মোঃ আলী আজম
উত্তাল,অগ্নিঝরা ইত্যাদি বিশেষণে বিভূষিত বাঙ্গালির মার্চ, বাংলাদেশের মার্চ। স্মরনাতীত কাল থেকে বিজাতীয়,বিদেশী শাসন শোষণে নিষ্পেষিত গাঙ্গেয় বদ্বীপের ভাটি জনপদের জেগে উঠার মাহেন্দ্রক্ষণ এই মার্চ মাস; আরও সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে বলতে হয় ১৯৭১এর মার্চ। উত্তাল এই মার্চের বিশাল পটভুমিতে অছে বাঙ্গালির আত্মানুসন্ধানের দীর্ঘ পথ পরিক্রমা, আছে যুগপৎ বিজাতীয় নিষ্পেষন এবং তার বিরুদ্ধে মরণপন রুখে দাঁড়ানোর ধারাবাহিকতা।
কৃষিপ্রধান এই জনপদের নিরীহ মানুষ ইতিহাসের নানা মোড়ে সামন্তপ্রভূ,রাজন্যবর্গ এবং তাদের পাইক-পেয়াদার আর্থ-সামাজিক জোর জুলুমের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে,আত্মাহুতি দিয়েছে। জাত-পাত-পেশাগত পরিচয়ে এইসব বিদ্রোহ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত জ্বলে আবার নিভে গেছে, দাবানল সৃষ্ঠি করতে পারেনি। তা সত্বেও করুন অভিজ্ঞতা আর উত্তর পুরুষের জন্যে ঐতিহ্য রেখে গেছে এ’সব বিদ্রোহ, আত্মদান। উপনিবেশবাদী যুগে এসে বিংশ শতকের শুরুতে বিশ্বজুড়ে আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক জাতিয়তাবাদী উন্মেষের বাতাবরণেও এতদঞ্চলে বিপ্লব, বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে সর্বভারতীয় পরিচয়ে, বহুধা বিভক্ত ধর্মীয় মোড়কে। বলাবাহুল্য এতেও রক্তপাত যতটা হয়েছে ততটা কার্যকর কোন অর্জন হয়নি। ধর্মীয় পরিচয়ে দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তিতে আজাদি নামে দেশভাগ এবং নুতন ঔপনিবেশিক প্রভূ পাকিস্তানের শাসন-শোষনের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হতে হতে পূর্ব বাংলায় পোড় খাওয়া মানুষের মধ্যে নিজেদের আত্মপরিচয়ের ঐক্যসূত্র স্বরূপ ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক জাতিয়তাবাদের উন্মেষ ঘটতে থাকে। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪সালে সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২১দফার সনদ, ৬২-৬৩ আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ৬৬ সালে ছয় দফা, ৬৮-৬৯ এ ১১ দফার আন্দোলন এ’ভাবে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে জনমানুষের মধ্যে বাঙ্গালি জাতিয়তাবাদের চেতনা এবং স্বাধীন,সার্বভৌম জাতি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি সংহত হতে থাকে। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসন পীড়ন এবং তার বিপরীতে নানা রাজনৈতিক কর্মসূচীতে এককাট্টা হতে থাকা প্রতিবাদী জনতা সবকিছু মিলিয়ে সালাম-জাব্বার-বরকতের সারিতে আসাদ,মনুমিয়া, সার্জেন্ট জহুরুল হক, ড:জোহার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে চিহ্নিত এই উত্তাল সময়। এই প্রেক্ষাপটে বাঙ্গালির জাতিয়তাবোধ এবং জাতিরাষ্ট্রের আকাঙ্খা প্রতিফলিত হয় ৭০এর সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে। তুমি কে আমি কে বাঙ্গালি, বাঙ্গালি। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা- যমুনা এই জনপদের হাজার বছরেরর ইতিহাসের সেরা উচ্চারণ। এর সার্থকতা রূপায়নে জনতা এবং রাজনৈতিক নেতার সফল সম্মিলিত প্রতীক জাতির জনক খ্যাত একজন বঙ্গবন্ধু—হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙ্গালি। বলাবাহুল্য ইতোপুর্বেকার বিচ্ছিন্ন বিপ্লব, বিদ্রোহে জনতার রাজনৈতিক অসচেতনতার পাশাপাশি নেতৃত্বের সামাজিক শ্রেণীগত আভিজাত্যও প্রকট ছিল। হাজার বছরের ইতিহাসে উত্তাল মার্চে এসে রাজনীতির মাঠে পরিক্ষীত এক ভূমিপুত্রের মধ্যেই বাঙ্গালি খুঁজে পেল রাজনৈতিক আশা-ভরসার জীয়ন কাঠি বঙ্গবন্ধু।
৭০এর নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার গড়িমসি এবং উল্টো দমন নীতি, সমর সজ্জার প্রতিবাদে এই প্রতীকের মুখেই গর্জে উঠে “দাবায়ে রাখতে পারবানা।” জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে মহাকালের ভাগ্যাকাশে তর্জনী উঁচিয়ে পুরো উচ্চারণ – “আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবানা।” এই কথায় কতোটা উজ্জীবিত হলে কোন নিরস্ত্র জাতি নিজেদের স্বাধীন, সার্বভৌম পরিচয় ছিনিয়ে আনতে নয়মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে ৩০লক্ষ শহীদ আর সাড়ে চার লাখ বীরাঙ্গনা মা-বোনের সর্বস্বত্যাগ স্বীকার করে বাঙ্গালির বাংলাদেশ তার প্রমাণ।
স্বাধীনতা অর্জনের পরেও বিজয়ী জাতিকে দাবায়ে রাখার কম চেষ্ঠা চলেনি। জাতির জনকের নেতৃত্বে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র যখন যুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতি কাটিয়ে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে লিপ্ত তখন আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে সন্দেহ পোষন করা হয়- এই দেশের অস্তিত্ব আদৌ ঠিকে থাকবে কিনা। পরাজিত পাকিস্তানতো বটেই তার সহযোগী চীন-মার্কিন পরাশক্তি কুটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দুই ফ্রন্টেই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবল বিরোধীতা করতে থাকে। বর্তমান সময়ে দেশে বহুলালোচিত মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের অনেকেই সেদিন স্বেচ্চাপ্রণোদিত হয়ে এই ঘৃণ্য তৎপরতায় সহযোগী হয়। কেবল বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ফলেই স্বাধীন বাংলাদেশ তার প্রারম্ভিক যাত্রা অব্যাহত রাখতে সমর্থ হয়। পরাজিত শত্রুরাও মরিয়া হয়ে উঠে। স্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কারের সেই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাকালীন সময়ে পরাজিত শত্রুরা চরম আঘাত হানে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর নিবেদিত প্রাণ রাজনৈতিক সহকর্মীদের হত্যার মধ্য দিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশ পুন:রায় পাকিস্তানী ভাবধারায় সেনা স্বৈরশাসনে অধঃপতিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কলুষিত করা, সংবিধানের চার মৌলিক নীতিমালা উপড়ে ফেলা,রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন,যুব সমাজের চরিত্র হনন এই নষ্ট সময়ের ট্রেডমার্ক। আশার কথা – রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অধিষ্ঠিত স্বাধীন,সার্বভৌম জাতির চেতনার গভীরে প্রতিনিয়ত অনুরণিত হতে থাকে সেই বজ্র নির্ঘোষ- দাবায়ে রাখতে পারবানা। ৯০এর গণ আন্দোলনে গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থায় জাতীয় উত্তরনে সক্ষমতা তারই প্রমাণ।
চলমান সময়ে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে উন্নয়নশীল দেশসমূহকে দাবায়ে রাখার অন্যরকম অপচেষ্টা দৃশ্যমান। দাবিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ভোগবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতি,শুভঙ্করী মারপ্যাঁচযুক্ত ঋণ ব্যবস্থা এবং একচোখা যত প্রথা পদ্ধতি, চুক্তি-প্রটোকল ইত্যাদি। এ’সবের মধ্যে থেকেও বাংলাদেশের মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা এবং সফলতা উপেক্ষা করার মত নয়। এক সময়ে পরাশক্তির খাদ্য রাজনীতির চাপে নাখাল নব্য বাংলাদেশ আজ চল্লিশ বছর পরে সেদিনের চেয়ে দ্বিগুন জনসংখ্যা নিয়ে খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পুর্ণ। সেদিন যারা বাংলাদেশকে ‘বাসকেট কেস’ বলে উপহাস করেছে কালের বিবর্তনে তাদের হাতেই বাংলাদেশের সরকার প্রধানকে তুলে দিতে হয়েছে খাদ্য উৎপাদনে বিশ্ব সেরা পুরস্কার। কৃষিতে খাদ্য উৎপাদনই শুধু বাড়েনি কৃষি পণ্যের শ্রেণী বিন্যাসে ব্যপ্তিকরণও ঘটেছে ঈর্ষণীয়ভাবে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গবাদি পশু পালন,হাঁস-মুরগী,মৎস্য উৎপাদন দেশীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে অব্যাহত এবং ক্রমবর্ধমান হারে। আরও আশার কথা- একসময়ের কৃষি প্রধান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে কৃষির সমান্তরালে এগিয়ে এসেছে তৈরী পোষাক শিল্প এবং বহির্বিশ্বে কর্মরত প্রবাসী অভিবাসী বাঙ্গালিদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার রেমিটেন্স। একসময় নৌপথের বিশ্ব শাসক ডাচ-জার্মানদের দেশে এখন জাহাজ রফতানী করে বাংলাদেশ। মধ্য ইউরোপে বাংলাদেশের ঔষধ শিল্পের বাজার সুপ্রতিষ্ঠিত। মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়ায় উঁকি দিচ্ছে ওয়ালটনের ইলেকট্রনিক্স পন্য মেড ইন বাংলাদেশ। ভাবতেও ভাল লাগে একসময়ের ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বিশ্বগুরু জাপান’র রাষ্ট্রদূত ওয়ালটনের কারখানা পরিদর্শন করছেন সপ্রশংস সরব বিস্ময়ে। এ’ভাবে অপ্রচলিত পন্য, অপ্রত্যাশিত খাতের ক্রমবর্ধমান উন্নতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ক্রমাগত সমৃদ্ধ করে চলেছে। নাগরিক জীবনে স্বভাব সুলভ এন্তার অভাব অভিযোগ স্বত্বেও এই নীরব অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ক্রমবর্মান মাথাপিছু আয়,ক্রয়-ক্ষমতা,জীবন মান,শিক্ষা-স্বাস্থ্যখাতের অগ্রগতিতে। প্রলম্বিত বিশ্বমন্দা, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি,দেশীয় প্রাকৃতিক অনিশ্চয়তার বিপরীতে বার্ষিক ছয় থেকে প্রায় সাত শতাংশ হারে নিয়মিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রমান করে বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক রণাঙ্গনেও পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। অতি সম্প্রতি প্রতিবেশী মায়ানমারের সাথে দেশের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তিতে আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিজয় এর সার্থক উদাহরণ। কথিত দুর্নীতির অভিযোগের পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের টাল বাহানার বিপরীতে একই প্রকল্পে ঋণ দিতে চীন এবং মালয়েশিয়ার দৌড়-ঝাঁপ প্রমান করে অর্থনীতির মত কুটনীতির রণাঙ্গনেও বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখার দিন শেষ।
এত কিছুর মধ্যেও দেশীয় রাজনীতিতে স্বৈরাচারী বদভ্যাস, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় জনিত টানাপড়েন,পাকিস্তানী ক্যু অভ্যাস পিছুটান আছে, দোদুল্যমান মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনে খাই খাই, হাপিত্যেস আছে। অল্পে তুষ্ট আপামর জনগনের সামনেও আছে উন্নয়ন,অগ্রগতির খোলা দিগন্ত। জাগতিক জীবনে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মত সম্ভাবনাও অপার তার উপর বাঙ্গালি স্বত্বার গভীরে আছে অভয়মন্ত্র ‘দাবায়ে রাখতে পারবানা।’ পরাধীন,ঔপনিবেশিক জীবনধারা থেকে রক্তমূল্যে কেনা স্বাধীন-সার্বভৌম ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়ে আত্মত্যাগী জনকের যোগ্য সন্তান হিসেবে বাঙ্গালির নুতন হলফনামা-আমরা যখন বাঁচতে শিখেছি কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবানা ।
aliazamali@hotmail.com
Discussion about this post