মোঃ হাবিবুর রহমান, কুমিল্লা প্রতিনিধি: বাঙালির প্রাণের উৎসব নববর্ষ। কুমিল্লা সেজেছে নতুন রঙে। গতকাল শনিবার কুমিল্লায় উদ্দীপনার বিপুল তরঙ্গে এ উৎসব উদযাপিত হয়। সকল স্তরের সকল বয়সের, সকল ধর্মের, সকল গোছের এবং শ্রেণীর, উচ্চ বিত্ত, বিত্তহীন বাঙালি মাত্রই এ দিনটিকে পালন করেছে যার যার অবস্থান থেকে। নববর্ষ উদযাপনে বাঙালির এতো স্বত:স্ফূর্ততা আর কোনো উৎসবে দেখা যায় না। এটা যেনো প্রাণের উচ্ছল আবেগ যেনো সোঁদা মাটির গন্ধমাখা নানা উপাচার লোকাচার ও লাকবিশ্বাস। চির ব্যথিত, অবহেলিত বাঙালির কন্ঠে- ‘দুঃখ আছে, দৈন্য আছে, মহামারী ঝড় তুফান; তবু এ দেশ আমার প্রিয়, দেশের মাটি আমার প্রাণ’। পুরনো স্মৃতি আর সকল প্রকার জরা-জীর্ণতাকে দূরে ঠেলে নতুনত্বের স্বপ্ন আশায় সুখী, সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বাঙালি জাতি ১৪১৮ বঙ্গাবন্ধকে বিদায় জানিয়ে ১৪১৯ বঙ্গাব্ধকে স্বাগত জানিয়ে বরণ করে নিয়েছেন। নববর্ষে আনন্দে উজ্জ্বীবিত হয়ে তরুণ-তরুণীরা সেজেছে নতুন সাজে। পড়েছে ধোপ-ধোরস্ত জামা-কাপড়। কেউ কেউ পরেছে বৈশাখী পোষাক। কুমিল্লা জেলা নগরীরসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে দিবসটি উৎসব আনন্দের মধ্য দিয়ে পালন করেছে। দিবসটিতে পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ, শুটকি ভর্তা, চীড়া, দই, খই এবং নানা প্রকার তরকারী পরিবেশন, বর্ণাঢ্য র্যালি ও আলোচনা সভা। সামাজিক প্রথা হিসেবে বাংলার নগর গ্রাম গ্রামান্তরে নানা কর্মসূচি নানা কর্মযজ্ঞের আয়োজন হয়। ভালো খাওয়া, ভালো পরা, মেলা, নৌকা বাইচ, বলীখেলা, গরুর লড়াই, মোরগ লড়াই, কবিগান যাত্রা গান এরকম আরো অনেক রকম আয়োজন দীর্ঘদিন ধরে থাকলেও বর্তমানে তা বিলীন হয়ে গেছে। নগর জীবনেও ঘটেছে অনেক কর্মসূচির জমজমাট আসর নৃত্যসঙ্গীত, শোভাযাত্রা, নানা আচার অনুষ্ঠান। কুমিল্লাতে বিভিন্ন সংগঠন পালন করেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। বিশেষ করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, পৌরপার্কের জামতলা ও ধর্মসাগরপাড় মহিলা কলেজে, জেলা প্রশাসন, শিশু একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, কুমিল্লা ক্লাব, স্টেশন ক্লাব, কুমিল্লা প্রেস ক্লাব, জেলা ছাত্রলীগ, কচিকাঁচার মেলা, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ কর্মসূচি পালন করেছেন। পুরনো বছর বিদায় জানিয়ে নতুন বছর বরণ করে নিতে কুমিল্লায় ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি উৎযাপন করা হয়েছে। নগরীর ধর্মসাগর পাক, শিশু পাক, ঢুলিপাড়া ইকোপার্ক, চিড়িয়াখানা, শালবন বিহার, কোটবাড়ী, কান্দিরপাড় টাউন হল মেলা, ইপিজেড রোডসহ নগরীর আনাচে কানাচে বষবর্ণের মানুষের ঢল। এতে বেশি লক্ষ্য করা গেছে তরুণ তরুণীরা নতুন পোশাকে সজ্জিত হয়ে কাঁদে কাঁদ রেখে দিবসটি উৎযাপন করেছেন। পার্কে মাটির সানকিতে বিক্রি হচ্ছে পান্তা-ইলিশ। অনেকে দুহাতে পণ্য নিয়ে ফেরি করছেন মুখরোচক খাবার। বর্ষ বরণে তরুন তরুণীদেরকেই বেশি উৎফুল্ল দেখা গেছে। নতুন সাজে তারা সেজেছে। প্রেমিক প্রেমিকরা এক সাথে রিক্সা, অটোবাইক, সিএনজি, মোটর সাইকেল চড়ে এক প্রান্ত থেকে আন্তে জমাট বেঁেধেছেন। গতকাল শনিবার সকাল থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত পৌর পার্ক, ধর্মসাগরপাড়, চিড়িয়াখানা, ইকোপার্কে গিয়ে দেখা গেছে শিশু কিশোর, যুবক যুবতী, প্রেমিক প্রেমিকা, স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা নিজেদেরকে ভিন্নভাবে সাজিয়ে তুলেছেন। তাদের মধ্যে নেই বিন্দু মাত্র ক্ষোভ, শুধু আনন্দ আর ভালোবাসা দিয়ে দিবসটি উৎযাপন করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে সেজেছে নতুন রূপে। বিভিন্ন পার্কে মানুষের জায়গা দেওয়ার ঠাই নেই বিন্দু মাত্র। গতকাল শনিবার কুমিল্লা টাউন হল মাঠে বৈশাখী মেলাতেও শিশু কিশোর, যুবক, যুবতী বয়স্করা তাদের বাচ্চা নিয়ে কেনা কাটা করতে ও ঘুরাফেরার জন্য নিয়ে এসেছেন। শিশুরা মেলাতে কেনা কাটার ধুম পড়ে। মাটির ব্যাংক, মাটির, বিভিন্ন পশু পাখি, মাটির হাড়ি, মাটির কলস, মাটির ফুলদানিসহ গহনা, খেলনা, ছোটদের পোশাক, বই, বাঙি, তরমুজ, শরবত, আইসক্রিম, কোমল পানীয়, খনিজ পানি, চিপস, মুখোশ, হাতপাখাসহ নানান পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন টাউন হলের মেলার দোকানিরা। তবে দাম একটু চড়াও। মাটির জিনিসের দামও পকট। তারপরও পহেলা বৈশাখীর দিনে কারও চোখে পানি পড়–ন তা কেহই চায় না। ফলে যত দামই হোক না কেন সন্তানদের চাহিদা পূরণে অভিভাবকরা ক্রয় করছেন। নগরীর বিভিন্ন আনাচে কানাচে অলিতে গলিতে পাস্তা ভাত-ইলিশ বিক্রি করেছে। তরুন তরুণীদের উদ্বুদ্ধ করতেই তাদের এই আয়োজন। শনিবার সকাল থেকেই বৈশাখী সাজে হাজারো মানুষের ভিড়, আনন্দোচ্ছ্বাস আর কোলাহলে মুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। বেলা বাড়তেই গান, নাচ, আবৃত্তিসহ নানা আয়োজনে জমে ওঠে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। নগরীর প্রতিটি হোটেলে রয়েছে বৈশাখী আয়োজন। বছরে অন্যান্য দিনের চেয়ে এবার বিভিন্ন হোটেল ও রেস্তোরায় বিভিন্ন আয়োজনে খাবারের নামের তালিকায় থাকছে বাঙালির ঐতিহত্যবাহী বিভিন্ন খাবার। হোটেল ও ফাস্টফুড দোকানগুলোতেও প্রেমিক প্রেমিকা ও যুবক যুবতীদের ঢল লক্ষ্য করা গেছে। দাঁড়ানোর মতো বিন্দুমাত্র ঠাই নেই। নতুন বছরকে উপলক্ষে করে নতুন জামা কাপড়ের পাশাপাশি হরেক রকম বাঙালি খাবারের আয়োজন হয়েছে প্রতিটি ঘরে ঘরে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে কুমিল্লা ধর্ম সাগর পাড়, শিশু পার্ক, ইকোপার্ক, কোটবাড়ী শালবন বিহারে অতিথিদের আপ্যায়নে জন্য ১৫টি ভিন্ন স্বাদের ভর্তা, শাক, মাছ, শুটকি, গরুর মাংস ভুনা ও কারী, মুরগীর মাংস, মৌসুমী সবজি, আচার-কাসুন্দি, ভিন্ন স্বাদের গ্রামীণ মিষ্টি-পিঠাসহ ৭০ রকমের দেশীয় খাবারের বুফে মেনু করে সাজিয়ে বিক্রি করা হয়েছে। এছাড়া বাঙালির বৈশাখের অন্যতম অনুসঙ্গ পান্তা-ইলিশ তো আছেই। এছাড়া নগরীর প্রতিটি স্কুল ও কলেজে পাড়া মহল্লার যুবকদের আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়েছে পান্তা-ভাত ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এদের মধ্যে দক্ষিণ চর্থা বড় পুকুর পাড় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, হোচ্ছামিয়া স্কুলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্থানীয়দের উদ্যোগে খাবার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছেলে মেয়েদের আলপনা একে দিতে যুবকরা এ উদ্যোগ নিয়েছে। নগরীর স্থানীয় দোকানদাররা দই, রসমলাই, মলাইকারি, বিভিন্ন রকমের মিষ্টি, অমৃতি আর জিলাপি, দুধের শরবত, মালাইচপ, পেড়া, সন্দেস, জাফরান লাডু, মাওয়া লাডু, কাঁচাগোল্লা, স্পেশাল দই, সাদা চমচম আর ঐতিহ্যবাহী রসমলাইয়ের পজ্জা বসিয়েছেন। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে কুমিল্লার ফাস্ট ফুড ও রেস্টুরেন্টগুলোকে ফুল, ফেস্টুন, ব্যানার দিয়ে সেজেছে। নববর্ষের দিন ফাস্ট ফুড ও রেস্টুরেন্টগুলোতে পান্তা-ইলিশ, বাংলা খাবার, ব্ল্যাক ও পানীয় জাতীয় খাবার বিক্রি করা হচ্ছে।
Discussion about this post