বিবাহ বিচ্ছেদ ও কিছু কথা
-সত্যরঞ্জন সরকার
দীর্ঘদিনের প্রচলিত সামাজিক প্রথার মধ্যে বিবাহ একটি, যা আধুনিক কালে আইন দ্বারাও স্বীকৃতিলাভ করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে বিবাহকে অত্যন্ত গুরুত্বের সংগে বিবেচনা করা হয়। এখানে শুধুমাত্র দু’টি ছেলে মেয়ের মিলনকে কেন্দ্র করেই বিবাহ কার্যক্রম সমাধা হয় না, সেখানে থাকে আত্মীয়তা, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক ও কিছু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান যা প্রথা হিসেবে সিদ্ধ হয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে।দীর্ঘদিনের পথ পরিক্রমায় বিবাহের সামাজিক দিক উপেক্ষা করে আধুনিক সৃষ্ট আইন কাঠামোর মধ্যে জুড়ে দেওয়াতে “বিবাহ নামক” দুটি হৃদয়ের বন্ধনের শিকড় থেকে যেন মাটি সরে যেতে বসেছে। আইনের ভয়ে সমাজের মানুষ অন্যায় থেকে বিরত থাকে, নিজেরা সুসংহত হয়। কিন্তু আইনের ফাঁক ফোকড় দিয়ে সমাজে বেআইন যদি আইনী প্রতিষ্ঠা পাই তাহলে তা সমাজে দুর্ভাগ্য বয়ে আনতে বাধ্য। প্রেম ভালবাসা,বিবাহ এসব শব্দগুলো এত বেশী প্রচলিত যে এটার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ছাড়া অন্য কারো কাছে এর তীক্ষ্ণ ঝাঁঝখুব বেশী ক্রিয়াশীল হয় না। সমাজে প্রেম, ভালবাসাকে কেন্দ্র করে পরিণতিতে এক পরিবারের সংগে অন্য পরিবারের বন্ধন যেমন অটুট হয়েছে, তেমনি এক পরিবারের সংগে অন্য পরিবারের শত্রুতায় কতজীবন, সম্পদ যে ধ্বংস হয়েছে তার কোন ইয়াত্তা নেই। সামাজিক বিচার থেকে আইনী বিচারের লড়াইয়ে অবতীর্ন হয়ে আর্থিক ক্ষতি সহ সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়া অনেককেই এ সমাজে খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা মানসিকভাবে রোগাক্রান্ত, হতাশ এমনকি সবকিছু হারিয়ে সর্ব্বশান্ত হয়ে চুপসে গেছে। যৌবনের টগবগে যুবক কিংবা যুবতীরা আজ যারা সুখে সংসার করছে, তাদের পারিবারিক জীবনের টানাপোড়েনে তারাক্ষত বিক্ষত হলেও বন্ধনের রশি কাঁটতে দেয়নি তাঁর মুল কারন- পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ যা যৌথ পরিবারে এক সময় মুলধন হিসেবেই বিবেচিত ছিল, কিন্তু একক পরিবারের বিচার বিবেচনায় আইনকে বেশী মান্যতা দেওয়ায় অনেক যুবক যুবতীকেই সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়া কাঁচের ঠুনকো বাসনের মত সহজ হ‡য় দাড়িয়েছে, যার ফলে আজ তারা নিঃসঙ্গ জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। নিজের অহংবোধ যেখানে প্রাধান্য পাই পারিবারিক সুস্থিশীলতা সৃষ্টিতে তা ভাঙনকেই ডেকে আনে, অর্থাৎ মিলেমিশে থাকবার মূলমন্ত্র “সহমর্মিতা ও সহযোগিতাÓ যদি উধাও হয় তাহলে প্রলেপ বুলানো সামাজিক কিংবা পারিবারিক মূল্যবোধ গুলোও সেখানে অকার্য্যকর হয়ে পড়ে, বিশেষতঃ সেগুলো প্রয়োগের মানুষগুলোর যদি অস্তিত্ব না থাকে। সমাজে আজ বয়োবৃদ্ধরা কোনঠাসা, তাদের উপলব্ধিজাত জ্ঞানের নির্য্যাসে, কিংবা পথচলার অভিজ্ঞতায় সম্মৃদ্ধ যে জ্ঞান তা পরিবারের সদস্যরা গ্রহনে নারাজ, ফলে বিবাহোত্তর ও বিবাহ-পূর্ব উভয় সংকটেই আজ আধুনিক প্রজন্ম আইনের দরজায় দাড়িয়ে বিচার প্রার্থী। ন্যায়নীতিবোধে উজ্জীবিত বয়োবৃদ্ধদের জ্ঞান আজ নিঃশব্দে পরিবারের ভাঙ্গন রুখতে অকার্য্যকর বরং আইন সেখানে সিদ্ধহস্ত, কিন্তু প্রলম্বিত বিচারের সময়কালকে ঘিরে দীর্ঘসূত্রীতার যে রায় তা সমাজ জীবনে সুফল বয়ে আনছে কিনা তা নিয়েও মাঠপর্য্যায়ে গবেষণা হওয়া দরকার। প্রতি প্রত্যেক গ্রামে ও শহরে, নগরে ও বন্দরে আজ বিবাহ বিচ্ছেদজনিত মামলা এবং এসব মামলার সূত্রপাত ও নিষ্পত্তির যে ব্যবস্থা এবং তার ফলাফল, তাতে সন্দেহ হয় বিবাহ নামক এ প্রতিষ্ঠান তথা সামাজিক এ বন্ধনকে ঘিরে পরিবারের যে সুস্বাস্থ্য বিরাজমান ছিল তা ভবিষ্যতে থাকবে কিনা? পারিবারিক ও ব্যক্তি-জীবনের তালিকা থেকে “বিবাহ বিচ্ছেদÓ কে বাদ দেওয়া বা গ্রহন করার মানসিকতা সমাজে গড়ে উঠলেও সামাজিকভাবে তা সর্বজন গ্রহ্যতা বা মান্যতা দিতে আমরা এখনও পাশ্চাত্য ভাবধারার মত উদারতায় বিশ্বাসী হতে পারিনি,যার ফলে বিচ্ছেদের পরেও আত্মহনন কিংবা প্রতিশোধস্পৃহা, খুন খারাবীর খবর খব‡রর কাগজে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ক্লেদাক্ত এ সমাজে হঠাৎ এ পরিবর্তনের কারন অনুসন্ধানে মূল যে বিষয় গুলো আলোচনায় আসে তার অন্যতম হলো দাম্পত্য জীবনে একজন আরেকজন কে সম্মান ও বিশ্বাস না করা। শুধু সেটা দাম্পত্য জীবনেই নয়, পারিবারিক জীবনেও এটা আজ অনুপস্থিত। কেউ কাউকে ব্যক্তিজীবনে যেমন সহ্য করতে পারছে না, অপমান, অবিশ্বাসের আঘাত একে অপরকে ক্ষত বিক্ষত করে তুলছে, মাথার উপরে যৌথ পরিবারের কর্তা না থাকাতে যা খুশী যথেচ্ছারের যে অভদ্র কালচার তৈরী হয়েছে এটার রশি টানবার জন্য পাশে কেউ অবশিষ্ট থাকছে না, ফলে ঘৃনাবোধের উৎপত্তি ব্যক্তি থেকে পরবর্তীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও সংক্রামিত হচ্ছে। উভয়ের পরিবারের সদস্যরা আজ এ সবকিছুকে সামজিকভাবে প্রতিহত না করে , অপমানের-অবিশ্বাসের বদলা নিতে আইনের দিকেই দম্পতিদের উৎসাহিত করছে। বিশেষ করে আধুনিক মন মানসিকতার ধারক বাহকদের কাছে এসব সাধারণ ঘটনা, অনুতাপের বা অনুশোচনার কোন বিষয় বলে তারা মনে করে না। এক্ষেত্রে পারিবারিক মূল্যবোধের যে ধারনা তা বর্তমান এ প্রজন্মের কাছে উপহাসের মত শোনায়। যা খুশী তাই করার, যত খুশী বন্ধু বা বান্ধবী থাকবার বা রাখবার এই যে রীতিনীতিকে মান্যতা দেওয়ার রেওয়াজ আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় গড়ে উঠলো, সর্বনাশা ভাঙনের শব্দও সেখান থেকে শুরু হোল। বিবাহের পারিবারিক স্বীকৃতিকে আজ আর মান্যতা দেওয়া বা গ্রাহ্য করা হয় না, ধর্মীয় রীতিনীতি মাফিক বিবাহের যে চিরন্তন ভাবমূর্তি সমাজদেহে প্রচলিত ছিল তাও আজ মুছে যেতে বসেছে। এটা যে পবিত্র সামাজিক বন্ধন তাও আজ অস্বীকার করা হচ্ছে। আইনই যদি পারিবারিক সম্পর্ক নির্নয়ের আশ্রয়স্থল হয় তাহলে বিচ্ছেদ জনিত কারনে সামাজিক ভারসাম্য বজায় থাকবে কিনা এবং সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধে আঘাত আসবে কিনা তাও আজ ভেবে দেখবার বিষয়।
বিয়েতে পন-প্রথা আজও বিদ্যমান। আত্মীক সম্পর্কে বলা হয় আত্মায় আত্মায় মিলনে গড়ে ওঠে আত্মীয়তা- সেই “ আত্মার মিলনেÓ আত্মীয়তা আজ অনুপস্থিত। নগদ নারায়ন কিংবা সমসাময়িক কালের লোভনীয় ইলেকট্রনিক সামগ্রী, গাড়ী, ফ্লাট, এসব বিবাহের সংগে পাত্র পক্ষের উপরি পাওনার দাবী মেটাতে কত অঘটন ও জীবনহানি ঘটছে কে তার খবর রাখে? ফলে বিবাহের পবিত্রতাই শুধু নষ্ট হচ্ছে না, সমাজে এটা সংক্রামক ব্যধির মত ছড়িয়ে পড়ছে। বিবাহে দেনা-পাওনা জনিত কারনে কত মেয়ের প্রাণ যে অকালে ঝরে যাচ্ছে! যদিও যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে সচেতনতা বেড়েছে তবুও দীর্ঘদিনের লালিত এ প্রথাকে সহজেই বন্ধ করা যাবে বলে মনে হয় না। আইন থাকলেও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করার লোকের সংখ্যাও আজ বাড়ছে। বিবাহ বিচ্ছেদজনিত কারনে সামাজিকভাবে নিন্দিত না হওয়ার ভয় না থাকাতে এ হার বেড়েই চলেছে। ছাড়াছাড়ি বিষয়টা এক সময় সমাজে বহুল চর্চিত থাকলেও, এখন আইনের বদৌলতে স্বীয় স্বাধীনতার প্রতিফলনে এটা একটা সহজ ও স্বাভাবিক বিষয়। আমার ভালো লাগলো না, কিংবা ভাল না লাগার পিছনে অন্য মতলব থাকায় আইনের আশ্রয়ে যদি তা মান্যতা পাই , তাহলে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় যে ঘটছে এটা নির্দিধায় বলা যেতে পারে। “অন্য মতলবÓ বলতে আজ বিবাহ বিচ্ছেদ জনিত কারনে ছেলে পক্ষ বা ছেলের উপর, কিংবা মেয়ে পক্ষ বা মেয়ের উপর যে মানসিক চাপ পড়ে তাতে দেখা যায় এদের মা-বাবারাই এগুলো সমর্থন করে, কারন আইনী নির্দেশ মোতাবেক Òনগদ টাকা পয়সারÓ একটা হিসাব নিকাশ থাকে। লোভাতুর পিতামাতা সে সব চিন্তা ভাবনা করেই আপোষের নামে নগদ টাকা পয়সার কিংবা প্রাপ্ত দেনা-পাওনাকে করায়াত্ত করার ফন্দী আঁটে, যা তার সন্তানসহ নিজেদের ভোগে কাজে লাগান। ষাটের দশকের সিনেমা কিংবা নাটকে পরিবারের তথা স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব কর্তব্যের যে রুপকল্প “পথেহোল দেরী, সাত পাঁকে বাঁধা, অবুঝ মন, শিল্পী, ইত্যাদি সিনেমাতে লক্ষ্য করেছি, আজ তা সম্পূর্ন কল্পনাতীত। তখনকার সমাজ ব্যবস্থা এবং আজকের সামাজিক অবস্থা এক নয়, তারপরেও একথা অনস্বীকার্য্য যে “বিবাহ নামকÓ সামাজিক এ বন্ধনকে আইনী বন্ধন থেকেও বেশী মাত্রায় উদারতা এবং সহনশীলতা সহ শ্রদ্ধাবোধে ভাবতে পারার সুফলে এত বেশী হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ আমরা তখন দেখিনি, যা আজ দেখতে বাধ্য হচ্ছি।
মানুষের দাম্পত্য জীবনের পবিত্রতায় ও সাহচার্য্যে যে সুসম্পর্কের বাতাবরন উভয় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে গড়ে ওঠে তা আর্থিক মূল্য (যা আজকের যুগে কাম্য) দিয়ে পরিমাপ যোগ্য তো নয়ই, বরং তার অটুট বন্ধনের জোরে একতাবদ্ধতা ও পরস্পরের বিপদে আপদে সাহায্যের হাত প্রসারিত করা এবং তিরষ্কার ও পুরষ্কারের মাধ্যমে শাসন ও কাছে রাখার এক অক্লান্ত প্রচেষ্টা, যার বিন্দুমাত্র আজকের সমাজে কল্পনা করতেও মানা। Òসমাজবদ্ধ জীবÓ এ তকমাটা আমরা হারাতে বসেছি, আমরা সবাই এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা।অনুশোচনা, হা-হুতা্শ, না পাবার বেদনা, অথবা অতিরিক্ত পাবার জন্য ভোগের চরমসীমায় উপনীত হ’বার কারনে ভোগলিপ্সা রহিত, ভালবাসাহীন এক যান্ত্রিক মানুষ। হাসি, কান্না, ব্যাথা, বেদনা, সুখ, দুঃখ এসব কিছুই যেন আমাদেরকে স্পর্শ করছে না, আমরা ‘আমিত্ব’ নিয়েই ছুটে যাচ্ছি ‘আমাদের’ কথা ভাবছি না। হৃদয়ের অমানবিক এ পাশবিকতাকে ঘিরে হা-হুতাশ করার মানুষও আজ অবশিষ্ট নেই,কারো কিছুতেই মনের মধ্যে দাগ কাটছে না। আরো- আরোর দৌড়ে কাউকে পিষে মারতে বিবেক আজ কেঁপে উঠছে না। ছাড়াছাড়ি না করে জড়াজড়ির যে শুভ উদ্যোগ তার রাস্তা দেখানো বয়োজেষ্ঠ্য মানুষগুলো আজ অপাংক্তেয়। বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিজের, আপোষহীন এ মনোভাবের লাগাম টানার জন্য আত্মীয়রা আজ হৃদয়ের ক্রন্দন ধ্বনি শুনেও না শোনার ভান করেন, সবাই দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখেন আঙ্গুল তুলে অসংগতির, অবিশ্বাসের জাল ছিন্ন করে দুই হাত পুনঃ একত্রী করনে কোন কার্য্যকর ভূমিকা তারা রাখছেন না। রাখলেই বা- তা মানতে কি কেউ বাধ্য? পারিবারিক বা সামাজিক মূল্যবোধের জায়গা গুলোর মাটি এত অনুর্বর হয়ে গেছে যে সেখানে ভালবাসার ফসল ফলানো কঠিন। ধর্ম, প্রথা, রীতি-নীতি এ বিশ্বাস বোধেও আজ ফাটল, চোখের সামনেই গুগলের পৃথিবী, ভাল-মন্দের উপদেশ এ সার্চ ইঞ্জিনেই মিলছে, অতএব কে মান্যতা দেবে? স্বেচ্ছাচারী মনোবৃত্তির পিছনে আধুনিক প্রযুক্তিও কম দায়ি নয়, তার অর্থ এই নয় যে এসব পরিতাজ্য, একে গ্রহন ও বর্জনের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষের পারিবারিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ গুলোর প্রতি যেন অবিচার না করি। দাম্পত্য জীবনের ভালবাসার জায়গায় আমিত্বের প্রাধান্য দিয়ে বিচ্ছেদকে আমন্ত্রন না করি, পারস্পারিক সহমর্মিতা, সহযোগীতার হাত ধরে দুটিমন যেন আনন্দে চলতে চলতে একসঙ্গে গেয়ে উঠতে পারে-
যদেতত্ হৃদয়ং তব তদস্তুহৃদয়ং মম।
যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।।
অর্থাৎ তোমার এই হৃদয় আমার হোক, আর আমার এই হৃদয় তোমার হোক।।
Discussion about this post