ছোটবেলা থেকেই বিসিএসের প্রতি ছিল এক অন্যরকম এক আকর্ষণ। যখন গ্রাম থেকে শহরে বিভিন্ন প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিতে যেতাম, তখন সেখানে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটদের ক্ষমতা দেখে ভীষণ ভালো লাগতো। অনুপ্রাণিত হতাম। ভাবতাম আমিও একদিন তাদের মতো হবো। সম্মান-শ্রদ্ধায় আমাকে ঘিরে থাকবে সবাই।’ এভাবেই বিসিএস নিয়ে নিজের লালিত স্বপ্নের কথা বলছিলেন মোহাম্মদ রকিব উদ্দিন ভূইয়া। তিনি তার সে স্বপ্নকে ছুঁয়েছেন। হয়েছেন সফল। ২৮তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে মেধা তালিকায় দশম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। স্বপ্ন বাস্তব হওয়ার যে সুখ তা তিনি পেয়েছেন । মেধাবী হিসেবে পরিচিত রকিব শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই ভাল ফলাফল করেছেন। অষ্টম শ্রেণিতে পেয়েছেন বৃত্তি, এসএসসি, এইচএসসিতে করেছেন বোর্ড স্ট্যান্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় হয়েছেন অষ্টম। বিশ্ববিদ্যালয়েও অব্যাহত রেখেছেন ভালো ফলাফলের ধারা। হয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের শিক্ষক। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ বার্মিংহাম থেকে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং এন্ড ফিনান্সে করেছেন মাস্টার্স। মাত্র ৩১ বছর বয়সে হয়েছেন বিভাগের চেয়ারম্যান। কিন্তু কেন রকিব লাখো শিক্ষার্থীর স্বপ্নের চাকুরি ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে যোগ দিলেন? কেনইবা স্বপ্নের এত কাছাকাছি গিয়েও ফিরে এলেন? প্রচারবিমুখ স্বল্পভাষী মানুষটি সেই গল্পই শুনিয়েছেন আমাদেরকে। দেশের তরুণ সমাজের জন্যও দিয়েছেন দিকনির্দেশনা।
ছোট থেকেই লেখাপড়ায় মনোযোগী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে রকিব। বাণিজ্য বিভাগ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার খাড়েরা মোহাম্মদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে কুমিল্লা বোর্ডে সপ্তম হন।
শিক্ষক পিতা মো: আব্দুল হাই ভূইয়ার আদর্শে বেড়ে ওঠা রকিবের জীবনে তার পরের অধ্যায়টা ছিলো বেশ চ্যালেঞ্জিং। গ্রামের স্কুল থেকে এসে ভর্তি হন ঢাকা কমার্স কলেজে। সে সময় রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে নানা জল্পনা-কল্পনা ছিল তার মনে। ভাবতেন ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী হওয়ায় সেখানে সব ক্ষেত্রে থাকবে কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা। আর তাই পাঁচ ভাই ও ১ বোনের সাথে গ্রামীণ খোলা পরিবেশে বেড়ে ওঠা রকিবের ঢাকা কমার্স কলেজের কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার মাঝে খাপ খাওয়াতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি।
উচ্চ মাধ্যমিকে ঢাকা বোর্ড থেকে বাণিজ্য বিভাগে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন তিনি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমে স্নাতক ও ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। একাডেমিক পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়াতে শুরু থেকেই ছিলেন প্রথম দিকে।
স্নাতক চতুর্থ বর্ষে পড়ার সমেই জারি হয় ২৮তম বিসিএসের প্রজ্ঞাপণ। সে সময় চারপাশে শুরু হয় বিসিএস রব। হল থেকে শুরু করে, রিডিং রুম, লাইব্রেরি সব জায়গাতেই ছিল এক আলোচনা। আর সেই সঙ্গে নিজের ভেতর লালিত স্বপ্নকে ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষা। অ্যাপিয়ার্ড দিয়ে বিসিএসে অংশ নেন রকিব। স্বপ্নের এ পরীক্ষায় লাখ লাখ পরীক্ষার্থীকে পেছনে ফেলে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হন বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে।
পুলিশে দশম স্থান অধিকার করেন তিনি। তবে বিসিএসে চূড়ান্ত ফল প্রকাশের মাস পাঁচেক আগেই নিয়োগ পান দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক পদে। ২০১০ সালে নিয়োগ পাওয়া রকিব বর্তমানে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন সহযোগি অধ্যাপক।
বিসিএসের ফল প্রকাশের পরের দিনগুলোর কথা এখনো মনে পড়ে মেধাবী রকিবের। আত্মীয়-অনাত্মীয় অজস্র মানুষের ফোন তিনি পেয়েছেন সেসময়। খানিকটা দুঃখ প্রকাশ করে রকিব বলেন: ‘সেসময় পরিচিত-অপরিচিত এত মানুষ ফোন করতো যাদের আমি ঠিকমত চিনতামও না। অনেকেই তখন আমার আত্মীয় হয়ে যায়। খোঁজ খবর নিতে থাকে নিয়মিত। তবে চাকুরি ছেড়ে আসার পর আর কারও ফোন পাইনি।’
বিসিএসের ফল প্রকাশের পর থেকেই বেশ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকেন তিনি। সেসময় কী করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এর মাঝেই অনেকটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে থেকেই রিজাইন দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদ থেকে।
যোগ দেন বাংলাদেশ পুলিশে। সেখানে ওরিয়েন্টেশনের সময়টা বেশ উপভোগ করলেও ভুগছিলেন সিদ্ধান্তহীনতায়। নির্ধারণ করতে পারছিলেন না বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে থাকবেন নাকি শিক্ষকতায় ফিরবেন। এ নিয়ে বেশ কঠিন সময় পার করতে হয়েছে তাকে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে পরিবার থেকেওে সেসময় শিক্ষকতা পেশায় ফিরে যাবার তাগিদ দেয়া হচ্ছিল। জীবনের সেই সময়টাকে বেশ কঠিন বলে উল্লেখ করেন রকিব।
বাংলাদেশে মৌলিক অধিকার বঞ্চিত মানুষদের নিয়ে কাজ করতে চাওয়া রকিব চাইতেন মাঠ পর্যায়ে থেকে সরাসরি মানুষের উপকার করতে। তবে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকেই শিক্ষকতার প্রতি সৃষ্টি হয় অনুরাগ।
তার ভাষায়: শিক্ষক হিসেবে আমি হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে মোটিভেট করতে পারি। তাদের চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করতে পারি। সৎ নিষ্ঠাবান হয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা করতে পারি’।
এ ভাবনা থেকেই রকিবের বিসিএস পুলিশ ক্যাডার থেকে রিজাইন দিয়ে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়া।
প্রতিবছর বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবার বিষয়ে বেশ আপত্তি এ শিক্ষকের। তার মতে বিসিএস পরীক্ষা প্রতি ৩-৪ বছর অন্তর অন্তর হওয়া দরকার। আর তা না হলে শিক্ষার্থীরা একাডেমিক পড়াশুনার দিকে মনোযোগি না হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছর থেকেই শুরু করছে বিসিএসের পড়াশুনা। তাদের পরিপূর্ণ মনোযোগ থাকছে বিসিএসের দিকে। এ কারণে শিক্ষার্থীদের ফোকাসটা অন্যদিকে নেয়া যাচ্ছে না। একাডেমিক পড়াশুনার সাথে শিক্ষার্থীদের এ দূরত্বকে জাতির জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করছেন তিনি।
নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন: দেশপ্রেম, নিজের উন্নয়ন, নিজের মধ্যে বড় কিছু করার প্রবণতা, পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন, ভাল কিছু করার আকাঙ্ক্ষা এগুলো যখন আমরা নিজের ভেতরে ধারণ করতে পারবো তখনই অামরা প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারবো। সফল হতে পারবো।
রাকিব মনে করেন, একাডেমিক পড়াশুনা ভালোভাবে করলেও বিসিএস ক্যাডার হওয়া সম্ভব।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস স্টাডিজের এই চেয়ারম্যানের স্বপ্ন দেশকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সে লক্ষ্য সামনে রেখেই কাজ করতে চান তিনি।
মেধাবী এ তরুণ শিক্ষক মনে করেন, প্রত্যেকটা মানুষই মেধাবী। তবে সফলতার জন্য হতে হবে অনেক বেশি কৌশলী। করতে হবে চর্চা। দুর্বলতার বিষয়গুলোকে কাটিয়ে উঠতে হবে। তাহলেই সম্ভব সফলতা।
Discussion about this post