জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান,
মাতা, ভগ্নি ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহিয়ান।
কাজী নজারুল ইসলামের চরণদু’টিই প্রমাণ করে জগতের প্রত্যেকটি সাফল্য, কিংবা বিজয়, কিংবা সৃষ্টির পেছনে নারীর অবদান কোনো না কোনো ভাবে আছে। নারী মমতাময়ী আশ্রয়ে শিশুকে বড় করেছে, পুরুষের পাশে থেকে প্রেরণা যুগিয়েছে, ভ্রাতৃবন্ধনে সহোদরকে এগিয়ে যেতে পাথেয় যুগিয়েছে। নারীর সাহসে পুরুষ আকাশ জয় করেছে, হিমালয়ে উঠেছে, সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে। তবে নারীরা যে শুধু পুরুষকে প্রেরণা, ভালোবাসা, আনন্দ দিয়েছে তেমনটি নয়, সেই সাথে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন সময়ে নারী পালন করেছে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা। উপমহাদেশের নারী নেত্রী ইলা মিত্র দেখিয়েছেন কীভাবে পরাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার দেখিয়েছেন কীভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম দেখিয়েছেন কীভাবে রাজাকারদের বিচার করতে হয়। বর্তমানেও এমন অনেক নারী রয়েছেন যারা দেশ ছাড়িয়ে প্রবাসেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রাখছেন। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই প্রবাসী অনেক বাঙালি নারীও। তাদেরই একজন ইয়াসমীন শাহাদাত। যিনি ভিনদেশে বাঙালি সংস্কৃতি তুলে ধরতে প্রতিষ্ঠা করেছেন “অনন্যা” নামের অরাজনৈতিক মহিলা সামাজিক সংগঠন। যেটাকে বলা হয় মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী বাঙালি মহিলাদের একমাত্র অলাভজনক সামাজিক সংগঠন। সম্প্রতি ইয়াসমিন শাহাদাত ওমান থেকে দেশে এসেছেন। দেশে নানা ব্যস্ততার ফাঁকে এরই মাঝে ঘুরে গেলেন প্রবাস মেলা কার্যালয়ে। কথা বলেছেন ভিনদেশে বাঙালি সংস্কৃতি তুলে ধরার অভিজ্ঞতার কাহিনী। এক ছেলে এক মেয়ের জনক ইয়াসমিন শাহাদাত ১৯৭১ সালে ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বেড়ে ওঠা আর পড়াশুনা শুরু হয় ঢাকায়। ১৯৮৭ সালে রামপুরা একরামুন্নেসা গালর্স স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। একই বছরে ওমান প্রবাসী শাহাদাত হোসেনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন যিনি ১৯৮১ সাল থেকেই ওমানে আছেন। সিদ্বেশরী কলেজ থেকে ডিগ্রি ও মাস্টার্স করলেও বিয়ের পর তিনি ওমান আর বাংলাদেশ দুই দেশেই থেকেছেন সমানভাবে। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি ওমানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ইয়াসমিন শাহাদাত নিজেকে গৃহিণী পরিচয় দিতেই গর্ববোধ করেন। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের কার্যক্রমের সাথে জড়িত। ২৩ বছর বয়সী মেয়ে শা্হরীন ইলহাম আন্নিসা জার্মান ইউনিভার্সিটির আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের লেকচারার হিসেবে কর্মরত আছেন। ছেলে শাহরিয়ার আরিজ প্রান্ত মাস্কাট ক্যালোডোনিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছে। তিনি বলেন, আমি নিজেকে নিয়ে খুব গর্ববোধ করি এজন্য যে, আমার নিজের সন্তানকে নিজ হাতে গড়ে তুলেছি। লোকজন যখন জানেন যে, আমার মেয়ে জার্মানীর একটি ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন, তখন আমার আনন্দের শেষ থাকেনা। যদিও জীবনের এ পযার্য়ে আসতে অনেকের মত আমারও অনেক ত্যাগ, পরিশ্রম করতে হয়েছে। কিন্তু আজকের এ অবস্থানে এসে আমি তাদের নিয়ে খুবই গর্বিত। এ নিয়ে আমার নিজের কাছে যখন প্রশ্ন করি পারলামতো? তখন দেখি যে না বোধহয় আমি পারলাম। তিনি বলেন, একটা সময় পরিবারে ছেলেমেয়েদের নিয়ে গৃহিণী হিসেবে খুবই ব্যস্ত থাকতাম। তারপরও আমি সময় নিয়ে সামাজিক কার্যক্রমে অংশ নিতাম। যখন আমার ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই পরিবারেও আমার ব্যস্ততা কমে গেলো। তখনই আমার মাথায় চিন্তা আসলো প্রবাসে থাকলেও দেশের জন্য কিছু করা উচিৎ। একা একা তো আর সব করা যায়না! এজন্য আমি মাস্কাটে বসবাসরত আরো বাঙালি মহিলাদের সাথে কথা বলে আমার ধারণা গুলো শেয়ার করি। ইয়াসমিন শাহাদাত বলেন, মাস্কাটে আমার মত আরো অনেকেই আছে যারা সাপ্তাহিক ছুটির দিন সহ অনেক সময় আমরা পার্কে গিয়ে গল্প করতাম। তখন আমি ভাবতাম এই মানুষগুলো নিয়ে একটা জায়গায় যাবো। যদিও শুরুর দিকে কাজগুলো তত সহজ ছিলোনা। আমার এই পথচলার পিছনে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিতে চাই তনুশ্রী দে কে, যিনি ওমানের একটি স্কুলের শিক্ষক। খুবই প্রতিভাবান এবং পরোপকারী। তিনি একটি শিশু সংগঠনের স্বত্তাধিকারী। তার কাছ থেকে আমি পরামর্শ নিয়ে একটি নির্দিষ্ট দিনে মাস্কাটের একটি পার্কে আমরা বসবো বলে অনেক বাঙালি মহিলাকে দাওয়াত করলাম। কিন্তু সেদিন সিম্পল কিছু গৃহিণী ছাড়া তেমন কেউই আসলোনা। সেদিন সবাই আমার প্রস্তাব শুনে বললেন, আপনি কাজ শুরু করেন, আমরা আপনার সাথে আছি। সিদ্ধান্ত অনুসারে এটা হবে মহিলাদের নিয়ে একটি অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২০১০ সালের ১ বৈশাখ যাত্রা শুরু করে ওমান ভিত্তিক প্রবাসী মহিলাদের একমাত্র অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন “অনন্যা”। উদ্ভোধন করা হয় বাংলাদেশ দূতাবাসের তৎকালীন রাষ্ট্রদূতের স্ত্রীর মাধ্যমে।
“অনন্যা” কি ধরনের কার্যক্রম করে থাকে এমন পশ্নের জবাবে ইয়াসমিন শাহাদাত বলেন, বিদেশে দেশের সংস্কৃতি তুলে ধরতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সাধারণত ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, ২১ ফেব্রুয়ারি, ঈদ পুনর্:মিলনী, বাংলা নববর্ষ, নবান্ন উৎসবসহ আরো অনেক দিবস উপলক্ষে আমরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকি। বিশেষ করে নবান্ন উৎসবে পুরো মাস্কাট শহরে আলোড়ন সৃষ্টি করে। কারণ, এসব উৎসবগুলো বাঙালি জাতির অহংকার। নতুন প্রজন্ম এগুলো ভুলে যাচ্ছে। অনুষ্ঠান গুলোতে আমরা নিজেদের মধ্য থেকেই দেশের গান, কবিতা আবৃত্তি, নৃত্য, কৌতুক প্রভৃতির মাধ্যমে দেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার একটা প্রয়াস থাকে। পুরো অনুষ্ঠান উপভোগ করলে সবারই মনে হয় এ যেন এক টুকরো বংলাদেশ। যেখানে অনেক বিদেশিরাও আমাদের অনুষ্ঠান উপভোগ করতে হাজির হয়ে থাকেন। তিনি বলেন, সাধারণত আমাদের প্রত্যেকেরই নানা পরিচয় থাকে। কিন্তু অমরা যখন “অনন্যা”তে আসি, আমাদের সবার একটাই পরিচয়, আমরা সবাই “অনন্যা”র কর্মী। আমরা এই পরিচয় দিতেই গর্ববোধ করি। যদিও আমি এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, কিন্তু সবাই এখানে সমান। সবার মতামত নিয়েই বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। এ সংগঠনের প্রায় ৩৫ জন সদস্য রয়েছে। নির্বাহী সদস্য হিসেবে ইয়াসমিন শাহাদাত, তনুশ্রী দে, জেবু জামান, লাকী সাঈদ, রুনা, উম্মে হাবীবা, মনি রহীম, রিমা আনোয়ারসহ অরো অনেকেই কাজ করছেন। ওমানে প্রায় ৬ থেকে সাড়ে ৬ লাখ বাংলাদেশি আছেন জানিয়ে ইয়াসমিন শাহাদাত বলেন, তাদের অনেকেই পরিবার নিয়ে সেখানে থাকেন। তাই সেখানকার নতুন প্রজন্মসহ বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের কৃষ্টি-কালচার তুলে ধরতে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে “অনন্যা”। বর্তমানে “অনন্যা” এখন ওমান ছাড়িয়ে বিশ্বের অনেক দেশে পরিচিত হয়ে ওঠছে। এ প্রসঙ্গে ইয়াসমিন শাহাদাত বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে থেকে আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে আমাদের সংগঠন সম্পর্কে জানতে চায়। তখন আমরা আমাদের দেশকেই রিপ্রেজেন্ট করি। এতে করে বর্হিবিশ্বে আমাদের দেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয় বলেই আমরা মনে করি। “অনন্যা” ওমান ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে নতুন করে পরিচিত করে তুলুক এমনটিই প্রত্যাশা সকলের।
Discussion about this post