ষে আমরা অতীত বছরকে পেছনে ফেলে নতুন বৎসরের আবির্ভাবের মুখোমুখি হয়। যে-বছরের প্রকৃতির বিদায় নিয়ে একদিকে তার সুখ-দুঃখের বহু স্মৃতিমাখা চিত্র বিলীয়মান হয় এবং অন্যদিকে আসে অনিশ্চিত সম্ভাবনা সুনিশ্চিত রূপ। মানুষের মনোরাজ্যের এই অবস্থাটি অনুভব করা যায়, বর্ণনা করা যায় না। পয়লা বৈশাখে এর রূপ অনুষ্ঠানগুলোতেই ধরা পড়ে। প্রকৃতপক্ষে, পৃথিবীর যে-কোন জাতীয় উৎসবের রূপ তার প্রতিপালিত অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যেই প্রকাশ পায়। নাগরিক জীবনেও পহেলা বৈশাখ ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। শহরের মধ্যবিত্তের জীবনে নববর্ষ আনন্দ ও মিলন-চেতনার নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে। বড় বড় শহরেও নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে উৎসবের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। বসে কবিদের আসর, হয় নাচ-গান, আবৃত্তি অনুষ্ঠান, কিংবা খেলাধুলা। বর্ষবরণ ও বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার বাংলা একাডেমী, রমনার বটমূলে ছায়ানট, চট্টগ্রামে ডি.সি. হিল পার্ক, সি.আর.বি দেশের প্রতিটি জেলা ্পজেরা সহ গ্রামের বিভিন্ন স্থানে। যা এখন নতুন ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া কালের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠি দেশের প্রতিটি শহরেই শোভাযাত্রা, নাটক, মেলা এবং খাবার উৎসবের আয়োজন করে যাচ্ছে। যেখানে পান্তা-ইলিশ, নানা প্রকার মিষ্টি এবং পিঠাপুলির আয়োজন এই দিনের প্রধান আকর্ষণ হয়ে ওঠে। নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময় এই দিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই নববর্ষ ,আবহমান বাংলার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। জীবনবোধ , জীবনযাত্রা , প্রকৃতির, বিচিত্রতার নিরীখে বর্ষবরণ আমাদের সংস্কৃতি। সুর সঙ্গীত, মেলা, সৌহার্দ সম্প্রীতি, হৃদ্যতার মেলবন্ধনে ভাস্বর প্রতীক পয়লা বৈশাখ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় হাজার বছরের লালিত সংস্কৃতির ঐতিহ্যের সক্রিয় ধারা, প্রেরণা দেয় সুস্থ সংস্কৃতি চর্চাকে। পূণ্যতোয়া নদী তিতাসে তীরের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সংস্কৃতি চর্চার এক পূণ্য ভূমি। এই বর্ষ বরণে এ জেলার রয়েছে গৌরবোজ্বল ঐতিহ্য। বছর ঘুরে যখনই এই মাহেন্দ্রক্ষণ আসে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা সৃস্টি হয় তিতাস পাড়ের মানুষের মাঝে। প্রতিবছরের ন্যায় এবার ও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না বর্ষবরণের ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। আমি বেড়ে উঠেছি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের তিতাস নদীর পাড়ের কালাইশ্রীপাড়ায়। হিন্দু মুসলিম অনেক পরিবারের বাস এখানে। সৌহার্দ সম্প্রীতির মেল বন্ধন রয়েছে এ পাড়ায়। ছোটবেলায় দেখেছি এখানে বাংলা বর্ষবরণ নিয়ে ব্যাপক আয়োজন। ঘরে ঘরে উৎসব আমেজ । দোকানে দোকানে হাল খাতার উৎসব। পুরনোকে ধূয়ে মুছে নতুন শুভ কিছুর জন্য ব্যাপক আকুলতা। বছরের শুরুর দিনটিতে ফুলে ফুলে ঘর সাজানো ঘর, নতুন পোষাক, সুন্দর ব্যবহার, মিস্টি, সন্দেস ভাল খাবারের সমাহার ছিল অন্যন্য বৈশিষ্ট্য। ১৯৮৩-১৯৮৪ সালের দিকে কালাইশ্রীপাড়ায় একটি সংগঠন করি। কচি কল্লোল নামক সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলাম। আমার খেলার সাথী লিটন দেব, জাকির হোসেন, জয়জিৎ, মোফাজ্জল খান, মহিতোষ, মিঠু, নিত্যানন্দ, জগদীশসহ কজন মিলেই সিদ্ধান্ত নেই বর্ষবরণ অনুষ্ঠান করবো। কালইশ্রীপাড়ার বিমলদা, পরিমল দা, শান্তি দা, টেনটো ভাই, স্বপন ভাই , প্রণজিৎ দা, রতন ভাই তাদের সহায়তায় অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেয়া হয়। আমাদের পাড়ায় তখন শিল্পী বলতে চিনতাম পুতুল দি কে যিনি আজ বেঁচে নেই। পুতুল দিদি, গায়ত্রী দিদি, রেবা দি তাদের পরিচালনায় ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে আমরা অনুষ্ঠান গুলো সাজাতাম। মাস ব্যাপী পুতুল দি নতুবা গায়ত্রী দির বাসায় চলতো মহড়া। আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রয়াত একে এম হারুন রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব মনজুরুল আলম, কবি জয়দুল হোসেন আমাকে তখন উৎসাহ দেন। অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসে আমাদের অনুষ্ঠানকে স্বার্থক করেন । কয়েক বছরই আমরা এ অনুষ্ঠান করেছি। সেই স্মৃতি গুলো বড় মিস্টি মধুর । পরে জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিজেকে ব্যস্ত করায় কালইশ্রীপাড়ার অনুষ্ঠানটির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি । জেলা পর্যায়ের অনুষ্ঠান গুলোর সাজ সজ্জার দায়িত্ব টা পেয়েছি খুব অল্প বয়স থেকেই। শোভাযাত্রা- মঞ্চ সাজানো ,অভিনয় উপস্থাপনা এসব কিছুর কাজই ছিল আমার। খুব ব্যস্ততা থাকতো এই অনুষ্ঠান আসলেই। বাহারী পোষাকে শহর ঘুরে বেড়ানো, সুর সঙ্গীত, নেচে গেয়ে বর্ষবরণ করেছি আমরা সংস্কৃতি কর্মীরা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে।
বর্ষবরণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গতিশীল সংগঠন সাহিত্য একাডেমী অন্যন্য দৃস্টান্ত স্থাপন করে আসছে। সাহিত্য একাডেমীর সপ্তাহব্যাপী বৈশাখী উৎসব জেলার এক অন্যন্য ঐতিহ্য। এ উৎসবের প্রথম অনুষ্ঠান গুলোতে অংশ নিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে বৈশাখী মেলা হয়েছে কিন্তু ধারাবহিকতা রক্ষা হয়নি। ব্রাহ্মণবড়িয়ায় বড় আয়োজনে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় একবার স্থানীয় ফারুকী পার্কে । কালবৈশাখী ঝড়ের কি যে তান্ডব তা দেখেছি এ মেলায়।
বেশী দিনের কথা নয় ফারুকী পার্কের বয়সী আম গাছটিকে সাজিয়ে বৈশাখী মেলার উদ্যোগ নেন সংস্কৃতি লালনের অন্যন্য ব্যক্তিত্ব বাবু বনমালী ভৌমিক। তিনি তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা হাকিম। আমি সহ চারুকলার ৬ ছাত্র, এখন মাছরাঙ্গা হিসেবে পরিচিত জনি মল্লিক আমাদের উপর দায়িত্ব পড়ে সাজ সজ্জার । আমরা গাছটিকে সাজিয়ে এর আশপাশকে রঙ্গে রাঙ্গিয়ে ফেলি কিছুটা ব্যতিক্রমী ভাবেই । গাছের নীচে বড় মঞ্চ। ফারুকী পার্কের বড় পরিসরের স্থানটিকে কেন্দ্র করে মেলাসহ সকল কিছুর একত্রিকরণে দুদিন ব্যাপী অনুষ্ঠান মালার আয়োজন হয়। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা , দই চিড়া মাঠা মিষ্টি, বাউলদের ভির , সাহিত্য সংস্কৃতি সেবীদের আড্ডা, শিশু-কিশোরদের কল কাকলী, নাগর দোলা, অনেক কিছুই এই আয়োজনকে প্রান্তবন্ত করে তোলে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বৈশাখী মেলার নতুন মাত্রার যোগ হয়। প্রাণ চাটনীর সৌজন্যে স্থানীয় নিয়াজ মুহম্মদ স্টেডিয়ামে বড় আয়োজনে বৈশাখী সংগীত উৎসবের আযোজন করে গুণীজন সংবর্ধনা পরিষদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এ সংগঠটি প্রতিবছর গুণীজনদের সংবর্ধনা প্রদানের ধারাবাহিকতা রেখে অন্যন্য সংগঠন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সংবর্ধনার পাশাপাশি বৈশাখী সংগীতনুষ্ঠান নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে। সংগঠনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বিশিস্ট চিকিৎসক সংস্কৃতিসেবী ডাঃ আশীষ চক্রবর্তীর ঐকান্তিকতায় সংস্কৃতিচর্চায় নতুন মাত্রার যোগ হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় কলেজ মাঠে বৈশাখী উৎসব হয়েছে গ্রামীণ ফোনের সৌজন্যে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এবারও ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে বর্ষবরণে। সাহিত্য একাডেমীর সপ্তাহব্যাপী আয়োজন হচ্ছে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে । ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন ১ লা বৈশাখ দিনব্যাপী কর্মসূচী নিয়েছে। জেলা প্রশাসক মোঃ আবদুল মান্নান এ দিবসটি আনন্দঘন পরিবেশে পালনের আহবান জানিয়েছেন ।
এবার অনুষ্ঠানমালায় নতুনত্ব এসেছে। ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতার আয়েজন হচ্ছে বিকেল ৪ টায় নিয়াজ মুহম্মদ স্টেডিয়ামে । শোভাযাত্র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তো আছেই। সব মিলিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বর্ষবরণ হবে হবে উৎসবমুখর এ প্রত্যাশা করি। সম্প্রীতির অনন্য মেলবন্ধন হউক এক অপরের বছর শুরুর এই দিনটি ।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সভাপতি , ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব। সম্পাদক নতুন মাত্রা।
Discussion about this post