ইমতিয়াজ আহমেদ জিতু- রসমালাই-নাম শুনলেই জিভে জল আসে। সুস্বাদু এই মিষ্টান্নের খ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও। রসমালাইয়ের নাম বলতেই সবার আগে মনে হয় কুমিল্লার নাম। কারণ দেশের বিভিন্ন স্থানে রসমালাই তৈরি হলেও কুমিল্লার রসমালাইয়ের স্বাদের তুলনা নেই।
স্বাধীনতা পূর্ব সময় থেকেই কুমিল্লার রসমলাই, দই, মিষ্টির সুনাম বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে গত ৩০ বছর ধরে কুমিল্লার রসমলাইয়ের চাহিদা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ পর্যন্ত গড়িয়েছে।
যেখানে পাবেন উৎকৃষ্ট রসমলাই:
কুমিল্লা কান্দিরপাড় মনোহরপুরে অবস্থিত মাতৃভান্ডার, ভগবতী, কান্দিরপাড়ের জলযোগ, জেনিস, পোড়াবাড়ি, পুলিশ লাইনের পিয়াসা, ঝাউতলার অমৃত সুইটস, পিয়াসার মিষ্টি দোকানগুলোতে রসমলাই, অন্যান্য মিষ্টি ও দধি পাওয়া যায়। তবে উৎকৃষ্ট ও সুস্বাদু রসমলাই পেতে হলে আসতে হবে মনোহরপুরে অবস্থিত মাতৃভান্ডার, ভগবতী দোকান।
কুমিল্লার রসমলাইয়ের দোকানের মধ্যে মাতৃভান্ডারের রয়েছে বাড়তি নাম। কুমিল্লার মনোহরপুরের আনাচে কানাচে রসমালাইয়ের এসব দোকানগুলোতে নেই কোন চাকচিক্য। বেশিরভাগ দোকানে বসার ব্যবস্থাও নেই। তবে ২/১ টি দোকানে বসে খাওয়ার জন্য আছে ৫/৬ টি আসন।
বাইরের চাকচিক্যের চেয়ে স্বাদ এবং মানই এসব দোকানিদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বাংলানিউজকে তারা জানান, দোকানগুলো আধুনিকায়ন করার কোন প্রয়োজন অনুভব করিনা, দেশের সব জায়গায় আমাদের দোকানের নাম, সুনাম ছড়িয়ে আছে। এখন যেভাবে আছে তা তো খারাপ না।
যে পরিমাণ রসমালাই তৈরি হয় কুমিল্লায়:
কুমিল্লার রসমলাইয়ের দোকানগুলোর মধ্যে মাতৃভান্ডারেই প্রতিদিন গড়ে ৫/৬ মণ রসমলাই তৈরি করা হয়। এই দোকানে প্রতিদিন ভোরে ও বিকেলে ৫-৬ জন দুধ ব্যবসায়ি প্রায় ১০-১৫ মণ দুধ সরবরাহ করে থাকে। এদের প্রত্যেকে ৮০-১০০ কেজির উর্ধ্বে দুধ সরবরাহ করে থাকেন।
মাতৃভান্ডারে দুধ দেয় শহরের কাশারীপট্রির দুধ ব্যবসায়ী ফয়সাল। সে জানায়, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার অন্যদিনের তুলনায় ২০-৩০ কেজি দুধ বেশি দিতে হয়। এর কারণ এই দুই দিন অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি রসমলাই তৈরি করা হয়।
প্রতিদিন লাখ টাকার কেনাবেচা:
প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় মনোহরপুরে অবস্থিত মাতৃভান্ডার, ভগবতী, কান্দিরপাড়ের জলযোগ, জেনিস, পোড়াবাড়িতে দিন মজুর থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ভিড় জমায় রসমলাই কেনার জন্য। ক্রেতাদের মধ্যে এক প্রকার প্রতিযোগিতা দেখা যায় গরম রসমলাই কার আগে কে কিনবে। ক্রেতাদের ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় দোকানের কর্মচারীদের। কেউ বাড়ির ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীর জন্য, কেউবা মেহমানদের আপ্যায়ন করার জন্য, কেউবা আত্মীয়স্বজনদের জন্য, নতুন সর্ম্পক হচ্ছে এমন বাড়িতে নেয়ার জন্য এবং কেউবা অফিসের বসদের উপহার দেয়ার জন্য নিয়ে যান এই রসমালাই।
ভিড় জমান বিদেশিরা: ২০০৭ সালের ১১ই নভেম্বর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত গীতা পার্সি বাংলাদেশ সফরে আসলে তার দুই সহযোগি কুমিল্লার মাতৃভান্ডারে এসে রসমলাই খেয়ে যাওয়ার সময় গীতা পার্সির ইচ্ছাতেই তার জন্য ২ কেজি রসমলাই ও দেড় কেজি ক্ষীর কিনে নিয়ে যান।
বাংলাদেশে ঘুরতে আসা বিদেশি পর্যটকরাও বেড়াতে এসে কিনে নিয়ে যান কুমিল্লার রসমলাই ।
দরদাম: মাতৃভান্ডারে ১ কেজি রসমলাইয়ের দাম ১৭০ টাকা আর ১ প্লেট রসমলাইয়ের দাম ৩০ টাকা। অন্যান্য দোকানেও প্রায় একই দাম। রসমালাই বিক্রেতারা জানায়, শুধু মাতৃভান্ডারেই প্রতিদিন বিক্রি হয় প্রায় লাখ টাকার রসমলাই। তবে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার বিক্রির পরিমান বেড়ে দাঁড়ায় দেড় লাখে। বিক্রির দিক থেকে মাতৃভান্ডারের পরই ভগবতী মিষ্টি দোকান। এই দোকানেও প্রতিদিন ৭০-৮০ হাজার টাকার রসমলাই বিক্রি হয় ।
বিদেশে যাচ্ছে কুমিল্লার রসমলাইঃ
কুমিল্লার একাধিক সীমান্ত পথে অবৈধ ভাবে প্রতিদিন ২০/৩০ কেজি রসমলাই ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় বলে বিক্রেতারা জানিয়েছেন। তারা জানায়, হিন্দুদের বড় পূজাগুলোতে বর্ডার কিছুটা উন্মুক্ত হয়ে যায়। এই সুযোগে এসময় প্রতিদিন ৫/৬ মণ রসমলাই অবৈধ পথে ভারতে পাচার হয়। অবৈধ পথে যাওয়ার ফলে সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।।
অপরদিকে, ব্যাঙের ছাতার মতই যত্রতত্র গড়ে উঠছে নকল মাতৃভান্ডারসহ অন্য প্রসিদ্ধ রসমালাই প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের শো-রুম। এতে প্রতারিত হচ্ছে ক্রেতারা।
কুমিল্লা জেলার রেল ষ্টেশন, গুরুত্বর্পূণ বাস স্ট্যান্ড, আলেখারচর বিশ্বরোড, ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, হাইওয়ে রোডের বড় বড় হোটেলগুলোসহ ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার ৯৭ কিঃমিঃ রাস্তার আশেপাশে গড়ে উঠছে এসব নকল শো-রুম।
ঢাকা থেকে চট্রগ্রাম,কক্সবাজার, সিলেট, বি-বাড়িয়া প্রভৃতি জেলায় ভ্রমণকারি লোকজন যাত্রাপথে গাড়ি থামার পর রসমলাই কিনে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে তারা প্রতারিত হচ্ছেন, আসল রসমলাইয়ের স্বাদ গ্রহণ থেকে। স্বাদের ভিন্নতা ছাড়াও তুলনামূলক ভাবে দামও বেশি রাখা হয়। আসল রসমলাই পেতে হলে মনোহরপুর, কান্দিরপাড় এর দোকান থেকে রসমলাই কিনতে হবে, তাহলেই প্রকৃত স্বাদ থেকে কেউ আর বঞ্চিত হবেনা।
আপনাদের জন্য মনোহরপুরের সুস্বাদু রসমালাই তৈরির প্রস্তুত প্রণালী
উপকরণ:
তাদের দেয়া রেসিপি অনুযায়ি, প্রতি কেজি রসমালাই তৈরির জন্য ২ কেজি দুধ, চিনি ২ কাপ, কনডেন্স মিল্কের এক কৌটার অর্ধেক, কর্নফ্লাওয়ার ১ চা চামচ, ২ চা চামচ গোলাপজল, এলাচ গুঁড়া আধা চা চামচ, রসগোল্লা বা চমচম বা যে কোন ধরনের মিষ্টি আধা কেজি (বাজার থেকে কেনা)।
প্রস্তুত প্রণালী:
রসগোল্লার রসমলাই খেতে বেশি স্বাদ। তবে চমচম হলেও বানানো যাবে। প্রথমেই মিষ্টিগুলো ছুড়ি দিয়ে কেটে ছোট ছোট পিস করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন ভেঙ্গে গুড়ো না হয়ে যায়। একটা বড় রসগোল্লা বা চমচম ৮/১০ টুকরো করতে হবে । ২ কেজি দুধ ভাল করে জাল দিয়ে প্রায় ১ কেজি পরিমাণ করে নিতে হবে। এবার এলাচ গুঁড়া , কনডেন্স মিল্ক ভাল করে মিলিয়ে নেড়ে দিতে হবে। চিনি মিলিয়ে নিতে হবে। কর্ণফ্লাওয়ার ভিন্ন পাত্রে গুলে নিন। এবার আস্তে আস্তে দুধে ঢেলে নাড়তে থাকুন ঘন না হওয়া পর্যন্ত। খেয়াল রাখুন দলা না পাকিয়ে ভালভাবে যেন মিশে যায়। এবার কেটে রাখা মিষ্টির পিসগুলো ভালভাবে মিশিয়ে কিছুক্ষণ পর নামিয়ে বলে ঢেলে দিন। কর্নফ্লাওয়ার দুধে মেলানোর কারণে মিষ্টির টুকরোগুলো ভাঙ্গবে না, রসমলাই ঘন হবে। মনে রাখবেন, রসমলাই তৈরি করতে দুধের পরিমাণ যেন কম না হয়। আর পাতলা দুধে ও উপকরণ শাবেন না। দুধ জাল দিয়ে ঘন করে নিয়ম অনুযায়ী উপকরণ গুলো মেলাবেন। এতে রসমলাই সুন্দর, সুস্বাদু এবং সুঘ্রাণযুক্ত হবে।
Discussion about this post