চট্টগ্রামে খসড়া জ্বালানি রূপান্তর নীতির উপর ক্যাবের মতবিনিময় সভায় বক্তারানীতি প্রণয়নের মাধ্যমে জ্বালানিতে নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ‘সুষ্ঠ জ্বালানি নীতির মাধ্যমে জ্বালানি খাতে নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপান্তরে জ্বালানির অধিকার মৌলিক অধিকারের রূপ পেয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রত্যেক নাগরিকের জ্বালানির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য একটি পরিছন্ন সুষ্ঠ নীতিমালার বিকল্প নেই।’ কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) প্রণীত খসড়া জ্বালানি নীতির ওপর নাগরিক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এমন মন্তব্য করেন। শনিবার (৪ ডিসেম্বর) ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চিটাগাং (ইউএসটিসি) ডি-ব্লকে উক্ত নাগরিক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ক্যাব কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন।
মতবিনিময় সভায় রিসোর্স পার্সন হিসাবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্ঠা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, জনগনের পক্ষে জ্বালানি নীতিমালা দাবি হিসাবে আমরা প্রস্তাবনা করছি। এনার্জি ট্রানজেকশনে পরিবেশ সুরক্ষা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে। স্বাধীন দেশে জ্বালানি সম্পদ রক্ষার জন্য সংগ্রাম বিরল। আমরা সেই সম্পদ রক্ষা করতে পারিনি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কমলেও দেশীয় বাজারে দাম কমে নাই। বাড়লে সংগে সংগে দাম বেড়ে যায়। ন্যার্য দামের চেয়ে জ্বালানির বেশি দাম নেয়া হচ্ছে। সরকারকে বিদ্যুতে ১৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। আমরা সেটা থেকে বের হতে পারিনি। তিনি আরও বলেন, ভোক্তা স্বার্থ রক্ষার সময় সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলি নিস্ক্রয় হয়ে থাকে। মন্ত্রণালয়ে যে লোকগুলোকে রাখা হয়েছে তারা যদি ব্যবসার অংশ হয়, তাহলেই সমস্যা। এ সুযোগে বেসরকারী খাত সুযোগ খুঁজবে। এই জ¦ালানী সেক্টর পরিচালনায় সরকারের দর্শন পরিস্কার হওয়া উচিত। জ্বালানি অধিকার সুরক্ষা হলে সব ব্যয় কমে যাবে। জাতীয় আয় বেড়ে যাবে। সামনে জ্বালানি এভাবে দাম বাড়লে আমরা লক্ষ্য থেকে ছিটাকে পড়বো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খান বলেন, জ্বালানি সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা। এই সমস্যার কারণে আজ আমাদের অধিকার লুণ্ঠনের স্বীকার। জ্বালানি ব্যবহারে অধিকার উদ্বুত অধিকার। মৌলিক অধিকারের বিবেচনায় জ্বালানি উপর অধিকার জন্মায়। এই অধিকার সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সরকারের দায়িত্ব। তিনি আরও বলেন, এলএনজি, সিএনজি খাতে বিশাল বিশাল কোম্পানি গড়ে উঠেছে। সেখানে ভোক্তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারিনি। ভোক্তাদের প্রণীত রাষ্ট্র যে দায়িত্ব সেটার নিশ্চিত করে অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। জ্বালানি নীতির মাধ্যমে ভোক্তাদের অধিকার নিশ্চিতের সময় এসেছে।
ইউএসটিসির ভিসি প্রফেসর ডঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নেপালে বাড়ীর ছাদে সোলার প্যানেল বসিয়ে সেখান থেকে ন্যাশনাল গ্রিডে দিচ্ছে। এটার দাম আমরা জানি। প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ কত টাকা খরচ পড়ছে সেটা আমরা জানি। কিন্তু নিউক্লিয়ার, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আমাদের অন্ধকারে রেখেছে। কত কিলোওয়াট কত টাকায় সেটা আমরা জানি না। নেপালে শতভাগ সোলারে চলে গেছে। জামার্নীতে সব পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ করে একটা সময়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে চলে যাবে।
তিনি আরও বলেন, আমার জ্বালানি আমি উৎপাদন করবো, সে অধিকার আমাকে দিতে হবে। শহরের লোকেরা যে বিদ্যুৎ, গ্রামের লোকেরাও সে সুবিধা যেন পায়। বিদ্যুতের অপচয়ের দায় কে নিবে? সেটাও দেখতে হবে। দেশ ডিজিটাল হচ্ছে, বিদ্যুৎ শক্তি থাকবে। রিনিওয়েবল এনার্জি একমাত্র বাংলাদেশে সম্ভব।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন অধ্যাপক হোসেন কবীর বলেন, ভোক্তার অধিকার, জনগনের সম্পদ লুন্টনের কথা আমরা বলছি। এলএনজি, সিএনজি গ্যাসের কথা বলা হচ্ছে। আধুনিক এই সময়ে জ্বালানি অত্যাবর্শকীয় হয়ে উঠেছে। এটা সরকারের আওতায় থাকতে হবে। রাষ্ট্রের ভোক্তার অধিকার সেটা রাষ্টই ভূলুণ্ঠন করছে। ভোক্তারা যে অধিকার নিশ্চিত করার কথা তারা সেটা ব্যর্থ ঘটাচ্ছে। রাষ্ট্রের বাহিনী আমাদের সুরক্ষা দিবে, আজকে তারা ব্যবসা করছে। সবাই ব্যবসা করলে ইকোসিস্টেমের কি হবে?
তিনি বলেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব আমার অধিকার সুরক্ষা দেয়ার, সে কাজ করছে না। যারা দায়িত্বে তারা নিজেরা ব্যবসা করছে। জনগণকে কথা বলতে দিতে হবে। জ্বালানী অত্যাবর্শকীয় এটা নিশ্চিত করতে হবে।
চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন সাবেক সভাপতি এম নাসিরুল হক বলেন, আমাদের উর্বর মাটি, সুর্যের আলো আছে। এখানে বীজ বুনে দিলেই ফসল হয়। আমাদের ছেলে মেয়েরা অনেক উদ্যমী। আমাদের মধ্যে ঐক্যমত আছে। স্বাধীনতার সময় কাউকে ডাকতে হয়নি। একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে কাজ হয়োছে।
তিনি বলেন, ব্যক্তি মালিকানায় বিদ্যুৎ খাতে থাকতে পারে না। ৫০ পয়সায় কাপ্তাই থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলে ১৮ টাকায় কেন ব্যক্তি পর্যায় থেকে বিদ্যুৎ কিনছে। ব্যক্তিরা পারলে সরকার পারে না কেন? দুর্নীতি কমানো দরকার। জাতীয় সুপারিশ ব্যতিত জ্বালানির দাম না বাড়ানো দরকার।
সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের রসায়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক পরিবেশবিদ ডঃ ইদ্রিস আলী বলেন, বাহাত্তর সালে খাদ্য, আবাসন সহ অনেক সংকট ছিল। সেটা থেকে বেরিয়ে এসেছি আমরা। দেশ শেষ হয়ে যায়নি। অনেক সুচকে পৃথিবীতে আমরা এক নম্বরে আছি। সুশাসন ও গণতন্ত্রের ঘাটতি আছে। গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকলে অনেক সমস্যা হয়। এখনো আশাহত হওয়ার কিছু নেই। জাতীয় আয় বাড়ছে, আমরা এগিয়ে যাব সে চেতনা আছে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, জ্বালানির ব্যাপারে সুষ্ঠ-সুন্দর নীতিমালা এখনো হয়নি। এখাতে ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে বলে যে অভিযোগ সেটা ঠিক নয়। এলপিজির ক্ষেত্রে আমরা দেখি ৫৪টি কোম্পানির মধ্যে মাত্র ৪/৫টি কোম্পানি ব্যবসা করছে। বাকিরা দেওলিয়ার পথে। এখনো এটা নিয়ে কোন নীতিমালা হয়নি। বাস্তব সম্মত প্রস্তাবনা নিয়ে জ্বালানি অধিকার নিশ্চিতে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
ক্যাব চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারন সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরীর সুচনা বক্তব্যে উন্মুক্ত আলোচনায় অংশনেন প্রাণ-প্রকৃতি মঞ্চের শমসের আলী, ন্যাপের সাংগঠনিক সম্পাদক মিথুল দাশ গুপ্ত, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এস এম সোহরাব উদ্দীন, প্রিমিয়ার বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সঞ্জয় বিশ্বাস, গণসংহতি আন্দোলনের হাসান মারুফ রুমি, প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ চৌধুরী, ইউএসটিসির ডীন প্রফেসর দেব প্রসাদ পাল, প্রকৌশলী সনাতন চৌধুরী, উন্নয়ন কর্মী ওবায়দুর রহমান, ক্যাব দক্ষিন জেলা সভাপতি আবদুল মান্নান, ক্যাব যুব গ্রুপের সভাপতি চৌধুরী কেএনএম রিয়াদসহ বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর প্রতিনিধিরা অংশনেন। তারা বলেন, কোথায় কোন জিনিস হওয়া দরকার সেটা ঠিক করতে হবে। এখনো পিপিপি এর কোন নীতিমালা হয়নি। এরপরও সরকার ব্যক্তি মালিকানার বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। এ খাত থেকে বিদেশি সংস্থা কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। ঘুণিঝড়, ভূমিকম্প, বন্যা এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে জ্বালানি ব্যবস্থা কি হবে সেটা নিশ্চিত হওয়া উচিত। প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে এনভারেনমেন্টাল এনালাইসিস নিশ্চিত করতে হবে।
মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে এস এম নাজের হোসাইন বলেন, জ্বালানি নীতি এবং নাগরিক অধিকার দরকার সবাই সেটাতে একমত। জ্বালানি নীতি বাস্তবায়নের দাবিতে ঢাকার পর চট্টগ্রামে প্রথম আন্দোলনের সুচনা হলো। এই নীতিমালা কার্যকর করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে হতাশা থাকবে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ অনেক ক্ষেত্রে প্রভুত উন্নয়ন হয়েছে। মৌলিক অধিকারের মধ্যে জ্বালানি জড়িত। রাষ্ট্রিয়ভাবে নীতি না থাকলে অধিকার লঙ্গিত হবে। নাগরিকরা চুপ থাকলে ব্যবসায়ীরা দখলে নিবে। নাগরিকদের কথা বলতে হবে। সত্যিকার অর্থে জ্বালানিতে জনগনের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
Discussion about this post