একবার সৈয়দ শামসুল হককে একটা সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল মানব জীবনে ও সমাজে শিল্প-সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা কি। উনি তখন উত্তরে যা বলেছিলেন তা অনেকটা এরকম যে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু ব্যবহার করি যা শিল্প-সাহিত্যের অবদান। এই যে চমৎকার সব ডিজাইনের বাহারী জানালার পর্দা, সুন্দর সুন্দর বিছানার বেড কভার এসব চিত্র শিল্পীরা আকেঁ, সময়ের বিবর্তে এগুলো একসময় বাজারে চলে আসে, আমাদের নিত্য ব্যবহার্য হয়ে যায়। সাহিত্যের বেলায়ও সেরকম। এই যে আমরা গুছিয়ে কথা বলি, সুন্দর শব্দ চয়ন করি, ভাষার অলংকরণ করে নিজেদের ভাব, মতামত প্রকাশ করি। পণ্যের প্রচারে, বিজ্ঞাপনে মনকাড়া সংলাপ ব্যবহার করা হয়ু এসবই সৃজনশীল সাহিত্যের চর্চা ও পাঠের পরোক্ষ প্রকাশ ও ব্যবহার।
আমাদের ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনে শিল্প-সাহিত্যের প্রয়োজনীতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে লেখাটি শুরু করার কারণ হচ্ছে লেখালেখি সৃজনশীল কাজের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সঠিকভাবে, কার্যকর উপায়ে আমাদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছেনা। টেলিভিশনে মাঝে মাঝে সাহিত্য আলাচনার অনুষ্ঠানে বই পড়া নিয়ে কথাবর্তা হয়। সরকারের মুখপাত্র সরকারি টেলিভিশনে এসব অনুষ্ঠানে সাহিত্য চর্চা ও পাঠের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা যতটা না করা হয় তার চেয়ে বেশি এই বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তাব্যক্তিরা কে কী করছেন সেসব প্রসঙ্গই মুখ্য হয়ে ওঠে। �বই পড়ুন�, �বই উপহার দিন� জাতীয় সরকারের গৎবাঁধা বাণী এইসব নিরস, অকার্যকর আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসে। স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল আর ক�িস্লউটারের দৌরা�ে যেখানে ক্রমে বইয়ের পাঠক ও বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে, সেখানে এগুলোর সাথে বইয়ের কোনরকম তুলনা না করে বরং বই যে এগুলোর পরিপ�রক নয় মানুষকে তা বোঝানো দরকার। বিজ্ঞানের গবেষণা থেকেই আমরা জানি যে মানুষের মস্তিষ্কে বিপুল জ্ঞানের ভাণ্ডার যা সুপ্ত অবস্থায় থাকে, নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে সেই জ্ঞানের প্রস্ফুটন ঘটাতে হয়। চোখের সামনে মেলে ধরা একটি বই একজন মানুষকে কল্পনা ও চিন্তার যে বিশাল জগতে নিয়ে যেতে পারে, তাকে দিতে পারে অনাবিল আনন্দ অনুভব, নিজেকে, অন্য মানুষকে ও সমাজকে নিয়ে ভাববার উপায়। এ কাজটি টেলিভিশন অথবা ক�িস্লউটার পারে না। কারণ এগুলোতে মানুষের সামনে তার কল্পনা ও চিন্তা জগতের সর্বোচ্চ সম্ভব ব্যবহার করে ফেলা হয় শব্দ, সুর, ছবি, প্রতিবিম্ব ও জীবন্ত উপস্থাপনার মাধ্যমে সেখানে মানুষের চিন্তা করার, কল্পনা শক্তিকে কাজে লাগানোর সুযোগ কোথায়। কাজেই বই টেলিভিশন অথবা ক�িস্লউটারের বিকল্প নয়।
বই শুধু কাগজের উপর মুদ্রিত শব্দ বাক্যের ঝুড়ি নয়। বই হচ্ছে মানুষের কল্পনা ও চিন্তার বিশুদ্ধ প্রকাশ। অন্য সকল মাধ্যম হল অনেক তত্ব, তথ্য ও বিষয়ের সংমিশ্রন, কিন্তু বই হচ্ছে একক ও অকৃত্রিম। অন্য সব জ্ঞান অর্জনের ও আনন্দ পাওয়ার মাধ্যম যদি হয় এলোপ্যাথি তবে বই হলো হোমিওপ্যাথি, খাঁটি ও নির্জল। ধরা যাক কেউ �ভালবাসা� ব্যাপারটি কী সেটা বুঝতে চায়, তবে জানার ও বোঝার অনেক মাধ্যম আছে। কিন্তু শুধু কোন একটি ভাল বই বা একজন ভাল লেখক ভালবাসার যথার্থ বিশ্লেষণ করতে পারেন। যেমন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তার একটা প্রবন্ধে তিনি ভালবাসা বিষয়ে লিখেছেন, �প্রেম স�স্লর্কিত যে কোন তুচ্ছ বিষয়ও অসাধারণ হয়ে ওঠে। এই অসাধারণ হয়ে ওঠার ক্ষমতাটি প্রতিটি ব্যক্তির ভেতর লুকিয়ে থাকে। এবং সেটিই তার �সত্য পরিচয়�। এই সত্যটি অন্যজন আবিষ্কার করে, যে ভালবাসে। প্রত্যক্ষকে অতিক্রম করে কোন একজনের ভেতরের প�র্ণতাকে �স্লর্শ করার ক্ষমতাই হল ভালবাসা। যে ভালবাসে, অপরজনের ঐ প�র্ণতাকে অনুভব করতে পারে বলেই ভালবাসে। নিজেকে অতিক্রম করে সেখানে মিলতে পারাতে তার অসীম তৃপ্তি এব কোন তত্ব নয়, অনুভবের ঐ তৃপ্তিটাই তার কাছে পরম সত্য, সে তা বুঝাতে পারুক, আর নাই পারুক। কিন্তু ধন্য হয় সে, যে ভালবাসা পায় আর তুচ্ছ অস্তিত্বে সে সার্থকতার স্বাদ পায় সেখানেই।� কবি গুরুর ভালবাসা স�স্লর্কিত এই সহজ সাধারণ অথচ গভিড় অর্থময় বিশ্লেষণ যে কোন শিক্ষিত মানুষকে ভালবাসার গুঢ়ার্থ বুঝতে সাহায্য করবে, তার অনুভবকে, চিন্তার জগৎকে নাড়া দেবে যা অন্য কোন মাধ্যম পারবেনা।
আমাদের সমাজে পরিবারে, বাড়িতে বই পড়ার অভ্যেস এখন আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। এখন টেলিভিশন, সিডি, ডিভিডি, ক�িস্লউটার, মোবাইল এগুলো বাড়িতে বইয়ের স্থান দখল করে নিয়েছে। ক্যাবল টিভির চ্যানেলগুলোতে একের পর এক রঙচঙে অনুষ্ঠান সব বয়সের মানুষের অবসর কেড়ে নেয়। টেলিভিশন সত্যিই যেন এক যাদ�র বাক্স, আমাদের অবসর সন্ধ্যাগুলোয় প্রতিদিন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মত বাঁশি বাজিয়ে নেশাচ্ছন্ন করে রাখে। এই চরম নেশা থেকে মানুষকে বইয়ের মুখাপেক্ষী করানো সহজ নয়। সৈয়দ মুজতবা আলী�র যুগেও বই পড়ার ব্যাপারে নানান কারণে মানুষের অনাগ্রহ ছিল। তিনি মজা করে লিখে মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে তাদের অনাগ্রহগুলো দেখিয়েছেন এবং সেই সাথে জানিয়েছেন বই পড়ার নানা উপকারের কথা। এখন তিনি বেচেঁ থাকলে নিশ্চয়ই বাবা মাদের বিদ্রুপ করে লিখতেন যে তারা ছেলেমেয়েদের বিদেশী চকোলেট, ফাস্টফুড আর মোবাইল খরচের জন্যে হাজার হাজার টাকা নিয়মিত ব্যয় করলেও, একশ দু�শ টাকার বই কেনার জন্যে উৎসাহিত করেন না।
বিশ্বায়ন ও বাণিজ্যিকীকরনের এই যুগে সৃষ্টিশীল সাহিত্যও এখন পণ্য বনে যাচ্ছে। বিদেশী বহুজাতিক কো�স্লানি বা দেশীয় ব্যবসায়ীরা এখন নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করে আমাদের শিল্প, সাহিত্য, আমাদের সুকুমার কলা। ঈদ সংখ্যার ম্যাগাজিনে উপণ্যাসের প্রচ্ছদে কিংবা লেখার পাতায় পাতায় তেল কিংবা সাবানের বিজ্ঞাপন দেখে এখন আর অবাক হইনা। মাঝে মাঝে বিভ্রম হয় বিজ্ঞাপনের কোন ক্যাপশানও লেখাটির প্রচ্ছদের অংশ কিনা। সাহিত্যকর্ম, সে কবিতা, গল্প বা উপণ্যাস যাই হোক না কেন, তা মানুষের চরিত্রের বিচিত্রতা, জগতের বহুমাত্রিক জটিলতা, তার সময় ও সমাজের ম�ল্যবোঁধকে সৃজনশীলভাবে প্রকাশ করে। বিখ্যাত কবি ও সাধক জালালুদ্দিন রুমী তার একটি কবিতায় লিখেছিলেন :
�ও ধস ংড় ংসধষষ ও পধহ নধৎবষু নব ংববহ
ঐড়ি পধহ ঃযরং মৎবধঃ ষড়াব নব রহংরফব সব?
খড়ড়শ ধঃ ুড়ঁৎ বুবং, ঃযবু ধৎব ংসধষষ
ইঁঃ ঃযবু ংবব বহড়ৎসড়ঁং ঃযরহমং.�
বই হলো রুমীর চোখের মত, অতিা ক্ষুদ্র অথচ চারপাশের সবকিছুকে বৃহদাকারে দেখতে পায়।
বলা হয় সাহিত্য সমাজ বদলের হাতিয়ার। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে কথাটি অবশ্যই সত্যি। তাই সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে বেশি বেশি বই পড়া হলে আমরা আমাদের মানসিকতার উন্নয়ন ঘটাতে পারবো।
Discussion about this post