তৈয়বুর রহমান টনি নিউ ইয়র্কঃ- চল্লিশ বছরের প্রবাস জীবনে কারো জন্য ভালোবাসার এমন ফল্গুধারা বর্ষিত হতে দেখেননি নিউ ইয়র্কের অনেক বর্ষীয়ান প্রবাসী। এমনকি২০/২৫ বছরের একটানা এই লোকালয়ে জীবনযাপনের ইতিহাসেও অনেকেই কখনো দেখেননি একজন মানুষকেঘিরে এভাবে প্রধান প্রধান সাংস্কৃতিক সংগঠনকে এক হয়ে এমন অসাধারণ কিছু করতে।
বাংলাদেশ টেলিভিশন এর প্রাক্তন কর্মকর্তা এবং বর্তমানে নিউ ইয়র্ক প্রবাসী শেখ রিয়াজউদ্দিন বাদশাহ এই প্রতিনিধিকে বলেন, আমার সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে জড়িত জীবনে ঢাকাতেও কখনো এতো অসাধারণ ভালোবাসার নিবেদন দেখিনি। আমার পরম সৌভাগ্য এমন একটি ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরেছি। কবি শহীদ কাদরীকে অংশগ্রহণকারী সবগুলো সংগঠনের নামসহ যে বিশেষ ক্রেস্ট উপহার দেয়া হয়েছে সেটিও অনেকের কাছে পরম বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল।
শিল্পী জাহেদ শরীফের হাতে নির্মিত এই ক্রেস্টকবি নিজেও খুব পছন্দ করেছেন। কবিকে তাঁর সম্প্রতি অতিক্রান্ত ৭১তম জন্মদিনের রেশ ধরে ৭১টি গোলাপ দেন বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা। কিন্তু সত্যি বলতে মিলনায়তন ভর্তি প্রতিটি মানুষতাঁদের হৃদয় ভরা ভালোবাসা নিবেদন করতেই সেখানে সমবেত হন।একুশে পদকপ্রাপ্ত, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই কবিকে সংবর্ধনা দিয়ে মূলত সংবর্ধিত হলেন নিউইয়র্কের প্রবাসী বাংলাদেশিরা। জ্যাকসন হাইটসের পিএস-৬৯ মিলনায়তনে রোববার সন্ধ্যায় উপস্থিত প্রতিটি মানুষই ছিলেন শ্রদ্ধাবনত। গোছানো পরিবেশনার প্রায় পুরোটা সময় দর্শক সারিতে মুগ্ধ হয়ে বসেছিলেন শহীদ কাদরী। আর মঞ্চের মধ্যমনি হয়ে তিনি সিক্ত হলেন ফুলেল শুভেচ্ছায়। সর্বজনীন এই আয়োজনে উপস্থিত সর্বস্তরের মানুষ ও সংগঠনের পক্ষ থেকেও ছিলো ফুলেল শুভেচ্ছা। অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্রে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ২৫টি সংগঠন।
সূচনায় আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে প্রার্থনা সঙ্গীতের মাধ্যমে এক ঝাঁক শিল্পী অনুষ্ঠানে আনন্দের আবহ সৃষ্টি করেন। এরপর সর্বজনীন এই সংবর্ধনার আহ্বায়ক ড . ওয়ালিদ চৌধুরী সূচনা বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, কবিকে সংবর্ধনা জানাতে গিয়ে যেনো আমরা নিজেরাই সংবর্ধিত হচ্ছি। কবি শহীদ কাদরীকে একটি চিত্রপটে তুলে ধরে মিনহাজ আহমেদের লেখা জীবনালেখ্য পাঠ করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত নাট্যব্যক্তিত্ব জামাল উদ্দিন হোসেন।
কাব্য আর সাহিত্যের দ্যোতনা ছিলো সে উপস্থাপনায়। নিয়তির বিরুদ্ধে আজন্ম লড়াকু এ কবির দীর্ঘ সুস্থ্য জীবনের কামনায় শেষ হয় কবিবন্দনা। অনুষ্ঠানে এনায়েত করিম বাবুল ধারণকৃত একটি প্রমাণ্য চলচ্চিত্র পরিবেশন করেন। এতে কবি তার নিজের জীবন, কবিতা, স্বদেশ ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। নিউইয়র্কের হাডসন নদীর তীরে পেছনে আলো ঝলমলে ম্যানহাটান, মাথার ওপর মেঘের গুড়গুড় শব্দ আর শন শন বাতাসের সেই প্রাকৃতিক পরিবেশেই কবির কাব্য বিশ্লেষণ যেমন ছিলো, কবিতা লেখার গোড়ার দিকগুলোও তিনি জানালেন এই ভিডিও চিত্রে।
কাব্যে রোমান্টিকতার ব্যবহারকে রবীন্দনাথ আর বুদ্ধদেবের কবিতার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেন। নিজেকে নাগরিক কবি হিসেবে মেনে নিয়েই কবি বলেন, যুগে যুগে দেখা গেছে সব বড় কবিই নাগরিক কবি। হাডসন তীরে ধারণকৃত এই ভিডিও চিত্রেই কবির আবৃতি করেন আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও, সেটিও ছিলো এই প্রামাণ্য ভিডিওতে। জীবনীপাঠ ও ভিডিও প্রদর্শনীর পরপর হুইল চেয়ারেমঞ্চে নিয়ে আসা হয় কবি শহীদ কাদরী ও কবি-পত্নী নীরা কাদরীকে।ফুলেল শুভেচ্ছা, উত্তরীয় উপহার আর ক্রেস্ট হাতে নেওয়ার পর হলো কবির জন্ম দিনের কেককাটা। এরপর শুরু হলোকবির আত্মকথন। তিনি কৃতজ্ঞতা জানালেন, বললেন এখানে সবাইকে একসঙ্গে কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ পাইনা। এই সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আয়োজকদেরও বিশেষ ধন্যবাদ জানান কবি।
দ্রুতইকবিতার প্রসঙ্গে ঢুকে পড়লেন। ‘কবি’ শিরোনামে লেখা নিজের কবিতাটি পড়ে শোনানোর আগে বললেন, কবি হিসেবে কি অনুভব করি তা রয়েছে এই কবিতায়। ‘কোনো নির্বাসনই কাম্য নয়’ শিরোনামে কবিতা পড়ে করি সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন দেশ ছেড়ে এই প্রবাসে তার দীর্ঘজীবন সুখের নয়। দেশের মাটি মানুষের কাছেই তিনি যেতে চান।তিনি কোনো নির্বাসন চান না।
কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে শেষ হয় প্রথমপর্বের অনুষ্ঠান। এই অংশে অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন সাপ্তাহিক বাঙালীর সম্পাদক, সুচারু সঞ্চালক কৌশিক আহমেদ। ধারাবাহিকভাবে কোন বিরতি ছাড়াই দ্বিতীয় পর্বে সেমন্তী ওয়াহেদের সঞ্চালনায় শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।শব্দে সুরে আর নৃত্যছন্দে কবি শহীদ কাদরীর জন্য এই নিবেদনে কবির পছন্দেরই প্রাধান্য রয়েছে বলে জানান সেমন্তী। প্রথমেই নিউইয়র্কে জনপ্রিয় শিল্পী কাবেরী দাসের নেতৃত্বে দলগত পরিবেশনা- শুভ্র সমুজ্জ্বল হে চির নির্মল, তারপরই হোসেন শাহরিয়ার তৈমুর পড়ে শোনালেন কবির কবিতা বিব্রত সংলাপ।
আনন্দধারা বহিছে ভূবনে গানের সঙ্গে পরিবেশিত হলো নাচ, ক্লারা রোজারিও পড়লেনএকটি আংটির মতো তোমাকে পড়েছি স্বদেশ, আমার কনিষ্ঠ আঙ্গুলে। আবার রবীন্দ্রসঙ্গীতের দলগত পরিবেশনা আকাশভরা সূর্য তারা। মিজানুর রহমান শোনালেন কবিতা।ফের দলীয় নাচ নীল অঞ্জন ঘন পুঞ্জ ছায়ায়। পরপরই দলগত গণসঙ্গীতওরে বিষম দইরার ঢেউ। তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা কবিতাটি আবৃতি করলেন মিথুন আহমদ। এরপর আবৃতি করে শোনালেন মুমু আনসারী। রথীন্দ্রনাথ রায় ও রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার কণ্ঠে গান পরিবেশনা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানকে করে তোলে আরও প্রাণবন্ত। কবি শহীদ কাদরীর প্রতি শ্র্রদ্ধা জানিয়েরথীন্দ্রনাথ রায় গাইলেনআমি আশা করে আছি গো দয়াল, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা গাইলেন তোমায় গান শোনাবো, ওগো দুঃখ জাগানিয়া।
গানটি পরিবেশনার আগেই বন্যা বলেন, কবির এই সংবর্ধনায় গান গাইতে পেরে তিনি নিজেকে সম্মানিত বোধ করছেন। সংবর্ধনা কমিটির সদস্য সচিব মোশাররফ হোসেন সমাপনী বক্তব্যে বললেন, সকল শ্রদ্ধা ঢেলেই তারা চেষ্টা করেছেন এই আয়োজনটি সফল করতে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
সমাপনী বক্তব্যের পরপরই সমাপনী সঙ্গীত ‘আগুনের পরশমনি’ গাইলেন অংশগ্রহণকারী সকল শিল্পী। কবিকে ভালোবাসা জানাতে বেশ কিছু বিদেশী ভক্তও আসেন এবং তারা কবিকে ফুল দিয়ে, তাঁর সাথে করমর্দন করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। অনুষ্ঠানে একটি ছোট্ট অথচ তথ্যবহুলএকটি স্মারক প্রকাশিত হয়।ছবিগুলো তুলেছেন নিহার সিদ্দিকি, সহযোগিতায় আঃ হাঃ কিরন।
Discussion about this post