মুনিরা রহমান- আমি প্রবাসী বাংলাদেশি। মাটির টানে প্রায়ই ছুটে যাই বাংলাদেশে। বিমানে ওঠার মুহূর্ত থেকে শুরু হয় হূৎস্পন্দন। বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তা আরও বেড়ে যায়। ঢাকার আকাশে পৌঁছালে জানালা দিয়ে চোখে পড়ে সারি সারি বাড়ির ছবি। অপরিকল্পিত ঢাকার অগোছালোভাবে বেড়ে ওঠা দালানের সারিটাকে উন্নত বিদেশি মহানগরের চেয়ে সুন্দর মনে হয়। মনটা অস্থির হয়ে ওঠে যত শিগগির সম্ভব দেশের মাটিতে পা দেওয়ার জন্য।
কিন্তু এই উৎসাহ কেমন যেন আস্তে আস্তে মিয়িয়ে যেতে শুরু করে লম্বা ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে। মিনিট পেরিয়ে ঘণ্টা চলে যেতে থাকে। লাইন যেন আর ফুরায় না। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর যখন কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছাই, মনে হয় ভোগান্তির যেন সবে শুরু। ইমিগ্রেশন ডেস্কে বসে থাকা কর্মকর্তা দীর্ঘক্ষণ ধরে পাসপোর্ট উল্টেপাল্টে দেখে শুরু করেন প্রশ্নোত্তর। আমি কে, কোথায় থাকি, একা কেন ভ্রমণ করছি ইত্যাদি। নানা রকমের প্রশ্ন শেষেও তাঁদের জিজ্ঞাসা যেন শেষ হতে চায় না। কেউ কেউ নানা রকম বক্রোক্তিও করেন, যেন বিদেশে থাকা বা বিদেশে চাকরি করাটা একটা অপরাধ। কিংবা স্বামীকে বিদেশে রেখে একা দেশে ছুটি কাটাতে এসে আমি একটা দোষ করে ফেলেছি।
যাঁরা শিক্ষিত এবং অনেকবার ভ্রমণ করেছেন, বিরক্ত হলেও তাঁরা সব প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারেন। ধৈর্য ধরে রেখে আমিও পেরিয়ে যাই ইমিগ্রেশনের এই খড়্গ। মনটা খারাপ হয় তখনই, যখন দেখি প্রবাসী শ্রমিকদের তাঁরা শুরু থেকেই সরাসরি তুমি অথবা তুই সম্বোধন করেন। প্রবাসী শ্রমিক অনেকে ভুলে ফর্ম পূরণ না করে ইমিগ্রেশন ডেস্কের সামনে দাঁড়ান। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা কেউ কেউ এমন রুক্ষস্বরে তাঁদের তিরস্কার করেন যে সেটা দেখে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা আমারই কেমন যেন লজ্জা লাগে।
একই নাটক হয় দেশ থেকে যাওয়ার সময়ও। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের বিভিন্ন রকম জেরার মুখে বিদেশগামী কর্মীরা অনেকেই দিশেহারা হয়ে যান। অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না কি করবেন। তখন দেখেছি, সাহায্য করার পরিবর্তে বাকিরা যেন তাঁদের নিয়ে মজা করতেই আনন্দ পান। মাঝেমধ্যে মনে হয়, নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা এসব ছেলেমেয়েকে অপমান করেই যেন সবার মোক্ষ লাভ হলো। অথচ তাঁরাই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশকে ধীরে ধীরে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের পথে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সাহায্য করছেন।
তাঁদের অনেকেই হয়তো অনেক বছর পর নিজের কষ্টার্জিত উপার্জনের টাকা খরচ করে এসেছেন নিজেদের প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করতে। অনেকেই হয়তো বিদেশে এমন কাজ করেন যে পরিমিত বিশ্রামটুকুও নিতে পারেন না। হয়তো প্রতিনিয়তই শুনতে হয় কটুকথা অথবা গালি। নিজের দেশে তাঁরা কটা দিন এসব দুঃখ-কষ্ট ভুলে থাকতেই আসেন। কিন্তু দেশে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই যে আচরণের মুখোমুখি তাঁরা হন, তা আসলে খুবই দুঃখজনক। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত, বিদেশের বিমানবন্দরেও প্রবাসী বাংলাদেশিদের এতটা হেনস্তা হতে হয় না, যতটা নিজের দেশে এসে ভুগতে হয়।
হয়তো ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের দোষ নেই। হতেই পারে বারবার সবার করা একই রকম ভুলগুলো দেখে তাঁরা বিরক্ত হন। প্রবাসী শ্রমিকেরা দেশে ফিরেই যেন এ রকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে পারেন, সে জন্য বিমানবন্দরে থাকা উচিত একটি হেল্প ডেস্ক, যার কাজ হবে দেশে আসা প্রবাসীদের বিভিন্ন রকম সেবা দিয়ে সাহায্য করা। যেমন তাঁরা ঠিকমতো ইমিগ্রেশন ফর্ম পূরণ করেছেন কি না, হাতে জরুরি কাগজপত্রগুলো গোছানো আছে কি না, তাঁদের কলম লাগবে কি না। একইভাবে, দেশ ছাড়ার সময় তাঁদের টিকিট ও অন্য কাগজগুলো ঠিক আছে কি না বা ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা কোনো কারণে ফিরিয়ে দিলে কী সমস্যা হয়েছে, তা ঠিকমতো বুঝিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। সর্বোপরি সবাইকে এটা বুঝতে হবে যে তাঁরাও মানুষ, তাঁদের মানসম্মান আছে এবং দেশের উন্নয়নে তাঁদের অবদান আমাদের যে কারও থেকে বেশি। কাজেই খারাপ ব্যবহার এবং বিরক্ত না হয়ে তাঁদের সাহায্য করার চেষ্টা করতে হবে।
আগে যখন আমি দেশেই ছিলাম, তখন বিদেশে যাওয়ার সময় এসব দেখলে কিছুই মনে হতো না। এখন যখন আমি নিজেই বিদেশে থাকি, নিজে কাজ করি, রক্ত পানি করে উপার্জিত টাকার সিংহভাগই দেশে পাঠাই, তখন কিছুটা হলেও হয়তো বা তাঁদের অনুভব করতে পারি। দেশের বাইরে থেকেও দেশের জন্য এরাই সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নিজেদের ঘরবাড়ি, জমিজমা বেচে একটু ভালো রোজগারের আশায় দিনের পর দিন আসুরিক পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠান। যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে দেশের অর্থনীতিটা সচল থাকে, তাঁদের দেশে ঢোকা ও দেশ থেকে বিদায় নেওয়ার পর্বটা কি আরেকটু আনন্দময়, নিদেনপক্ষে সহনীয় করা যায় না?
Discussion about this post