“বীর চট্টলার সংগ্রামী সাথীরা—” মাইকযোগে জনসভার নিমন্ত্রণে এভাবেই সম্বোধিত হয় চাটগাঁইয়্যা জনগন তথা চট্টগ্রামের অধিবাসী। ধর্মসভায় আহ্বানের ক্ষেত্রেও সম্বোধন সেই একই, উপলক্ষ্য অনুসারে সামান্য পার্থক্যটা আহ্বায়ক নিজেই করে নেন- সংগ্রামীর বদলে ‘তৌহিদী জনতা’। তবে উভয় ক্ষেত্রে অর্থাৎ ‘দেশইত্যা’ ভাইদের উদাত্ত আহ্বান জানাতে ‘বীর চট্টলা’ একরকম অবশ্য উল্লেখ্য বিশেষণ। জনতা আর অধিবাসী শব্দ দুটোকে কেউ যদি আধুণিক রাজনীতি বিজ্ঞানের সাথে সঙ্গতি রেখে জন্মসূত্রে আর বসবাসসুত্রে বাসিন্দা হিসেবে চিিহ্নত করতে চান তা করতেই পারেন। এর সমর্থনে,সিকি শতাব্দী আগে গায়ের জোরে ‘সংস্কার’র নামে মার্শাল ডেমোক্রেসির মোড়কে আমাদের জাতীয় জীবনে উৎপাত ঘটানো বাঙ্গালী এবং বাংলাদেশীত্বের ‘কইচালি’তো আছেই। স্বভাবতঃই হরেক উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে বসবাসকারী মাত্রেই সাধারণের কাছে চাটগাঁইয়্যা স্বীকৃতি পায়না। এখানে চীনা ডেন্টিস্ট, খোট্টা সাম্পান মাঝি, মোটর পার্টস ব্যাবসায়ী খোজা-বোহরা-ইসমাইলিয়া, থাইল্যান্ডের ‘গোরা জাইল্যা জামাই’ এমনকি মূল জনস্রোতে প্রায় মিশে যাওয়া ‘মেইট্টা ফিরিঙ্গিরা’তো বটেই চাল-চলন, আচার-ব্যবহার এবং বিশেষকরে ভাষা ভিন্নতায় যে কেউ ‘বৈঙ্গা’ হিসেবে পরিচিত হয় অবলীলায়। বিদেশী, বেগানা, বহিরাগত বুঝাতে সাম্প্রতিক সময়ে তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত ‘বৈঙ্গা’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত ইতিহাস আপাততঃ ভাষাবিজ্ঞানীদের জন্যে তোলা থাক। বার আউলিয়ার পূণ্যভূমি খ্যাত বীর চট্টলায় সংগ্রামী এবং ‘তৌহিদী’ জনতার মধ্যে কোন ঐতিহাসিক বিরোধ নেই বরং একে অন্যের সহযোগী হয়েছে বারবার। মুলতঃ বন্দর-বাণিজ্য কেন্দ্রীক পরিবর্তনশীল আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবহমান কালের কৃষি নির্ভর গ্রামীণ জনপদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনধারায় ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি করেনি। সময় সময় বৈরীতা সত্বেও প্রাকৃতিক উদারতা প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ ব্যাপী এই জনপদে বিশ্বাস এবং বিত্ত-বৈভব উভয়ক্ষেত্রে সরলতা,পরমত সহিষ্ণুতা, এবং বলতে কি এক ধরণের নিস্পৃহতার ইন্ধন যুগিয়ে এসেছে। উপমহাদেশে রাজধর্মের আনুকুল্যে জনজীবনে ধর্ম বিশ্বাসের বিবর্তনের ধারায় চট্টগ্রামের বাড়তি যোগ বলতে তাও বন্দর দখল কিংবা ব্যবহার সুত্রে প্রতিবেশী এবং বৈদেশিক যোগাযোগ। এই সনাতনী বিশ্বাসের ভূমিতে দেয়াং,চক্রশালার শিক্ষা কেন্দ্র অহিংসার মন্ত্র শিখিয়েছে প্রাক-ইসলামী যুগে। খ্রীস্টীয় নবম শতক থেকে আরব বাণিজ্যিক যোগাযোগ এবং দ্বাদশ শতকে রাজনৈতিক প্রভাবসূত্রে মুলতঃ বসরা-বাগদাদ-ইয়েমেন থেকে আগত সুফী-সাধকেরা এনেছেন তৌহিদ’র বানী। আরব-পাঠান-মোগল এবং আরাকানী মুসলিম প্রশাসকদের শাসনামলে এই সাধকেরা মাটি ও মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে সমন্বয় করে সার্বজনীন ইসলাম ধর্মের আধ্যাত্মিক দর্শন প্রচার করেন নির্বিবাদে। এভাবে পীর-আউলিয়া-বুজর্গের শিক্ষা-দীক্ষা পাথেয় করে জাগতিক লোভ-লালসা কাটিয়ে আত্মিক উৎকর্ষ অর্জন এবং প্রভূ নিরঞ্জনের সন্তুষ্টি বিধানই হয়ে উঠে ধর্মের মূল লক্ষ্য। ধর্মভীরুতা,দান-দক্ষিণার তুলনামূলক প্রাচুর্য্যের ফলে চট্টগ্রামে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির রূপ-জৌলুস সব সময়ই একটু বেশী। তাই বলে ভক্তির গভীরতা ভক্তের মাথা ঘুরিয়ে দেবার কারণ হয়ে উঠেনি, মুক্ত-মনারাও জাগ্রত বিবেকের দীপ জ্বালিয়েছেন নিঃশঙ্ক চিত্তে। আসকার দিঘীর দেড় কিলোমিটার চৌহদ্দিতে এক চক্কর দিয়ে এলে নজরে পড়বে ‘নানা মত নানা পথের’ চিত্তহরা সহাবস্থান। চট্টগ্রামে আত্মিক সংকীর্ণতা তথা ভেদ-বিবাদের উর্ধ্বে এখন পর্য্যন্ত নিজস্ব মহিমায় ঠিকে থাকা পীর আউলিয়ার মাজার-খানকাহ,দরবার শরীফ এবং তাদের ঘিরে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আপামর মানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখে দেশের সংস্কার,সমন্বয়,এবং সংশয়বাদীরা নিজস্ব বিচারে উল্লসতি হন,কর্মপন্থাও ঠিক করেন কিন্তু বার আউলিয়ার পূন্যভূমির চাঁটগাইয়্যা জনতা সময়ের সবটুকু অনুসঙ্গ নিয়েও পূর্বপুরুষের শিক্ষার বিপরীতে ধর্মান্ধ হয়না,সীরাত-মিলাদ(দঃ)এ ফাটাফাটি পার্থক্য খুঁজেনা,আধুণিকতার নামে মুক্তকচ্চও হয়না। লুঠেরা রাজনীতি,জেহাদী যোশ-জজবার মহাজনেরা দেশী স্টাইলে ‘ওহাবী সিলসিলায়’ অনেক কিছুই করতে চান কিন্তু মাহফিলে পূন্যার্থী সমাগম আর ভোটের বাক্সে যোগ-বিয়োগের বাইরে চলমান জনজীবনে এর কোন সূদূর প্রসারী প্রভাব পড়েনা। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগে, দেশব্যাপী ধর্মীয় উগ্রবাদের ডামাঢোলেও বায়েজীদ বোস্তামীর আস্তানার ‘তাগা’,দরবার শরীফের ওরসের নিরামিষ কিংবা ডালের ‘ডেগ’ এমনকি ‘কাইত্যানীর’ভাতের অসাম্প্রদায়িক চাহিদাও কমার কোন লক্ষন নেই। বৃহত্তর সামাজিক পরিসরে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পরস্পরের বিশ্বাসের প্রতি পরস্পরের শ্রদ্ধাবোধ,জীবনাচারের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী চাটগাঁইয়া মূল্যবোধের মৌলিকত্ব। আন্দোলন-সংগ্রামে চির তেজোদ্দীপ্ত চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তায় মেজবান-ওরস-জেয়াফতের কথা আসে আগে।ভান্ডার শরীফের ওরস মোবারক,লাল দিঘীর তথা জাব্বারের বলি খেলা এবং মহেষখালীর পান এক নামে চট্টগ্রামকে চিনিয়ে দেয়। শুটকির একচ্ছত্র আধিপত্য হারিয়েছে সেই কবে তবুও ঘ্রাণ আছে,দেশজুড়ে ভোজন রসিকদের কাছে বহদ্দার হাটের ‘গরুর গোশত’র নামও আছে। অবশ্যই সব কিছুর উর্ধ্বে এখানকার ভাষা বৈশিষ্ঠ্যই দেশবাসীর নজর কাড়ে বেশী। কোথাও, বিশেষ করে বিদেশে দুই চাটগাঁইয়্যা একত্র হলে আলাপচারিতায় তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি ভুলে যাওয়ার প্রচলিত সপ্রশংস বদনাম নিজস্ব কথ্য ভাষাপ্রীতির উদাহরণ হতেই পারে। এই ভাষার নিজস্ব বর্ণমালার কোন সন্ধান এখন পর্য্যন্ত পাওয়া না গেলেও এক সময় তা আরবী হরফে লেখা হতো এটাই ঐতিহাসিকদের মত। চাটগাঁইয়্যা বুলি তথা ভাষার উপভাষা রোহিঙ্গা বুলি কখনও আরবী কখনওবা রোমান হরফে লেখা হতো। দেশি শব্দের পাশাপাশি সংস্কৃত, ফার্সি, আরবী, তুর্কি, পর্তুগীজ,বার্মিজ এবং অতি অবশ্যই ইংরেজী শব্দে সমৃদ্ধ চাটগাঁইয়্যা ভাষা পাহাড়ে-সমতলে চট্টগ্রাম এবং অধুনা মায়ানমারের আরাকান,ত্রিপুরা,আসামের কিয়দংশে এবং বর্হিবিশ্বে প্রবাসী চাটগাঁইয়্যা মিলিয়ে প্রায় ১৪ মিলিয়ন মানুষের মুখের ভাষা,পারিবারিক ভাষা। রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত,লড়াই সংগ্রামের মধ্যদিয়ে আপামর বাঙ্গালীর কাছে বীর চট্টলা পরিচিতি প্রাপ্ত ‘গিরি কুন্তলা,নদী মেখলা,সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা এই ভূখন্ডের মুকুট শোভায় বাড়তি কিরণ- দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানা জুড়ে বঙ্গোপসাগরের উত্তুঙ্গ ঊর্মিমালা। দেশের প্রশাসনিক সুবিধার্থে জেলা সীমানা যাই থাক, ফেনী নদী পেরিয়ে মীর সরাই থেকে রাঙামাটির জুরাইছড়ি,উত্তরে খাগড়াছড়ির শিলছড়ি বাজার থেকে মূল ভূখন্ডের শেষ সীমানা টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পর্য্যন্ত বিস্তৃত এই জনপদ ভৌগলিক অবস্থান এবং তার বাণিজ্যিক,আঞ্চলিক ঐতিহাসিক গুরুত্ব, এবং এখানে বংশ-বংশানুক্রমে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর নৃতাত্বিক অবয়ব,খাদ্যাভ্যাস, আচার-আচরন,ভাষা-সংস্কৃতি,সামাজিকতা সব মিলিয়ে বৈচিত্র্যের ঐক্যে সমৃদ্ধ এ এক অন্যরকম জনপদ। স্বকীয়তায় আপামর দেশবাসীর সবিস্ময় নজর কাড়া এ যেন দেশের ভেতর দেশ। মূল ভূখন্ডের বাইরে জলসীমায় জেগে উঠা দ্বীপসমূহ স্থানীয় মৎস্যজীবিদের বিচরন ও মৌসূমী আবাসন সূত্রে,এবং ঐতিহাসিক যোগাযোগ,ভাষা ঐক্যসুত্রে প্রশাসনিক যোগ-বিয়োগের ধারাবাহিকতায় শরণদ্বীপ তথা সন্দ্বীপও চাটগাঁইয়্যা পরিচিতির হকদার। আরব সাগর হয়ে ভারতমহাসাগরের দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রায় ‘কাপ্তান-মালুমেরা’ দূরবীনে চোখ রেখে২২◦১র্৯ ৪৯.৪১″ ( ২২ ডিগ্রী ১৯মিনিট ৪৯.৪১সেকেন্ড) উত্তর অক্ষাংশ, ৯১◦৪র্৯ ৩০.৬৫″ ( ৯১ডিগ্রী ৪৯মিনিট ৩০.৬৫সেকেন্ড) পূর্ব দ্রাঘিমায় অরণ্যঘন পাহাড়ের পটভূমিতে সূদীর্ঘ তটরেখায় বঙ্গোপসাগরের সূনীল জলরাশির অকূলে কূল পাওয়া এই পোতাশ্রয়ের নাম দিয়েছিল যে যার মত করে মনের মাধুরী মিশিয়ে- কর্ণবুল,শহরে সবজ,পোর্টো গ্রান্ডো আরো কত কি। ১৭০ মাইল দীর্ঘ কর্ণফুলী ও তার শাখা-প্রশাখা কাসালং,হালদা বোয়ালখালী, এবং মাতামুহুরী,সাঙ্গু,ইছামতি ইত্যাদি বড়-ছোট ত্রিশ নদী বিধৌত এই বাণিজ্য নগরী স্মরণাতীত কাল থেকে বিদেশী আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। যুগে যুগে যখন যে নামে প্রযোজ্য নৌ বাণিজ্য,সাম্রাজ্য বিস্তার,কর্পোরেট বাণিজ্যের সেই আকর্ষন, আসা-যাওয়া, এবং বলতে কি আগ্রাসন আজও অব্যাহত। বিনিময়ে চট্টগ্রাম কাউকে খালি হাতে ফেরায়না,যার যা পাওনা ষোলআনা বুঝিয়ে দেয় মমতা-নির্মমতায়। কালক্রমে চট্টগ্রামের আয়তন বেড়েছে বঙ্গোপসাগরের কাদা-মাটি-জলে,উত্তর থেকে দক্ষিণে। আরাকান শৈলশিরার অংশবিশেষ যথা-বাটালি হিল-ডিসি হিল- কোর্ট হিল তথা পরীর পাহাড়ের যেকোন চুড়ায় দাঁড়িয়ে নাগরখানা,জালালাবাদ পাহাড় কিংবা কুমিরা,গহিরার সমুদ্র সৈকতের দিকে তাকালে ইতিহাসের ছাত্র মাত্রেরই মনে পড়তে পারে ‘সাতটি পাহাড়ের উপর রোম নগরী অবস্থিত’ এবং “Rome was not built in a day”- রোম এখানে প্রতীকি অর্থে । ইতিহাসের পরতে পরতে সভ্যতার পলি না জমলে,বীরের রক্তধারায় সিক্ত না হলে পৃথিবীর কোন জনপদই স্বতন্ত্র দৃষ্টি কাড়েনা। চট্টগ্রাম পৃথিবীর দৃষ্টি কেড়েছে,বাংলাদেশের রাষ্ট্রসীমায় অনন্য হয়েছে অতূল ঐশ্বর্য্য-শৌর্য্য-বীর্য্য-আত্মত্যাগের আল্পনায়। প্রকৃতির অপার করুনা ধারায় কখনওবা রুদ্র-রোষে। দেশের প্রথম চা বাগান,একমাত্র জল-বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র, অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চারী কৃষির পাশাপাশি ব্যাবসা-বাণিজ্য,মূল্যবান রেমিটেন্স আহরনে চট্টগ্রাম সেই রেঙ্গুন রঙিলার জামানা থেকে বর্তমান পেট্রো-ডলারের যুগেও সমান অগ্রনী। পন্য ও সেবাখাতে আমদানী-রফতানী,শুল্ক আদায়, পর্যটন ও ভারী শিল্প-কারখানা ইত্যাদি ক্রিয়া-কান্ডের সুবাদে অর্থনীতির ভাষায়- বাংলাদেশ চট্টগ্রামের পশ্চাদভূমি, চাটগাঁইয়া ভাষায় আত্মিকৃত আরবী শব্দে বলা যায় ‘বাইনদুয়ার’ (বায়েন আল দার)। সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম বাংলাদেশের প্রবেশ-বহির্গমনদ্বার। অর্থনৈতিক আমদানী-রফতানীর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান,উৎকর্ষতা কিংবা অস্তত্বি রক্ষা যেমন- বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্য্যাপদ’র নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থাগারে আশ্রয় পাওয়া,আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য চর্চার সুযোগ সবকিছুরই যোগসুত্র চট্টগ্রাম। খাতুনগঞ্জ,আল করন,শুলক বহর যেমন ফারসী-আরবী সংশ্লষ্টিতার প্রমান দেয় তেমনি শ্যামদেশের পাটাইয়া যে চট্টগ্রামের পটিয়া নামের অপভ্রংশ নয় তাই বা কে বলবে? দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ভাষা সমূহে শব্দ সামঞ্জস্য আরাকান রেঙ্গুন হয়ে তাদের সাথে চাটগাঁইয়্যা যোগাযোগের স্বাক্ষ্য দেয় বৈকি। প্রতিবেশী তিব্বত,নেপাল,ভূটান,বার্মা,চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছাড়িয়ে চট্টগ্রামের সাথে ইউরোপীয় যোগাযোগ সুপ্রাচীন। টলেমীর বর্নণায় চট্টগ্রামের কোন কোন স্থানের নাম উল্লেখ আছে বলে মনে করেন আধুণিক ঐতিহাসিকেরা। চট্টগ্রাম বন্দরকে তিনি নিকট এবং দূরপ্রাচ্যের সর্বোত্তম হিসেবে উল্লেখ করেন। বিখ্যাত পর্য্যটক হিউয়েন সাং,ফা-হিয়েন,ইবনে বতুতা প্রমুখের লেখাতেও চট্টগ্রামের খ্যাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন ব্যবিলনীয় সভ্যতার যুগে আরব-ইয়েমেনী বণিকেরা গ্রীস,মেসিডোনিয়া এবং ভারতবর্ষ, দূর প্রাাচ্যের জাভা-সুমাত্রা,চীনের মধ্যেকার বানিজ্যে কোচিন,সুরাট,তাম্রলিপ্তি এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ চট্টগ্রামকে ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম মিলনকেন্দ্র বললে বাড়িয়ে বলা হয়না। সময়ের অন্ধকার থেকে চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস যতটা উদ্ধার করা যায়- তাতে প্রতীয়মান হয় যে, দুর্ধর্ষ মগধ রাজ ১৫১ খ্রীস্টাব্দে চট্টগ্রাম এবং আরাকান দখল করে তাতে পঞ্চম শতাব্দী পর্য্যন্ত সুর্য্য বংশীয় শাসন কায়েম রাখেন। খ্রীস্টীয় ৬ষ্ট শতাব্দীতে সমতটের রাজা চট্টগ্রাম দখল করে তাতে খড়গরাজ বংশের শাসন প্রতিষ্টা করে আনুমাণিক ১০০ বছর শাসন জারী রাখেন। ৮ম শতকে কিছু কালের জন্যে পালরাজ শ্রেষ্ট ধর্মপাল চট্টগ্রাম শাসন করেন। ১১-১২ শতাব্দী কাল সময়ে চট্টগ্রাম পাগা সাম্রাজ্যের আওতাভুক্ত হয়। ১৩ শতকের প্রথম দিকে রাজা দমোদর দেব চট্টগ্রাম শাসন করেন। বিখ্যাত পর্য্যটক মার্কো পলোর ভ্রমন বৃত্তান্তে জানা যায়-১২৭৩ খ্রীস্টাব্দে তাতার খানেরা চট্টগ্রাম জয় করেন। ১৪শতকের শুরুতে কিছু সময়ের জন্যে চট্টগ্রাম পুনরায় আরাকান রাজ্যের আওতাভুক্ত হয়।১৩৪০ সালে সোনারগাঁওয়ের ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ চট্টগ্রাম জয় করেন। বাংলায় হোসেন শাহী রাজত্বের চুড়ান্ত বিকাশকালে, শঙ্খ নদীর বিভাজন রেখায় উত্তর চট্টগ্রাম শাসনকর্তা আমীর্জা খাঁ এবং দক্ষিন চট্টগ্রাম খোদা বখশ খাঁ শাসন করতেন। ব্যারোজের মানচিত্র অনুসারে ধারণা করা হয় খোদা বখশ খাঁর রাজ্য বার্মার আকিয়াব পর্য্যন্ত বিস্তৃৃত ছিল। ক্ষমতার দ্বন্ধে লিপ্ত এই দুই প্রশাসক পালাক্রমে পর্তুগীজদের সাথে শত্রুতা এবং বন্ধুত্বের প্রতিযোগীতায় নেমেছিলেন। শেরশাহের হাতে ১৫৩৮ সালে সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ পরাজিত হলে শেরশাহের সেনাপতি নওয়াজেশ চট্টগ্রাম দখল করেন এবং এভাবে ১৫৮০ সাল পর্য্যন্ত এখানে পাঠান রাজত্ব চলে। ১৫৭৫ সালে পাঠানেরা বাংলা থেকে বিতাড়িত হলেও জামাল খান পন্নী ১৫৮০ পর্য্যন্ত চট্টগ্রাম শাসন করেন। এতদঞ্চলে আরাকান,ত্রিপুরা ও পর্তুগীজদের আঁতাতের ফলে পাঠান রাজত্বের অবসান ত্বরান্বিত হয়। বাংলায় পাঠান রাজত্বের শেষ সময় থেকে চট্টগ্রামে পুনরায় আরাকানী জবর দখলের সুত্রপাত ঘটে এবং স্বাভাবিকভাবেই তাদের মিত্র পর্তুগীজদের প্রভাব-প্রতিপত্তিও বেড়ে যায়। এক্ষনে প্রসঙ্গক্রমে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীক আঞ্চলিক রাজনীতিতে পর্তুগীজদের ভূমিকা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। ইসলামিক যুগে আরব নৌশক্তির অভ্যুদয়ের ফলে উপমহাদেশের সাথে ইউরোপীয় যোগাযোগ সাময়িকভাবে ছিন্ন হয়। উপমহাদেশের বর্হিবানিজ্যে একচেটিয়া কতৃত্ব স্থাপন করে আরব-ফার্সি বণিকেরা। পতুর্গীজ নাবিক ভাস্কো-দা গামা কতৃক ইউরোপ থেকে উপমহাদেশে আসার জলপথ আবিষ্কারের পর থেকে পুনরুদ্যমে একের পর এক ইউরোপীয় পরাশক্তি এখানে বাণিজ্য-সাম্রাজ্য গড়তে উঠে পড়ে লাগে। শুরুতে এই লড়াইয়ে এগিয়ে থাকে পর্তুগীজরা। পর্তুগীজ ভারতের শাসনকর্তা আলবুকার্ক গোয়ায় প্রধান ঘাঁটিতে বসে ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৫১৬ খ্রীস্টাব্দের দিকে জো আঁও কো এলোকে প্রতিনিধি হিসেবে বাংলায় পাঠান । ধারনা করা হয় আরব বাণিজ্য তরীতে করে চকরিয়া বন্দর হয়ে তিনি চট্টগ্রাম পৌঁছান, এজন্যেই চট্টগ্রামকে ‘পোর্টো গ্রান্ডো’ হিসেবে উল্লেখ করেন। সঙ্গত কারনেই তিনি রাজধানী গৌড়ের পরিবর্তে চট্টগ্রামেই বেশী থাকতেন । পর্তুগীজ ঐতিহাসিকদের মতে বাংলার স্বাধীন হোসেন শাহী রাজবংশের প্রতিষ্টাতা সুলতান হোসেন শাহর মত সে সময় চট্টগ্রামের প্রাদেশিক শাসনকর্তাও আরববংশজাত ছিলেন। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় আগাগোড়া জলদস্যু সূলভ আচরণে অভ্যস্ত পর্তুগীজদের সাথে চট্টগ্রামের শাহী প্রশাসকদের সম্পর্ক এই ভাল এই মন্দ পর্য্যায়ের। গোয়ার পর্তুগীজ শাসনকর্তারা বিভিন্ন সময়ে সিলভেইরো,পেরেরা,জুসার্ট প্রমুখের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে যে সব বাণিজ্য বহর পাঠিয়েছেন তারা বাণিজ্যের চেয়ে সমুদ্রে এবং উপকূলে দস্যুবৃত্তিতে বেশী পারঙ্গমতা দেখান। এক পর্য্যায়ে চট্টগ্রামের শাসনকর্তার বিরাগভাজন হয়ে পর্তুগীজদূত জোঁ আঁও কো এলো চীনে পাড়ি জমান। ১৫৩২ সালে সুলতান নসরত শাহর মৃত্যুর পর তার পুত্র সুলতান ফিরোজ শাহ বাংলার সিংহাসনে আরোহন করেন। কিন্তু মাত্র তিন মাস সময়ের মধ্যে তিনি তার চাচা গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহর হাতে নিহত হন। জানা যায় এই পারিবারিক কলহের সময় গিয়াসুদ্দিন পর্তুগীজদের সাহায্য পেয়েছিলেন। তার সাহায্যার্থে গোয়া থেকে পর্তুগীজ শাসক পাঁচখানা জাহাজে দুইশত নৌসেনা চট্টগ্রামে প্রেরন করেন। পর্তুগীজদের আশা ছিল এবার তারা চট্টগ্রামে বাণিজ্যকুঠি নির্মান সহ সব রকমের সুবিধা পাবেন। কিন্তু দস্যুবৃত্তির সপ্রমান অভিযোগে পর্তুর্গীজরা রাজরোষে পড়েন। সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটলে গোয়া থেকে এন্টনিও ডি সিলভা মেনেজেস এর নেতৃত্বে নয়খানি জাহাজে তিনশত পর্তুর্গীজ সৈন্য চট্টগ্রামে আসে। পর্তুর্গীজরা বন্দরে এবং আশে পাশের লোকালয়ে আগুন দেয়। আগুন থেকে পলায়নপর নিরীহ লোকজনকে নির্বিচারে হত্যা করে। চট্টগ্রামের এই পরিস্থিতির খবর গৌড়ে পৌঁছলে সুলতান ক্রোধান্বিত হয়ে পর্তুগীজদের সম্পুর্ন উৎখাতের প্রস্তুতির নির্দেশ দেন। কিন্তু ঘটনা চক্রে পাশ্ববর্তী বিহারে শেরশাহের দ্রুত উত্থানে বিচলিত হয়ে গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহ বিদেশী পর্তুগীজ এবং দিল্লীর মোগল সম্রাট হুমায়ুনের সাথে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হন। পর্তুগীজ প্রতিনিধি ডি মেলোকে সামরিক পরামর্শক নিয়োগ দেন। পর্তুগীজদের সহায়তা নিয়েও মাহমুদ শাহ পরাজিত এবং শেরশাহের সাথে অপমানজনক শর্তে সন্ধি করতে বাধ্য হন। এই পরিস্থিতিতেও সুলতান পর্তুগীজদের সাথে সম্পাদিত আগের চুক্তি অনুসারে ফার্ণান্ডেজ ফ্রেয়ারকে চট্টগ্রামের প্রধান শুল্ক অধিকারক নিযুক্ত করেন, পর্তুগীজরার এভাবে চট্টগ্রামে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার উপর শুল্ক আদায়ের অধিকার সহ আরও নানাবিধ সুযোগ সুবিধা লাভ করেন।১৫৩৮ সালে শেরশাহের সাথে যুদ্ধে মাহমুদ শাহ চুড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। স্বাধীন পাঠান রাজবংশের ক্ষমতাকালীন সময়ে ‘শত্রুর মিত্র শত্রু’ হিসেবে পর্তুগীজরা আগের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। পর্তুগীজরা চট্টগ্রাম বন্দরে ব্যর্থ হয়ে বাকলা ( বরিশাল) রাজের সাথে বাণিজ্য চুক্তি করেন। বাকলার বন্দর সমূহ নৌ বাণিজ্যে চট্টগ্রামের সমকক্ষ না হওয়াতে পর্তুগীজরা পুনঃরায় চট্টগ্রামে আনাগোনা শুরু করে। এবার তারা সন্ধীপের শাসনকর্তার বন্ধুত্ব পায়। ষোড়শ শতকের শেষ চতুর্থাংশে বাংলায় পাঠান রাজবংশ পতনের পথে এগোতে থাকে। পরিণতিতে চট্টগ্রামে আরাকানী শাসন প্রতিষ্টিত হয়। আরাকানরাজ সেকেন্দার শাহ্র সাথে ব্যাক্তিগত বন্ধুত্বের সুবাদে পর্তুগীজরা চট্টগ্রামে যাচ্ছেতাই করতে শুরু করে। ফলে একসময় আরাকানীদের সাথেও তাদের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে।১৫৯০ খ্রীস্টাব্দে পর্তু গীজরা চট্টগ্রাম দুর্গ লুঠ করে, এবং সন্ধীপের মঘ শাসন কর্তাকে তাদেরকে কর দিতে বাধ্য করেন। পর্তুগাল রাজ যেখানে আরাকান রাজের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে চায় সেখানে চট্টগ্রামে পর্তুগীজরা জোর জবরদস্তি করে হলেও বাণিজ্যকুঠি কিংবা দুর্গ নির্মাণ করে পাকাপোক্ত ঘাঁটি গাড়তে চায়। এক পর্য্যায়ে অবস্থা এমন হয় যে, মঘদের সাথে পর্তুগীজদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসাতে তারা চট্টগ্রামে দুর্গ নির্মাণের অনুমতি পেলেও লিসবনে পর্তুগাল রাজ সে প্রস্তাব আমলে নেয়নি।
সেকেন্দার শাহর মৃত্যুর পর রাজা হন সলিম শাহ। শুরু থেকেই তিনি পর্তুগীজদের সাথে বন্ধু ভাবাপন্ন ছিলেন। ১৫৯৬ সালে তিনি পর্তুগীজদের আমদানী পন্যের উপর শতকরা তিনভাগ হারে শুল্ক হ্রাস করেন। বন্ধুত্বের প্রতিদান স্বরুপ পর্তুগীজরা সলিম শাহকে পেগু আক্রমনে সহায়তা করেন। সলিম শাহ বলতে গেলে চট্টগ্রাম বন্দরটাই পর্তুগীজদের হাতে তুলে দেন। খ্রীস্ট ধর্ম প্রচারের অনুমতি এবং তার জন্যে আর্থিক সাহায্য লাভের প্রতিশ্র“তিও পায় পর্তুগীজরা। এত পাওয়ার পরেও পর্তুগীজদের স্বভাব বদলায়নি, তারা সীমাহীন লুঠতরাজ,নৌদস্যুতা চালিয়ে যেতে থাকে। এদের উৎখাত করার জন্যে এবার বাকলা রাজের সাথে জোট গঠন করে আরাকান রাজ। ১৬০২ সালের ৮ই নভেম্বর আরাকান নৌবহর দেয়াঙ এর পর্তুগীজ ঘাঁটির উপর সর্বাত্মক আক্রমন চালায়। চট্টগ্রামে পর্তুগীজ গীর্জা এবং তাদের আবাসগৃহসমূহ ধ্বংস করা হয়। পাদ্রীদেরও মারধর করা হয়। চট্টগ্রামে এই বিপর্য্যয়ের খবর এতদঞ্চলে সবচেয়ে বড় পর্তুগীজ ঘাঁটি সন্ধীপে পৌঁছলে সেখান থেকে নৌবহর নিয়ে চট্টগ্রাম আক্রমন করে পর্তুগীজরা। যুদ্ধে আরাকান নৌবহর সম্পুর্ন বিধ্বস্ত হয়। পর্তুগীজরা অধিকৃত চট্টগ্রামের জনগনের উপর চরম প্রতিশোধ নেয়। সলিম শাহ আরাকানে ফিরে সেখানকার পর্তুগীজদের উপর এর শোধ নেন। অবশেষে উভয় পক্ষে আবারও রফা হয়। আরাকান রাজ চট্টগ্রামে যুদ্ধ বিধ্বস্ত গীর্জা পুন:নির্মান করে দিতে সম্মত হন। পতুর্গীজরা চট্টগ্রাম এবং সন্ধীপে তাদের নৌশক্তি বৃদ্ধি করে। এই অবস্থাতেও পর্তুগীজরা দেয়াং এবং তার আশে পাশের গ্রামে নানা রকম জোর জুলুম অব্যাহত রাখে। ফলে আরাকান রাজ পুনরায় চট্টগ্রাম এবং সন্ধীপে পর্তুগীজদের দমনের জন্যে নৌশক্তি প্রয়োগ করেন। চট্টগ্রাম বন্দরের অদূরে এক নৌযুদ্ধে পর্তুগীজ বাহিনীকে বিধ্বস্ত করে, চট্টগ্রামে পর্তুগীজ বাসিন্দাদের উপর নির্মম অত্যাচার করেন। জানা যায় শুধুমাত্র দেয়াং উপকূলেই ৬০০ পর্তুগীজকে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রাম থেকে একপ্রকার বিতাড়িত হয়ে পর্তুগীজরা ১৬০৯ খ্রীস্টাব্দে সন্ধীপ অবরোধ করে। সন্ধীপের মোঘল শাসন কর্তা ফতে খাঁ পর্তুগীজদের হাতে খুন হন। পর্তুগীজ সেনাপতি সিবাস্তিয়ান গঞ্জালেস অন্যান্য জলদস্যুদের সহায়তায় নিজেই সন্দ্বীপের শাসনকর্তা সেজে যান।
১৬১২ সালে সলিম শাহের মৃত্যুর পর হোসেন শাহ আরাকান অধীশ্বর হন। চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন তার ছোট ভাই। হোসেন শাহ পর্তুগীজ বিদ্বেষী হলেও চট্টগ্রামের প্রশাসক তার ছোট ভাই, সন্ধীপের পর্তুগীজ অধিপতি গঞ্জালেসের সাথে মিত্রতার সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ ছিলেন। এই সন্ধির শর্ত মোতাবেক সম্ভাব্য আরাকান আক্রমন মোকাবেলা করার জন্যে চারশো পর্তুগীজ সৈন্য চট্টগ্রামে মোতায়েন রাখা হয়। এক পর্য্যায়ে হোসেন শাহ নিজেও ভাইয়ের বিরুদ্ধে পর্তুগীজ সাহায্য চেয়ে বসেন। শেষাবধি আরাকান বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়ে চট্টগ্রামের প্রশাসক সপরিবারে সন্ধীপে পর্তুগীজদের কাছে আশ্রয় নেন। জানা যায় যে,সেখানে তার মৃত্যু হলে তার পুত্র কন্যা উভয়েই খ্রীস্টধর্মে দীক্ষিত হয়। চট্টগ্রামকে পর্তুগীজ হুমকি মুক্ত করে আরাকান রাজ হোসেন শাহ সন্ধীপের পর্তুগীজদের মোকাবিলা করতে মনস্থ করলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি পর্তুগীজদের শত্রু ওলন্দাজদের সাহায্য কামনা করেন। পর্তুগীজরা গোয়া থেকে সাহায্য নিয়ে মূল আরাকান ভূখন্ড আক্রমন করে পর্য্যুদস্থ হয়। চট্টগ্রাম ও সন্ধীপকে কেন্দ্র করে বাংলায় পর্তুগীজ উপনিবেশ স্থাপনের স্বপ্ন চিরতরে ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। কিন্তু তার পরেও মোগল সম্্রাট জাহাঙ্গীরের আক্রমনের ভয়ে হোসেন শাহ পর্তুগীজদের সাহায্যের আশায় তাদের সুযোগ সুবিধা দিয়ে চলেন। এই সুবাদে আরাকান রাজের বশ্যতা মেনে পর্তুগীজরা চট্টগ্রামে বসবাস করতে রাখে। মুলতঃ এই সময় থেকে মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হয় চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন এলাকা বিশেষতঃ সন্ধীপ। পুরো উপকূলীয় এলাকা মগের মুল্লুক, হার্মাদের মুল্লুক নামে কুখ্যাতি অর্জন করে। শায়েস্তা খানের আমলে সেনাপতি বুজুর্গ উমিদ খান মোঘলদের পক্ষে ১৬৬৫-৬৬ সালে আরাকানীদের বিতাড়িত করে ফেনী নদী থেকে দক্ষিন দিকে শঙ্খ নদী পর্য্যন্ত দখলে আনেন। ১৭৫৬ সালে দোহাজারির মোঘল সেনাধ্যক্ষ আধু খান শঙ্খের দক্ষিণ পাড় থেকে নাফ নদীর উত্তরাংশ পর্য্যন্ত এলাকা আরাকানীদের হাত থেকে উদ্ধার করেন। মোগল আক্রমনের সময় আরাকানীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেও পর্তুগীজরা মোগলদের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা আদায় করতে পারেনি। তাদের দেয়া চট্টগ্রাম বন্দরের ‘পোর্টো গ্রান্ডো’ নামের সাথে জড়িয়ে আছে বন্দর অবরোধ,অগ্নি সংযোগ,দস্যুতা এবং উপকূলীয় অঞ্চল থেকে নিরীহ লোকজনকে বলপুর্বক ধরে এনে পাথর ঘাটায় খ্রীস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করা ইত্যাদি সীমাহীন লোভ-লালসা, জোর জুলুমের দুঃসহ পর্তুগীজ স্মৃতি। পলাশী বিপর্য্যয়ের পর পর্য্যায়ক্রমিক বাংলার সিংহাসন-কতৃত্ব ভাগাভাগি চুক্তির শর্ত মোতাবেক১৭৬০খ্রীস্টাব্দের ২৭শে সেপ্টেম্বর মীর কাশিমের কাছ থেকে চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ম্যান্ডেট পায় বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। চট্টগ্রামের তৎকালীন শাসক নবাব রেজা খাঁ ইংরেজ প্রশাসক হেরি ভেলেট’র কাছে প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইংরেজরা চট্টগ্রামকে আলাদা প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে শাসন করার লক্ষ্যে, ১৭৭৩ সালে কর্ণফুলী থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে পরীর পাহাড়ে প্রশাসনিক ভবন হিসেবে বর্তমান কোর্ট বিল্ডিং তৈরী করে। চট্টগ্রামে তাদের প্রশাসনিক কেন্দ্র নির্বাচনের দূরদর্শিতার প্রমান পাওয়া যায় পরবর্তী ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট সময় কাল পর্য্যন্ত কার্য্যকলাপে এবং বিশেষ করে ১৯৩০ সালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে হলেও পরাজিত হয়ে পলায়নের পথ খুঁজতে। বিশ্বের সেরা নৌ বাহিনীর দাবীদার ইংরেজ শক্তি, যাদের সাম্রাজ্যে সুর্য্য অস্ত যায়না তারা প্রাণ হাতে নিয়ে ভারতবর্ষের পূব দরজায় কর্ণফুলিতে বেলা ডুবির স্বাদ নিয়েছিল সে সময়। প্রসঙ্গক্রমে, আমৃত্যু রাজভক্ত নীরদ চন্দ্র চৌধুরী তাঁর Thy hand great anarch. ইতে যেমনটা বলেছেন, “All that was good and living within us was made, shaped and quickened by the British rule” তা স্মরণ করতেই হয়। বিশেষতঃ living within us, was made, shaped and quickened কথাগুলো আজকের দিনেও গভীর তাৎপর্য্যবহ। বেনিয়া ইংরেজদের জোর-জুলুম, ভাগ করে শাসন করার সাম্রাজ্যবাদী নীতির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি বৈশ্বিক যোগাযোগের ফসল স্বরূপ ভারত বর্ষে আধুণিক জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্মেষ তথা রেনেসাঁর উদ্ভব ঘটে এই পরাধীন সময়ে। নবাবী,বাদশাহী ইত্যাকার সহস্র খন্ডে বিভক্ত ভারতবর্ষ একক কতৃত্বপরায়ন শাসনের আওতায় আসা,লোকপ্রশাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধনের ফলে মধ্যযুগীয় প্রজাদের চিন্তা-চেতনায় নাগরিক সভ্যতা,আধুণিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার চাহিদা জাগ্রত হয়। ‘জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপি গরিয়সী’এই বৈদিক আবেগকে পরোক্ষভাবে হলেও জাতীয়তাবোধের কঠিন জমিতে স্থাপিত করে ইংরেজ নিষ্পেষন। স্বাধিকার,স্বরাজ,স্বাধীনতার সংগ্রামে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষাপটে,আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের বীজও রোপিত হয় পৌনে দুই শতাব্দীব্যাপী ইংরেজ শাসনামলে। এই শক্তির সফল প্রায়োগিক উদাহরণ নিয়ে, পরবর্তীতে দ্বিখন্ডিত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সূর্য্য উঁকি দেয় পূব দিগন্তের চট্টগ্রামেই। ১৮৫৭সালে ২৯শে মার্চ বারাকপুর সেনা ছাউনিতে সিপাহী বিদ্রোহ নামে খ্যাত ভারতবর্ষের জাতীয় অভ্যুত্থানের যে দাবানল জ্বলে উঠে তার প্রথম প্রতিধ্বণি জাগে এই চট্টগ্রামে। হাবিলদার রজব আলী খাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের ৩৪ নং রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষনা করে সেনা ছাউনি,অস্ত্রাগারে আগুন দেয়। সিপাহীরা জেলখানার কয়েদীদের মুক্তি দেয়, সরকারী কোষাগার লুঠ করে। পরাক্রমশালী ইংরেজরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুক্তির এই লড়াইয়ে সিপাহীরা স্বাধীন ত্রিপুরা রাজের সাহায্য আশা করে বিনিময়ে সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়েন। মণিপুর রাজ্যের পথে তাঁরা সিলেটের ইংরেজ পদাতিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বীর বিক্রমে লড়াই করে মুক্তিকামী জনতার ইতিহাসে ঠাঁই করে নেন। তারপর বিংশ শতাব্দীর অপেক্ষা।“Chittagong to the fore (চট্টগ্রাম সবার আগে)– বঙ্গভঙ্গ,অসহযোগ,খিলাফত সব আন্দোলনের সম্মিলিত স্রোতে ‘স্বরাজ’ এর দাবীতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে চাটগাঁইয়্যা জনগনের ব্যাপক অংশগ্রহন এবং স্বরাজ তহবিল গঠনে আর্থিক সাড়ার মাত্রা দেখে উদ্দীপ্ত হয়ে অহিংস আন্দোলনের পবর্তক মহাত্মা গান্ধী তাঁর “তরুন ভারত” সাপ্তাহিক পত্রিকায় এভাবেই চট্টগ্রামকে অভিনন্দন জানান।
ভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারী বাংলা কংগ্রেস এর নরম-গরম স্রোত ধারায় দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুভাষ বসুর পাশা পাশি চাটগাঁইয়্যা দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন, ত্রিপুরা চরন চৌধুরী, মহিমচন্দ্র দাস, নৃপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, শেখ-এ- চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার, মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রমুখ মনীষীরা এই জনপদকে ইতিহাসের পাদ প্রদীপে তুলে ধরেন। সেদিন শিক্ষা-সংস্কৃতি,অর্থ-বিত্তে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ না ঘটা মুসলিম সমাজের জালাল আহমদ জগলুল, মৌঃ নজির আহমদ,শাহ নুরুদ্দিন,মৌলানা নুরুল হক, শাহ বদিউল আলম, অলি আহমদ অলি ইসলামাবাদী,মাহমুদুল হক,মোহাম্মদ মুসা,আব্দুল করিম নিজামপূরী,মোঃ হারুন, এবং কাজেম আলী মাস্টারের দুই ছেলে- একরাম উল হক এবং মো: সিরাজুল হকের মত অগ্রসর রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা জাত-পাতের উর্ধ্বে উঠে জাতিয়তাবাদের যে অসাম্প্রদায়িক ভিত্তি রচনা করেন পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তা অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্টিত হয় ।
‘চাঁদপূর কুলি নিগ্রহ’ তথা আসামের চা বাগানে ইউরোপীয় মালিকদের অত্যাচারে অতিষ্ট কুলি-কামিনরা পায়ে হেঁটে চাঁদপূর স্টিমার ঘাটে এসে রাতের আঁধারে যে পুলিশী বর্বরতার শিকার হয় তার প্রতিক্রিয়ায় চট্টগ্রামের রাজনৈতিক আন্দোলন নুতন মাত্রা পায়। নেতা-কর্মীদের সশরীরে চাঁদপূর উপস্থিত হয়ে নিগৃহীত শ্রমিকদের সাহায্য-সহযোগীতা করা,অত্যাচারের প্রতিবাদে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের চট্টগ্রাম-চাঁদপূর লাইনে ধর্মঘট পালন,এর ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামে বি ও সি, টার্নার মরিসন প্রভৃতি ইংরেজ ব্যাবসায়িক প্রতিষ্টানের শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বতঃস্ফুর্ত ধর্মঘট এবং, ধর্মঘটি রেলশ্রমিকদের সপরিবারে মানবিক সহায়তা প্রদানের মধ্যদিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের যে ছবি চট্টগ্রাম তুলে ধরে আজকের বাংলাদেশে তা রূপকথার গল্পের মতই শোনাবে।
ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাস চাটগাঁইয়্যা ভাষায় কথা বলে। শেকল ভাঙ্গার নিয়মতান্ত্রিক এবং অহিংস আন্দোলনের যুগে আইরিশ বিপ্লবীদের অনুসরনে, উত্তাল চট্টলার চির অম্লান বীর গাঁথার মুখবন্ধ ১৯৩০এর ১৮-২২শে এপ্রিল, সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়া কাঁপানো চারদিন। মাস্টার দা সূর্য্য সেনের নেতৃত্বে ৬৩ জন বিপ্লবীর শৌর্য্য-বীর্য্যে আঁকা চট্টগ্রামের এই চিরায়ত ট্রেডমার্ক- পরাধীন ভারতবর্ষে মুক্ত স্বদেশ। ২৩শে সেপ্টেম্বর ১৯৩২, প্রীতিলতা ওয়েদ্দেদারের নেতৃত্বে পাহাড়তলীর ইউরোপীয়ান ক্লাবে সফল আক্রমন আরেক উপখ্যান। লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে যে কোন ইস্যুতে রাজনীতি করা নেতা-নেত্রী এমনকি সরকার-রাষ্ট্র প্রধান অহরহ জন্ম নেবেন কিন্তু হাতে অস্ত্র,কোমরে বিষের বড়ি- দেশপ্রেম যেখানে নির্দ্বিধায় শুধুমাত্র আত্মোৎসর্গে উদ্বুদ্ধ করে সেই বীর প্রসবিনী চট্টগ্রামের সূর্য্য সেন, প্রীতিলতা,কল্পনা দত্তরা প্রতিদিন কিংবা সর্বত্র জন্ম নেননা। বীর চট্ট্রলার গৌরবোজ্জল ইতিহাসের এই অধ্যায়ে প্রকাশ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের অংশ গ্রহন কেন নেই তার নানা গবেষণা চলতেই পারে কিন্তু সুভাষপন্থী জেলা কংগ্রেসের ছত্র ছায়ায় অতি সন্তর্পনে গড়ে উঠা এই সশস্ত্র বিপ্লববাদের প্রতি শেখ-এ-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার,কিংবা পরবর্তীতে ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা হিসেবে ইংরেজদের হাতে নির্দয়ভাবে নির্য্যাতীত মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী এবং জালাল আহমদ জগলুল প্রমুখের সমর্থন অনায়াসেই ধারনা করা যায়। চিরকালের উচ্ছিষ্টভোগীরা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীতে চট্টগ্রামের বৃটিশ বিরোধী অবস্থান বিশেষকরে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের যে কটাক্ষ করেন তার প্রেক্ষিতেই উপরোক্ত নামগুলোর একতরফা উল্লেখ।
১৯৩৯এর ডিসেম্বার মাস থেকে মহাযুদ্ধের ডামাঢোলে বার্মা থেকে সর্বসান্ত মানুষের ঢেউ আছড়ে পড়ছে চট্টগ্রামের বুকে। সামরিক প্রয়োজনে খোলা বাজার থেকে নিত্য প্রয়োজনীয়,খাদ্য দ্রব্য তুলে নেয় বৃটিশ সরকার,বিমান হামলা প্রতিরোধ প্রস্তুতি হিসেবে ২৪ ঘন্টার নোটিশে জনপদ খালি করার নির্দেশ বাস্তবায়িত করে অক্ষরে অক্ষরে। মহামারী-দুর্ভিক্ষ-জাপানী বোমা হামলার শিকার চট্টগ্রাম বিধ্বস্ত,বিপর্য্যস্ত। কিন্তু পরাজিত নয়। কংগ্রেস-লীগ,বিপ্লববাদী এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনিিততে বিশ্বাসী নির্বিশেষে মানবিক বিপর্য্যয় রোধে এবং ফ্যাসিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দঁড়িয়ে চট্টগ্রাম সুকান্তের অমর কবিতায় উঠে আসে, -“সব প্রস্তুত মৃত্যুর দূত হানা দেয় পূব দরজায়/ফেনী ও আসামে,চট্টগ্রামে রুদ্র জনতা গর্জায়। বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ সুতীক্ষè কর চিত্ত/বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।”
আরাকানী- বার্মিজ-আরব-মোগল-পাঠান-পর্তুগীজ-ইংরেজ খেদানো চট্টগ্রাম যে নয়া উপনিবেশ পাকিস্তানের অমারাতেও ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি’ আগলে দাঁড়াবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। মাতৃভাষার দাবীতে রক্তাক্ত দেশে চট্টগ্রামের প্রথম উচ্চারণ-“কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি”। স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যখন পাক হানাদারদের অতর্কিত আক্রমনে হতচকিত এই চট্টগ্রামের মাটি তখন ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে বীর বিক্রমে প্রথম আক্রমন রচনার রক্তকাব্য লিখছে। তারও আগে এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে পাকিস্তানী অস্ত্র খালাসে বন্দর শ্রমিকদের অস্বীকৃতি , পাক বাহিনীর সহায়তা করতে আসা বিভ্রান্ত বাঙ্গালী সেনা কর্মকর্তাদেরকে আগ্রাবাদে উত্তেজিত জনতার রুখে দাড়ানো এবং পতেঙ্গা-হালিশহরে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে বন্দর ঘেরাও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য সাধারণ ঘটনা। কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে উপর্য্যুপরি “আমাদের মহান নেতার” নামে স্বাধীনতার ঘোষনা পাঠ স্বাধীন বাংলাদেশকে চট্টগ্রামের ঠিকানা নুতন করে চিনিয়ে দেয় ।
“চট্টগ্রাম কর্ণফুলীর মোহনায় অবস্থিত” ধ্র“পদী সাহিত্য পথের পাঁচালির অমর চরিত্র অপু এভাবেই চট্টগ্রাম চিনেছে। যেখানে নীল জলে নীলাকাশে মেশামেশি, গাঙচিলের ডানায় চোখ রেখে স্বপ্ন-সন্ধানীদের আসা আছে যাওয়া তেমন নেই, সেই চট্টগ্রামের আপাতত: পরিচয় ঢাকঢাক গুড়গুড় সরকারী ঘোষনায়- বাণিজ্যিক নগরী। চাটগাঁইয়া জনগন গ্রামে হতশ্রী,শহরে সংখ্যালঘু । চট্টগ্রাম এখন,অসংস্কৃত ভাষায় ‘বৈঙ্গা’র দখলে। এখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা জামাই আদরে থাকেন অথচ দেশের নদী ভাঙ্গনের শিকার হত-দরিদ্র মানুষগুলোকে ঠেলে দেয়া হয় শ্বাপদ-সঙ্কুল পাহাড়ী জনপদে, দ্বন্ধ সংঘাতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্থ কায়েম রাখতে। বন্যা-ঝড়-জলোচ্ছাসের মুখে সমর্পিত জনপদে দুর্য্যোগের নুতন সংস্করন যোগ হয়েছে- পাহাড়ি ধ্বস। প্রেমাসিয়া,মাতারবাড়ি,পতেঙ্গা কোথাও একটা অক্ষত বেড়িবাধঁ দেখা যাবেনা অথচ ভরা বর্ষায় জনগনের কষ্টার্জিত অর্থ জলে ঢালার প্রতিযোগীতা চলতেই থাকবে। সরকারের গণতান্ত্রিক ব্যর্থতা যেখানে পাইকারী অযুহাত, অভিযোগ তুলে বিচ্ছিন্নতাবাদের দায়ে ষড়যন্ত্র মামলা খাওয়ার চেয়ে কপালের দোষ দেয়াটাই নিরাপদ। তবুও জনমনে অমলিন স্মৃতি জেগে থাকে-ভ্রাতৃঘাতক আওরঙ্গজেবের তাড়া খাওয়া শাহ সুজার পদচিহ্ন, মাতৃভূমিতে ‘থোড়া জমিন’না পাওয়া বদনসীব শেষ মোঘল বাহাদুর শাহ জাফরের চোখের পানি পড়েছে এই চট্টগ্রামে।
চট্টগ্রাম এখন পর্য্যয়ক্রমিক সরকার বদলের আন্দোলনের আতুড় ঘর। ঘুষ হিসেবে পাওয়া যায় মন্ত্রীর বহর। মিছিল-মিটিংয়ে জনতা সাপ্লাইয়ের আড়ত এখন চটগ্রাম সমুদ্র বন্দর। বন্দর পরিচালনা,ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষা নিরীক্ষার নামে টার্নার মরিসনের ভাই-বেরাদরেরা নকশা জুগিয়ে চলেন ঠিক কোন জায়গাটিতে নুতন বন্দর করা গেলে বাংলাদেশকে দুধ-মধুতে ভাসিয়ে দেয়া যাবে। ট্রানজিট আর নিউমুরিং জেটি ব্যবহারের সুবিধা পেলে সমুদয় বাণিজ্য ঘাটতি মিটিয়ে দেবে প্রতিবেশী। বন্দরের মুখে নুতন বন্দর গড়ার সুযোগ দিলে বাৎসরিক বাজেটের টাকার জন্যে ভাবতে হবেনা পরামর্শ দেয় ‘দাদা সংস্থার’মুরুব্বীরা। ক্ষুদ্র ঋনের নোবেল বিজয়ী মহিমাও ‘গভীর সমুদ্র বন্দরের’ স্বপ্নমাখা দেশী-বিদেশী রাজনীতির ঘুর্ণাবর্তে হারিয়ে যায়। অবহেলা,অসম উন্নয়ন আর বন্দরের শুল্ক নিয়ে টানাটানির স্বাক্ষী হয়ে তবুও দেয়াং পাহাড়ে,মোহনায় প্রতিদিন সূর্য্য উঠে। বাংলাদেশ চট্টগ্রামের নামে এক চোখে স্বপ্ন দেখে আবার জেগে উঠার জীয়ন কাঠি দেখে ভ্রুকুুটি হানে আরেক চোখে ।
এখানে মহারাণীর সাম্রাজ্য রক্ষার পাইক বরকন্দজরা ৮ একর জায়গা নিয়ে বাদশা মিয়া রোডের কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি নামে দৃষ্টি নন্দন কবরখানায় চিরশান্তিতে শুয়ে থাকেন, একই ভূমিতে ফ্যাসিবাদী জাপানীদেরও জায়গা হয় কিন্তু অজেয় বীর মাস্টার দা সূর্য্য সেন রাতের আঁধারে ভেসে যান কর্ণফুলীতে। জালালাবাদ,নাগরখানা পাহাড় সংরক্ষিত এলাকার নামে সাধারণ জনগনের কাছে নিষিদ্ধ হয়ে থাকে। কর্ণফুলিতে পাক বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ,পুঁতে রাখা মাইন উদ্ধার করে বন্দর বাঁচানো রাশান বীর ডুবুরি ইউরি ভি রেডকিন শুয়ে থাকেন দক্ষিণ পতেঙ্গার প্রান্ত সীমায় “ওয়েস্ট পয়েন্ট” নামে পরিচিত নৌ ঘাটির ঘেরাটোপে। তার জন্মদিনে মর্মর সমাধিতে রাশান কন্স্যুলেটের দেয়া একমাত্র মালাখানি লোনা হাওয়ায় দোল খায়, টুপটাপ ঝরে বট ফল, ভরা জোয়ারে বঙ্গোপসাগরের জলের ঝাপটা এসে লাগে। বাংলাদেশ যেন তার খবর চেপে রাখতে চায়। যেন কর্নফুলীর বুকে জাহাজ মারা হাসিমদের ‘অপারেশন জ্যাক পট’ এর ‘ইনডাকশন পয়েন্ট’ সন্তর্পনে আড়াল করতে চায়।
আর এসবের মাঝে জ্যোছনা ধোয়া নিঝুম নিশুতি রাতে কিংবা পাখী ডাকা ভোরে দুঃখ-সুখের মোহনায় জোয়ার-ভাটায় চোখ রেখে মহাকালের স্বাক্ষী দেয়াং পাহাড় গেয়ে চলে “ওরে কর্ণফুলিরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে—-”।
তথ্য সূত্র ঃ-
চট্টগ্রাম বিষয়ক ওয়েভ সাইট
স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম-পূর্নেন্দু দস্তিদার
চট্টগ্রামে পর্তুগীজ অনুপ্রবেশ- সুনীতি ভূষণ কানোনগোর গবেষণাপত্র।
Discussion about this post