জাতীয় কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন দিয়ে শুরু করি আজকের বাস্তব চিত্র “বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর” কথাটি অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমানিত করেন এমন কিছু সফল নারীর গল্প নিয়ে এই লেখা ।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মেয়েদের মত কোন অংশে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের নারীরা। শুধু শহরের মেয়েরা নয় অজোঁপারা গাঁয়ের মেয়েরাও এখন এগিয়েছেন পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। জীবন সংগ্রামে পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলছেন। একই সাথে স্বামীর কাঁদে কাদ মিলিয়ে সমান অধিকারে নিজেকে সংসারের জন্য বিলিয়ে দিচ্ছেন। সংসারের পাশাপাশি সামাজিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রেখেছে সাফল্যের ছাপ। এ সাফল্য শুধু একটা জায়গায় সীমাবদ্ধ নয়। দেশে এবং বিদেশে উভয় জায়গাতেই সমান ভাবে সমাদৃত।
কুয়েতে আছে প্রায় সারে তিন লক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশী, এদের সবাই যে যার মত কাজ কর্ম ব্যবসা বানিজ্য নিয়ে প্রবাস জীবন অতিবাহিত করছেন। স্বপরিবারে অবস্থানরত প্রবাসীদের গৃহিনীরা স্বামী সংসার দেখার পাশাপাশি সংসারে আলাদা একটু স্বচ্ছলতা আনতে অথবা অবসর সময় কাটাতে কর্মজীবনে পা রাখেন। সাথী চৌধুরী, আমেনা আক্তার, সোনিয়া, স্মরণী, রুবিনা আতিয়াসহ আরো অসংখ্য কুয়েত প্রবাসী গৃহিনী কর্ম জীবন বেছে নিয়েছেন। সংসার দেখা, বাচ্চাদের মানুষ করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং উপস্থিত হন অনায়াসেই। কুয়েত প্রবাসী সাথী চৌধুরী এবং আমেনা আক্তার ও তাদের স্বামীদের সাথে কথা বলে জানা যায় পরিবর্তনের ইতিকথা। প্রতিবেদক মঈন উদ্দিন সরকার সুমন এক আলাপচারিতায় তুলে ধরেন কুয়েত প্রবাসী কিছু সফল নারীর গল্প ।
সাথী চৌধুরী ১৯৯৫ সালে স্বামীর সাথে কুয়েত আসেন দীর্ঘ পাঁচ বছর গৃহিনী হিসেবেই প্রবাস জীবন অতিবাহিত করেন। পাঁচ বছর পর দেশে বেড়াতে এসে কুয়েত যেতে অনিহা প্রকাশ করেন। স্বামী শওকত হোসেন চাকুরি করার প্রতিশ্রুতি দিলে আবার কুয়েত আসেন সেই থেকে কর্ম জীবন শুরু। ভাষা না জানা কোন কাজে অনভিজ্ঞ সাথী এখন একজন দক্ষ কর্মী। কুয়েতে সুনামধন্য কোম্পানি আল গানিম এর ফার্মাসিটিক্যাল ডিপার্টমেন্টে সহকারী ফার্মাসিষ্ট হিসেবে একমাত্র বাংলাদেশী মহিলা সাথী চৌধুরী কাজ করেছেন প্রায় ১০ বছর। ১০ বছরের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি অভিজ্ঞতার খাতায় যোগ করলেন ট্রাভেল এজেন্সি পরিচলনার কর্মদক্ষতা। বর্তমানে কেপিকো ট্রাভেল এজেন্সিতে কর্মরত আছেন। বড় মেয়ে কানাডায় উচ্চ শিক্ষার জন্য ওখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে ছোট ছেলে কুয়েতে অধ্যয়নরত। স্বামী সহ এক মেয়ে এক ছেলের ছোট্ট সংসার নিয়ে সুখেই আছেন।
আমেনা আক্তার রেনুর বেলায়ও এর বিপরীত ঘটেনি। আমেনা আক্তার রেনু ১৯৭৩ সালে চাঁদপুর জেলার মতলব থানার নব কলশ গ্রামের মোল্লা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম এম এ আওয়াল মাতা মরহুমা সুর্জাহান। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। সবে মাত্র হাইস্কুলে ভর্তি হন, সে সময় ঢাকা বড় ভাই সিরাজুল ইসলামের বাসায় চলে আসেন। ভাইয়ের বাসায় থাকা অবস্থায় পরিবারে পছন্দের পাত্র মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার দামলা গ্রামের মিয়া বাড়ির মরহুম আজহার মিয়ার ষষ্ঠ সন্তান একে এম আরিফ এর সাথে বিয়ে হয়।১৯৯০ সালে জুলাই মাসে স্বামীর সাথে কুয়েত প্রবাসীর খাতায় নাম লেখান, শুরু হয় জীবন যুদ্ধ। অনেকের মত শুধুমাত্র গৃহবধূর সারিতে থাকেননি। স্বামীকে সহযোগিতা করার কথা চিন্তা করে স্বামীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কর্মে যোগ দেন। একটি ক্লিনিং কোম্পানিতে দীর্ঘ এক বছর কাজ করার পর অন্যদের মত ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে কুয়েতে স্বনামধন্য আমেরিকানা ফুডস্টাফ কোম্পানি কেএফসিতে কুক সহকারী হিসেবে যোগ দেন। মিসরীয়, ইন্ডিয়ান ও ফিলিপিনোদের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করেন। সেই সময়কার কথা স্মরণ করে বলতে গিয়ে অশ্রুশিক্ত কণ্ঠে জানান কর্মজীবনের অনেক কষ্টের কথা। এরই মধ্যে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কিছুটা আরবি শিখেছিলেন আর ইংলিশ কিছুটা বুঝতে পারলেও উত্তর দেয়ার ক্ষমতা ছিল না তখন। ভাষাগত সমস্যার কারণে দায়িত্বরত সুপারভাইজার ও ম্যানেজারদের কাছ থেকে কটূক্তি শুনতে হয়েছে। পরবর্তীতে কঠোর পরিশ্রমী হওয়ায় কোম্পানির মালিক থেকে শুরু করে সুপারভাইজার, ম্যানেজার সবার কাছে পছন্দের কর্মী হয়ে ওঠেন। দুই বছর কাজ করার পর কোম্পানিতে স্থায়ী নিয়োগের সময় হলে আকামা পরিবর্তেনে সমস্যার কারণে ওই কোম্পানি নতুন করে ভিসা দেয়, সেই ভিসা নিয়ে কেএফসিতে যোগ দেন। এই কোম্পানিতে একমাত্র বাংলাদেশি নারী আমিনা যাকে কোম্পানি ভিসা দিয়ে নিয়ে আসেন। দীর্ঘ সময়ে কর্মজীবনে সৎ নিষ্ঠা আর কঠোর শ্রমের কারণে কোম্পানি কর্তৃক পেয়েছেন সম্মাননা। কোম্পানির সবার কাছে মামা আমিনা (মা আমিনা) উপাধি পান। বর্তমানে তাদের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছুটির দিনে তিনি কুয়েত প্রবাসীদের আয়োজিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। পহেলা বৈশাখসহ বিভিন্ন মেলায় নিজ তৈরি পিঠা পায়েস নিয়ে হাজির হন। সামাজিকভাবে স্বীকৃতি স্বরূপ অনেক সংগঠন থেকে পেয়েছেন পুরস্কার ও সম্মাননা। স্বামী আরিফ একটি কোম্পানিতে চাকুরি করছেন। তিনিও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত। তিনি নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করেন কারণ জীবন যুদ্ধে প্রত্যেকটা কাজে তাঁর স্ত্রীকে সাথে পেয়েছেন। স্ত্রীকে নিয়ে গর্ব করেন আরিফ।
কুয়েতে অনেকে স্বপরিবারে বসবাস করছেন। তাদের মধ্যে পুরুষের পাশাপাশি অনেক গৃহিনী কর্মজীবীর সারিতে দাঁড়িয়ে রেমিটেন্স যোদ্ধার খাতায় নাম লিপিবদ্ধ করেছেন। বর্তমান যুগে পুরুষ শাসিত সমাজ বলে যারা অপবাদ দেয় এবং নারীদের ক্ষমতায়ন নিয়ে যখন সবাই চিন্তিত তখন সাথী ও আমিনা, সোনিয়া, স্মরণী, রুবিনার মত অনেক নারী দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায় এই সমাজে। জাতীয় কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন “বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর” কথাটি অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমানিত করেন এমন কিছু নারী।
প্রতিবেদক সাংবাদিক মঈন উদ্দিন সরকার সুমন কুয়েত থেকে।
Discussion about this post