মোস্তফা কাজল: মোবাইল ফোন ও লোহাজাতীয় ধাতু ব্যবহারের কারণে বাড়ছে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা। দেশে গত দুই মাসে বজ পাতে মারা গেছেন ১০৪ জন। আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক। বাংলাদেশের ইতিহাসে ৪০ বছরে এপ্রিল ও চলতি মে এ দুই মাসে সবচেয়ে বেশি বজ পাতের ঘটনা ঘটেছে। বিনা মেঘেও হচ্ছে বজ পাত। দেশে বজ পাত ও বজ সহ বৃষ্টিপাত প্রকৃতির আপন নিয়মে নতুন কিছু নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর ব্যাপকতার কারণে ভয়াবহতা নিয়ে দুর্যোগটি আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এর কারণ হিসেবে বলছেন, বজ পাত সংঘটিত হলে মোবাইল ফোন ও লোহাজাতীয় ধাতু ব্যবহারকারীদের আগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় যেসব ব্যক্তি বজ পাতে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে মোবাইল ফোন ও লোহাজাতীয় ধাতু ব্যবহারের কারণে মারা গেছেন বেশি। আবহাওয়া অধিদফতরের এক জরিপে দেখা গেছে, যারা বজ পাতের শিকার হয়েছেন তাদের মৃত্যুর ধরন প্রায় এক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধিদফতরের জ্যৈষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. সাদেকুল আলম বলেন, মোবাইল ফোন ও লোহাজাতীয় ধাতু ব্যবহারকারী বজ পাতের সময় অন্যদের তুলনায় আগে আক্রান্তের শিকার হন। কারণ যে ধাতু দিয়ে মোবাইল ফোন তৈরি করা হয়, তা বজ পাতকে দ্রুত আকর্ষণ করে। অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ও চলতি মাসে যেসব ব্যক্তি বজ পাতে মৃত্যুর শিকার হন তাদের প্রায় সবই মোবাইল ব্যবহার করতেন। এর মধ্যে বজ পাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ২৩ মে। এদিন দেশের চার জেলায় মোট ৩৫ জন মারা যান। এ ছাড়া ৪ এপ্রিল নাটোর, চট্টগ্রাম ও ভোলায় মারা যান ৬ জন। এর মধ্যে নাটোরে মারা যান মফিজ ও কালাম নামের দুই যুবক। কালামের পকেট থেকে উদ্ধার করা হয় জ্বলে যাওয়া মোবাইল ফোন সেট। ১০ এপ্রিল কিশোরগঞ্জ ও হবিগঞ্জে মারা যান ৭ জন। এদের মধ্যে হবিগঞ্জে মারা যান রহমান, শফি ও বাছেদ। বাছেদ ও শফির কাছ থেকে দুটি পুড়ে যাওয়া মোবাইল ফোন সেট উদ্ধার করা হয়। ২৬ এপ্রিল বরগুনা, বাগেরহাট, সাতীরা ও দিনাজপুরে মারা যান ১১ জন। ১৮ মে ময়মনসিংহ, জামালপুর ও শেরপুরে পাঁচজন। ২১ মে নোয়াখালী, ফেনী ও চাঁদপুরে সাতজন। মৃত্যুর পর এদের প্রায় প্রত্যেকের কাছ থেকেই পুড়ে যাওয়া মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ ২৭ মে দেশের বিভিন্ন জেলায় মারা যান ১১ জন। এদের চারজন একই পরিবারের সদস্য। তারা বৃষ্টির সময় সেচপাম্পের ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেচপাম্পের মেটালের আকর্ষণে তারা বজ পাতের শিকার হন। সেচপাম্পটিও ভস্মীভূত হয়।
অবিরাম খরা ও তাপপ্রবাহের কারণে ভাপসা গরম বায়ুমণ্ডলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সাগর ও ভূপৃষ্ঠে তাপমাত্রা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি এবং পরিবেশ-প্রতিবেশের অব্যাহত দূষণ বজ পাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আবহাওয়া অধিদফতরের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস তালিকায় নতুন যুক্ত করা হয়েছে বজ ঝড়। এ সম্পর্কে সতর্কও করা হচ্ছে। যদিও চীন, জাপান, মালয়েশিয়ার মতো বাংলাদেশে বজ পাত ও বজ ঝড়ের তাৎণিকভাবে পূর্বাভাস প্রদান করা সম্ভব হয় না। বজ পাত রুটিন দুর্যোগের তালিকায় এখনো লিপিবদ্ধ না হলেও একাধিক আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বৈশিষ্ট্য নিয়েই বৃদ্ধি পাচ্ছে বজ পাতের প্রবণতা। একই সঙ্গে কালবৈশাখী, টর্নেডো ও বজ ঝড়ও বেড়ে চলেছে। এ থেকে বাঁচার উপায় হলো সচেতনতা। সরকারও পারে আগাম সতর্কতামূলক কোনো ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু যেসব আধুনিক যন্ত্রপাতি এ জন্য প্রয়োজন, তা বাংলাদেশে নেই। তবে এসব যন্ত্রপাতি অত্যান্ত ব্যয়বহুল।
বছর বছর বজ পাতের হার ও তীব্রতা বেড়ে চলেছে। চলতি বছরের এপ্রিল-মে দুই মাসের প্রায় প্রতিদিনই তার প্রচন্ড শক্তি নিয়ে দেশের কোথাও না কোথাও বজ পাত সংঘটিত হয়েছে। এখনো তা অব্যাহত আছে। বজ্র পাতে হতাহত হচ্ছে বিশেষত গ্রামাঞ্চলের মানুষ। এদের মধ্যে পথচারী, দিনমজুর, জেলে, মাঝিমাল্লা, কৃষাণ-কৃষাণির সংখ্যাই বেশি। গবাদিপশুরও য়তি হচ্ছে যথেষ্ট। এসব বিষয় বিবেচনায় আবহাওয়াবিদেরা মনে করেন, আগাম সতর্কতামূলক যন্ত্রপাতির দাম যত বেশিই হোক, সরকারের উচিত বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এর ব্যবস্থা রাখা।
Discussion about this post