আল আমিন চৌধুরী স্বপন: বন্ধুরা সব, যে যেমনে আছেন আশা করি ভাল আছেন। দেশ থেকে গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ইং কুয়েত ফিরে আসলাম। আমার দেশ আমার ভালবাসা। জন্মভূমির মাটি পবিত্র ঈমানের মত খাঁটি। যে নাড়ীর টান আমাদেরকে বার বার টেনে নিয়ে যায় তাকে ছেড়ে আসতে কার মনে চায় ! তারপরও রুটি-রুজীর জন্য স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে আসতে হয়। আগের দিনে মানুষ আসা-যাওয়া করত বড় বড় পানসী বা পানির জাহাজে এখন উড়ে আসতে হয় উড়োজাহাজে। তাই আকাশের স্রোতে ভেসে আসলাম বাংলাদেশ বিমানে। জীবিকার অন্বষণে আমি তিরিশ বছর যাবত কুয়েতে আছি। আমাদের যত অসুবিধাই হোক দেশের প্রতি ভালবাসা আছে বলেই অন্যান্য প্রবাসিদের মত আমরাও বিমানে ভ্রমন করে থাকি। কুয়েত থেকে টিকিট নেয়ার সময় এবং সফরে যাওয়ার দিন কুয়েতে কর্মরত বিমানের স্টাফদের আন্তরিকতা ও সৌজনতার এতটুকু অভাব দেখিনি। এর আগে ছিলেন কান্ট্রি ম্যানেজার এস এম নজরুল ইসলাম বর্তমানে আছেন কান্ট্রিম্যানেজার দিবাকর দেওয়ানজি, স্টেশন ম্যানেজার ফজলুর রাহমান খান এদের প্রত্যেকের আচার-ব্যবহারে কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশীরা মুগদ্ধ। বিমান অফিসে আগত পেসেঞ্জার যারা নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে জানা গেছে, টিকিটের জন্য আস্লে প্রথমে সামনে রাখা চেয়ারে বসতে বলেন, তারপর যাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধা শুনে বিমানের শিডিউল অনুযায়ী নির্ধারিত তারিখ বুঝে টিকিটের ব্যবস্থা করে দেন। আমি দেখেছি, একজন কর্মজীবি আন্পড় লেবার বা মাজরায় (কৃষি খামাড়) কাজ করেন এমন নিরিহ কোন লোক টিকিট কাটতে আসলে সেও নির্দিধায় সমস্ত তথ্য জেনে-বুঝে টিকিট নিয়ে যেতে পারেন। তারপর কান্ট্রি ম্যানেজারের অফিসে গেলে তো আপ্যায়ন শেষে একে অপরের খোঁজ-খবর নিয়ে টিকিটের কোন সমস্যা থাকলে তা যে কোন উপায়ই হোক তিনি ঠিক করে দেন। এই দেখা-শুনার মাঝে চা, কফি, পানিও এবং হান্ডশেক করে দু’দন্ড কুশল বিনিময় করে যাত্রিরা সব বিমানের টিকিট নিয়ে হাসি মুখে বেড়িয়ে আসেন। কিন্তু বাংলাদেশে বিমান বন্দর নিয়ে কথা আসলে কথায় কথায় সমালোচনা আর কষ্টের কথা বলতে-বলতে সবাই দেশ নিয়ে হতাশায় ভুগে। গতবার ছুটি থেকে আসার সময় আমার ১৩/০২/২০১৪ তারিখে ফ্লাইট ডেইট্ ছিল। আমি রিকন্ফার্ম করতে গিয়ে দেখি ঐ তারিখের বিমান ১৬/০২/২০১৪ তারিখে কুয়েত আসবে। অর্থাৎ তারিখ পরিবর্তন। আমার তো মাথা খারপ হয়ে গেলো। কারণ এই তারিখেই আমার ডিউটি। মতিঝিল বিমান অফিসের কারো কথায় আমি আস্থা বা শান্তনা খুঁজে পেলাম না। তারপর কোন দিশা না পেয়ে সরাসরি কুয়েতে অবস্থিত কান্ট্রি ম্যানেজার দিবাকর দেওয়াজী’র কাছে ফোন করলাম, একমাত্র তিনিই আমাকে আস্থা দিয়ে শান্তনা দিলেন। আমি যাতে সময় মত কুয়েত আসতে পারি সে ব্যবস্থা করে দিবেন বলে আশ্বাস দিলেন। শেষ পর্যন্ত জানতে পারলাম ১৪/০২/২০১৪ তারিখে ইটালি গামী একটি ট্র্যান্জিট ফ্রাইট কুয়েত অবতরণ করবে, সেই বিমানেই আমি একমাত্র যাত্রী যথা সময়ে কুয়েতে আসতে পেরেছিলাম। যদি কুয়েত কান্ট্রি ম্যানেজার দিবাকর দেওয়ানজী তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমাকে ঐ বিমানে কুয়েত আসার ব্যবস্থা না করে দিতেন তাহলে আমি চাকরীগত অনেক আসুবিধায় পরতাম। কারণ আমরা যারা কুয়েত মিনিষ্ট্রিতে চাকরী করি আমাদের ছুটি কাটানর পর জয়েনিং ডেইট ঠিক না রাখলে চাকরী নিয়ে অনেক অসুবিধায় পরতে হয়।
এবার গত ২৪/০৭/২০১৪ তারিখে আবার দুই মাসের ছুটিতে দেশে যাওয়ার সময় খুব শান্তিতে কুয়েত থেকে দেশে গেলাম। কিন্তু ফিরে আসার সময় আমার টিকেট পুনরায় রিকন্ফার্ম করতে ঢাকা মতিঝিল বিমান অফিসে যাই। সেখানে পি এন আর রিসিট নিয়ে জানলাম বিমান নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ রাত ৮টা ১৫ মিনিটে কুয়েত যাবে। আমি সে অনুযায়ী প্রস্তুত হতে থাকলাম। ঠিক ২৫/০৯/২০১৪ তারিখে বিকেল ৫টায় রিপোর্টিং করার কথা থাকলেও আমি বাসা থেকে বের হওয়ার আধা ঘন্টা পূর্বে বাংলদেশ বিমান থেকে ফোন আসলো কুয়েত গামী ‘বিমান ০৪৩’ আরো দেরিতে যাবে। রাত ৮টা ১৫ মিঃ’র পরিবর্তে ভোর ৪টায় ঢাকা থেকে ছেড়ে যাবে। এই কথা শুনে আমি একটু চিন্তিত হয়ে পরলাম। যেহেতু আমার ডিউটিতে যোগদানের তারিখ ২৮/০৯/২০১৪ রবিবার তাই বিমান দেরিতে গেলেও সস্থি নিয়েই বৃহস্পতিবার দিনগত রাত ১টায় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছলাম। কাউন্টারে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম বিমান আরো লেইটে যাবে। এই কথা শুনে আমার মাথায় একটা বাজ পরলো। আমি নিরুপায় হয়ে কাঁচের ওয়ালের পাশে পেতে রাখা চেয়ারে রাত সারে তিনটা পর্যন্ত বসে রইলাম আর ভাবতে লাগলাম-দীর্ঘ তিরিশ বছর যাবত বিমানে যাতায়াত করছি, আজ এই যাওয়া আসার মাঝে কত যে অসহায়ত্ব বোধ করচ্ছি, এই কথা কি ভাবে বলবো, কি করে বুঝাবো, বুঝাতে পারি না নিজের মনকে। হু হু কর জীবন চলছে দূর বিমানের মত, স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছি বাস্তবতার নিরিখে। আমার আমি থেমে যাবে একদিন তবুও কেউ থেমে থাকবে না। অনিয়ম ভেঙ্গে নিয়মের মাধ্যমেই পৌঁছ্ব আপন আপন গন্তব্যে। ঠিক রাত ৩:৩০ মিঃ বিমানের একজন অফিসার এসে ডাকলেন, যারা কুয়েত যাবেন সবাই হোটেলে চলে যান, বাইরে গাড়ী অপেক্ষা করছে। কারণ বিমান ছাড়ার টাইম-সিডিউল এখনও সঠিক ভাবে বলা যাচ্ছে না। এ কথা শুনে অনেকেই গালা-গালি দিতে লাগলো। আমি নিরবে সব শুনতে শুনতে গাড়ীতে উঠে গেলাম। গাড়ীতে বসে বসে ভাবতে লাগলাম এই যে যাত্রা বিরতি, ধীরগতি অপেক্ষমান মানুষের ভির কেউ আসছে কেউ যাবে-এ সবই নিয়তি। এয়ারপোর্ট রোড দিয়ে উত্তর দিকে সাঁ সাঁ করে চলছে মাক্রবাস। হোটেলে পৌঁছামাত্র ব্যাগ-ট্যাক নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলাম। সত্যিকার অর্থে এটা নামে হোটেল আসলে এটা একটি রেস্ট হাউস। এক রুমে দুইজন করে দুইটা আলাদা আলাদা বেডে কোন রকম শুয়ে পরলাম। ঘুম নেই দু চোখে। বাসায় ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলাম আমার অবস্থানের কথা। আমি ভাবলাম, আজ শুক্রবার ২৬/০৯/২০১৪ তারিখ যদি আজকের মধ্যে বিমান কুয়েতে না যায় তাহলে আমি কি করব ? পরক্ষনেই মনে পরলো বিমানের কুয়েত কান্ট্রি ম্যানেজার দিবাকর দেয়ানজীর কথা। আমি তার ফোন নাম্বার খুঁজে বের করলাম। যদি আজ না যেতে পারি তাহলে শেষ পর্যন্ত তাঁকেই বলবো, সেই আগের মত যে কোন বিমানে কুয়েত আসার ব্যবস্থা করে দিতে। তা ছাড়া ত আমার কোন পথ নাই। এই সমস্ত ভাবনার অনুকুলে ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে মনের অজান্তে ঘুমিয়ে পরলাম। সকাল ৬টায় রুম সার্ভিস্ এসে ডাকলো। ‘স্যার উঠে পরুন, নীচে হলরুমে নাস্তা করে এয়ারপোর্টে যেতে হবে’। এই কথা শুনে একটা স্বস্থির নিঃশ্বাস নিলাম। ডাক যখন পরেছে তাহলে যাওয়াটাও অনিবার্য। সকাল ৭টার সময় নাস্তা করে হোটেল ম্যানেজারের কাছ থেকে পাশপোর্ট-টিকেট হাতে পেয়ে গাড়ীতে উঠে পরলাম।
উত্তরা ৯নং সেক্টর থেকে আমাদের বহন করা গাড়ীটি মেইন রোডে (এয়ারপোর্ট রোড) বেরিয়ে এলো। আজমপুর ফুট ওভারব্রিজ’র নীচ দিয়ে যেতে যেতে ডান পাশ দিয়ে কবি জসীম উদ্দীন রোড ফেলে এসে সামনের দিকে এগোনর পর বিমান বন্দরের গেইটে এসে জামে পরলাম। প্রায় মিনিট সাতেক পরে বিমান বন্দরের দুটি ঢালু্পথ বেয়ে বাম পার্শ্বের রাস্তার দিয়ে উপরে পার্কিং’এ পৌঁছতেই সাবাই ল্যাগেজ-ব্যাগেজ নিয়ে নেমে গেল। এবার গেইটের ভিতরে ঢুকেই ম্যাসিনে চেক্ করে বোর্ডিং কার্ডের জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। প্রিয় পাঠক, এই খানেই মজার ব্যপার, যার-দরুন একটি বাস্তব ঘটনার অনু প্রায়াসে আমার এই লিখা।
এরারপোর্টের ভিতরে বেশ ঢান্ডা।এসি চলতেছে। মোটামুটি সকালের পরিবেশ ভালই লাগছে। বেশ কয়েকটি লাইনে দাঁড়ানো যাত্রীরা ট্রলি হাতে সামনে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি একটু ইতস্ত বোধ নিয়ে এগোচ্ছি। আমার ৩টি ব্যাগ ট্রলিতে। সন্ধানি চোখ তুলে দূর থেকে দেখছি কাউন্টারের উপরে লিখা ‘সিংগাপুর’ ‘সিংগাপুর’ ‘সিংগাপুর’। ফ্লাইট নাম্বার ০৪৩’ও লিখা নাই। সিউর হওয়ার জন্য সামনের বোর্ডিং কার্ড হাতে লোকটিকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম, এটা কুয়েতগামী যাত্রীদেরই কাউন্টার। এই ভাবে যারাই নতুন করে লাইনে এসে দাঁড়াচ্ছে, সবাই জিজ্ঞেস করছে ‘ভাই এটা কি কুয়েত যাওয়ার যাত্রীদের লাইন ? অর্থটা কি দাঁড়ালো ! দায়িত্বপ্রপ্ত বিমান কর্মীরা কুয়েতের নেইমপ্লেট লাগাতে ভুলে গেছেন। আমি একটু জোরে বললাম যখন যে বিমান যে দেশে যাবে তখন কাউন্টারের উপরে সেই দেশের নামটাই থাকা উচিত এবং সাথে ফ্লাইট নাম্বারটাও দেওয়া উচিত। জানি না, কিছুক্ষণ পর একজন বিমান কর্মী এসে সিংগাপুর বাদ দিয়ে কুয়েত নাম লিখা নেইমপ্লেট লাগিয়ে দিল। তাও প্রায় অর্ধেক পেসেঞ্জার বোর্ডিং কার্ড পাওয়ার পর। এটা আমার কোন অভিযোগ নয়, তবে যাত্রীরা এমনিতে বিদেশে যাওয়ার সময় মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন, এয়ারপোর্টে এসে খুঁজা-খুজির ব্যপারটা আরো কষ্টদায়ক। আর যদি ফ্লাইট ডিলে হয় তাহলে ত মানসিক যন্ত্রনা এক’শ গুন বেরে যায়।
যাইহোক, কাউন্টারের কাছাকাছি আসার পর দেখছি অনেক পেসেঞ্জার পদ্মা সেতুর জন্য ধার্য্য করা ৫০০ টাকা ফি না দিতে পারায় বোর্ডিং কার্ড পাচ্ছে না, ওজন বেল্ট থেকে ল্যাগেজ নামিয়ে অস্থির হয়ে পরছেন। এই টাকা না দিতে পারলে হয় ত যেতে পারব না। এদিক-সেদিক ছুটা-ছুটি করে কেউ যোগার করতে পারছেন, কেউ-কেউ আবার আত্মীয়-স্বজনদের ফোন করে বিপদের কথা জানিয়ে দিচ্ছে্ন। অনেকেই নীজের ফি’র টাকা পে করার পর বেশী থাকলে একে অপরকে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করছে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখছি আর ভাবছি আমাকেও ত পে করতে হবে! কিন্তু আমি এই টাকা কোথা থেকে পাব ? কারণ আত্মিয়-স্বজন যারা এয়ারপোর্টে ড্রপ্ দিয়ে যায়,তারা ত ভিতরে বা কাউন্টারের কাছে আসতে পারে না। অনেকে আবার গাড়ী পার্কিং’র অসুবিধার কথা চিন্তা করে এয়ারপোর্টে দাঁড়ায় না বা থামে না, সোজা বাসায় চলে যায়। একজন বিমান পেসেঞ্জার স্বদেশ থেকে বিদেশে পারি জমানোর সময় নিজের পকেটে যে সমস্ত বাংলাদেশী টাকা থাকে সবই নিজের বাসায় অথাবা এয়ারপোর্টের বাইরেই ঘরের লোকদের দিয়ে দেয়। কেউ হয় ত আমার মত ২০ টাকা রেখে দেয় ভিতরে এক বোতল মিনারেল ওয়াটার কেনার জন্য। কারো কাছে অন্য দেশের টাকাও থাকে। বিশেষ করে যারা ভিজিট ভিসায় বেড়াতে যান, বেশীর ভাগ তাদের কাছেই বিদেশী টাকা থাকে। কিন্তু আমার ত বিদেশে চাকরী করি। দু’এক বছর কর্মরত থেকে তারপর দেশে বেড়াতে আসি। তাই বিদেশে যাওয়ার সময় শত করা আশিজন লোক দেশের টাকা পকেটে রাখে না। ভাবছি, বিপদ ত সামনে টাকার কথা মুখে সারে না। বিমান অফিসারকে কি দিয়ে বুঝাব। যার কাছে টাকা নাই তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এমন সময় আমার সামনের লোকটিকে দেখছি টিকেট পাশপোর্ট সাথে কুয়েতী দুই দিনার দিয়ে বলছে,’স্যার আমার কাছে বাংলা টাকা নাই, এই কুয়েতী দুই দিনার নিয়ে আমাকে এবারের মত পার করুন। এমনিতেই বিমান দেরীতে আসার জন্য ১৮ ঘন্টা এয়ারপোর্টে কাটিয়েছি। এখন যেতে পারলেই বাঁচি। লোকটার কথা শুনে বিমান অফিসার ঐ দুই দিনার নিয়ে বোর্ডিং কার্ড দিয়ে দিলো। লোকটি একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে তার বোর্ডিং কার্ডসহ পাশপোর্ট টিকেট নিয়ে এমিগ্রেশনের দিকে চলে গেলন। এবার আমার পালা। যাথারিতি আমিও কাউন্টারের উপর হাত রাখতেই বিমান অফিসার আমার টিকেট হাতে নিয়েই বললেন আপনার পদ্মাসেতুর ফি জমা দেওয়া নেই।
আমি বললাম- আমার কাছে কোন বাংলা টাকা নাই, আমি কি করে আপনাকে টাকা দিব ? আমার টিকেটটি মে মাসে নিয়েছি তখন এ ধরণের কোন চার্জ ছিলনা।
সে (বিমান অফিসার)- কেন, আপনি জানেন না জুলাই মাস থেকে সরকার ঘোষণা দিয়েছে ৫০০ টাকা করে পদ্মা সেতুর জন্য ফি দিতে হবে।
আমি বললাম- গত ১০/০৯/২০১৪ তারিখে মতিঝিল বিমান অফিসে আমার টিকিট রিকনফার্ম করতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে আমাকে প্রিন্ট রিসিট্ (পি এন আর) দিলেন। অথচ তারা তো বলেননি পদ্মা সেতুর জন্য ফি জমা দিয়ে যান, নইলে এয়ারপোর্টে আট্কাবে।
সে (বিমান অফিসার)- বললেন আপনি না জানলে আমার কিছু করার নাই, আপনি বরং ঐ দিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসুন।
আমি বললাম- দেখুন যার কাছে একান্তই টাকা নাই, তাকে কি আপনারা যেতে দিবেন না ? যদি কোন কারণে একজন লোক যেতে না পারে তাহলে তার যে পরিমান ক্ষতি হবে, আপনি কি সে ব্যপারে অবগত আছেন ?
সে (বিমান অফিসার)- দেখুন আমার এত কথা বলার সময় নাই, অন্যান্য পেসেঞ্জার যে ভাবে যোগার করে ফি জমা দিচ্ছে আপনিও সে ভাবে পারলে দিন, না হয় পরে আসুন।
এইবার আমি বললাম- দেখুন ১৪ ঘন্টা যাবত এই এয়ারপোর্টে আবার দুই ঘন্টার জন্য রেস্ট হাউজে গিয়ে ঘুরে-ফিরে আমরা প্রতিটি মানুষ খুব টায়ার্ড। আমি নিজেও টাকা না থাকা্র দরুন ভিষণ চিন্তিত। আমার কাছে কুয়েতি ২টি দিনার আছে, এই নিন, দয়া করে আমাকে বোর্ডিং কার্ড দিয়ে মুক্তি দিন। আমি এই দুই দিনারের কোন রিসিটও আপনার কাছে চাইব না। এবার আমাকে বিদায় দিন। এই কাথা শুনে, আমাকে যথারিতি বোডিং কার্ড দিয়ে দিলেন। আমি আর কোন রিসিটের ধার ধারিনি। কারণ আমি যেতে পারলেই বাঁচি। তবে কর্মরত অফিসার আমাকে বিমানের ভিতর ভাল জায়গায় বসার সিট্ করে দিয়ে এবারের জন্য তিনি আমার প্রতি দয়া করলেন।
তিরিশ বছর যাবত বিমানে যাওয়া আসা করছি, বিচিত্র অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চিত আছে। আমার এই সুদীর্ঘ কর্মজীবনে অন্যান্য প্রবাসীদের মত আমিও বৈদেশীক মূদ্রা অর্জনে দেশকে সহযোগিতা করে আসছি। দেশের প্রোয়োজনে আরো দিব। পদ্মাসেতুর জন্য ৫০০ টাকা দিতে কোন প্রবাসী কখনই মানা করবে না। কিন্তু আমরা বেশীর ভাগ কর্মজীবি প্রবাসীরা বিদেশে আসার সময় পকেটের টাকা-পয়সা ঘরে অথবা এয়ারপোর্টের বাইরে থেকেই পরিবারের কারও কাছে দিয়ে দেই। তাই জানা-অজানার মাঝে অজানাটা ভুল অথবা শুদ্ধ যাহাই হোক না কেন ! পদ্মা সেতুর টাকা পে করতে না পারলে এয়ারপোর্ট থেকে আসতে পারব না, এমনটি হতে পারে না। একজন নাগরিকের রুটি-রুজীর দায়-দায়িত্বের কথা চিন্তা করে কোন রাষ্ট্রই অনুদানের প্রশ্নে এমন কঠিন আইন করে না। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। যার জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। একজন বক্তির কঠর আচরণের জন্য মানুষ কষ্ট করবে, দূর্ভোগে পরবে, এটা কারোই কামনা নয়। তাই যে তারিখ থেকে পদ্মা সেতুর অনুদানের টাকা পে করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে। ইস্যুকৃত টিকিটের সেই তারিখ থেকেই প্রত্যেকটা যাত্রীর কাছ থেকে উল্লেখিত টাকা নেওয়া উচিত বলে মনে করি। যারা সরকারী ঘোষণার আগে টিকিট করেছেন তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা একজন প্রবাসীকে বিপদে ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। উপরন্ত জনকল্যাণমুলক যে কোন কাজের জন্য অনুদান ঘোষণার বাধ্য-বাদকতার সুযোগ নিয়ে নির্দয়-ভাবে অনেকেই দূর্নীতি করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করছে না।
পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। মানুষ ইন্টারনেট ও আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে বিদেশে বসেও টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে দেশের সমস্ত কবরা-খবর পেয়ে থাকে। প্রায়ই সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বক্তিবর্গ ও দেশের গুণিজনদের কথপ-কথনে শুনতে পাই, দেখতে পাই তাঁরা প্রত্যেকেই আলাপ চারিতায় অকপটে স্বীকার করেন প্রবাসীদের অবদানের কথা। বাংলাদেশের বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভের পরিমান বৃদ্ধির অন্যতম কারণ প্রবাসীদের পাঠানো রিমিটেন্সের দ্বারা। আমরা অত্যান্ত খুঁশি হই তাঁদের এই কথা-বার্তায়। কিন্তু দেশে অবকাশ কালিন ছুটিতে গেলে আমাদের নিরাপত্তা, চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর দেশে ফেরে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, এয়ারপোর্টে অযাচিত হেরাস্মেন্ট, এমনি কি আত্মিয় সজনরা আমাদেরকে এয়ারপোর্টে নিতে আসলে কখনো কখনো চিন্তাইকারী, সন্ত্রাসি ও মলমপট্টিদের খপ্পরে পরে সর্বসান্ত হয়ে যান। অবকাশ কালিন ছুটিতে গিয়েও অনেক প্রবাসী নাজেহাল হয়ে সন্ত্রাসিদের হাতে ক্ষুণ হয়ে যায়। সকল ব্যবস্থাপনা নিয়মতান্ত্রীক হলেও মানুষের উদাসিনতা কাটেনি। ভিতরে-বাহিরে উভয় দিকে শুধু খাই খাই দিন বা দিন বেড়েই চলছে। তবে আগের চেয়ে এয়ারপোর্টের ভিতরের অবস্থা অনেকটা ভাল মনে হয়েছে।
আমাদের যেহেতু প্রবাসী মন্ত্রনালয় আছে, তাই প্রবাসীদের নিরাপত্তা, জীবন-যাপন ও প্রবাসিদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সুক্ষভাবে কাজ করলে আমাদের আস্থার জায়গাটা আরো প্রসারিত হবে। যতটুকু আছে তা পর্যাপ্ত নয় বলেই প্রকৃত নির্ভরতার অবস্থানটা খুঁচ্ছি।
যাইহোক, আমার এই লিখার প্রধান উদ্দেশ্য এবারের ভ্রমন। বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স্। ‘আকাশে শান্তির নীড়’ সুন্দর একটি বাক্য। রুপকথার মত। যত কষ্টই হোক এই রুপকথার জাহাজটিতে যাতায়াত না করলে শান্তনা পাই না।নীজেদের বিমান।কত স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে আসি, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসাব-নিকাষ করে পেটের দায়ে একবার বিমানে চড়ে বিদেশে যাই আবার নাড়ীর টানে স্বদেশে ফিরে আসি।যাওয়ার সময় কান্না আর ফিরে আসার সময় সুখের হাসি এই দু’টই আমাদের সাথী।সামনে এগিয়ে যেতেই এমিগ্রেশন।আমার হাতে একটি সবজীর ব্যাগ। দেশ থেকে পটল, ঝিংগা, ভেন্ডি, কাকরোল, বটবটি ও কাগজি লেবু ইত্যাদি নিয়ে দুই মিনটের মধ্যে এমিগ্রেশনের কাজ সেরে বসার লাউঞ্জে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিলাম। কিছুক্ষণ পর ২০টাকা দিয়ে এক বতল মিনারেল ওয়াটার কিনে পানির পিপাসা মিটিয়ে নিলাম। এয়ারপোর্টের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত হেটে হেটে সুন্দরভাবে দেশী-বিদেশী পন্যে সাজান দোকানগুলি দেখতে লাগলাম। হঠাৎ আমার চোখে পরলো একটি ওয়ালের সাথে লাগানো কান্সার রোগিদের চিকিৎসার জন্য দানবাক্স। আমার কাছে অবশিষ্ট্য বাকী ২০টি টাকা ঐ দানবাক্সে ফেলে দিলাম। বিমান বন্দরের দুই জায়গায়ই এ রকম দুটি বাক্স অনেক টাকার ভিন্ন-ভিন্ন নোট দিয়ে প্রায় ভর্তি। এখানেও প্রবাসীদের দেশ এবং দেশের মানুষের প্রতি আবেগ ভালবাসার বহি প্রকাশ ঘটেছে। আমার মনে হয় প্রত্যেকটা যাত্রী ক্যান্সার রোগিদের কথা ভেবে এইসব দানবাক্সে কম-বেশী মুক্তহস্তে দিয়ে যায়। দান-অনুদান এ সবই থেকে যায় নিরাময় । মানুষের মৃত্যুর পরও ছদ্গায়ে জারি হিসেবে এই সমস্ত ভালকর্মগুলি মুক্তির পথ প্রসারিত করে। আমি চুপ-চাপ সাজানো কুর্ছির এক কোনায় বসে বসে ভাবছি, এমন সময় স্পিকারে সুন্দর একটি নারীকন্ঠে ডাক আসলো ” বাংলদেশ বিমান ০৪৩ কুয়েতের উদ্দেশ্যে শিগ্রই ছেড়ে যাবে। কুয়েত গামী যাত্রীরা সব বিমান বন্দরের ৩ নাম্বার গেইট দিয়ে প্রবেশ করুন”। সবাই লাইন ধরে একে একে চেক-আপ হয়ে সর্বশেষ লাউঞ্জে গিয়ে বসলাম। প্রায় আধা ঘন্টা পর বিমানে ঠুকে যার যার বোর্ডিং কার্ড দেখে বিমানের কেবিন ক্র যাত্রীদের নিজ নিজ সিটে বসিয়ে দিলেন। এবার সিট্ বেল্ট বাধার অনুরোধ আসলো। সিট্ বেল্ট বেধে যাত্রীরা সব নিরবে বসে আছে। কারণ সবাই টায়ার্ড। বিমানের সিডিউল বিপর্যয়ে ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা যাত্রীদের যাত্রা পথে অপেক্ষা করা অত্যান্ত যন্ত্রনাদায়ক, অতি কষ্টের সময় অতিবাহিত করা ছাড়া আর কি হতে পারে ? তারপরও পবিত্র হজ্জের কথা চিন্তা করে এবং বারতি হজ্জ ফ্লাইট আসা-যাওয়ার কারণে অন্যান্য যাত্রীরা সব দুঃখ-কষ্ট মেনে নিয়েছেন। অনেকেই মহান আল্লাহ্র কাছে শুকরিয়া আদায় করছেন, তবুও আমরা রওনা দিতে পারলাম। বিমান রানওয়ের পথ দিয়ে চলছে। এবার উপরে উঠার পালা। আমি দোয়া-দরুদ পরতে লাগলাম। বিমান ধাপে ধাপে উড়তে উড়তে আকাশে মেঘের দেশ দিয়ে চলতে লাগলো। আমরা স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে আরামে বসলাম। কতক্ষণ পর খাবার আসলো। এবারের খাবারটা খুব মজা ছিল। সাদা পোলাউ, বোনলেস্ মুরগীর ভুনা সাথে তাঁজা শশা, কাঁচামরিচ খুব মজা করে খেলাম। অবশ্য পেটে যথেষ্ট ক্ষুধাও ছিল। পরে একটু লিপ্টন চা খেয়ে শরীরটাকে চাঙ্গা করে নিলাম। এবার এক টানা দুই ঘন্টা ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুম থেকে উঠে চোখে পড়লো বিমান থেকে প্রকাশিত কালারফুল “বিহঙ্গ” পত্রিকাটি। পড়ে খুব ভাল লাগলো। এ যাত্রায় কেবিন ক্র আপু দুইজন খুব ভাল ছিল। হাসীমুখ কিছু চাওয়া মাত্র সাথে সাথে পরিবেশন করতেন। আমার শীত লাগছিল। একজন আপু বুঝতে পেরে আমাকে একটি কম্বল এনে দিলেন। আমি অনেক ধন্যবাদ দিলাম তাকে। আসলে মানুষের দুঃখ-কষ্ট বুঝতে পারাই উত্তম সেবা।
প্রায় পাঁচ ঘন্টা বিমান চলার পর বিমানের ক্যাপ্টেন মাজহার (নামটা যদি ভুলে না হয়ে থাকি) ঘোষণা দিলেন। “ভদ্রমহোদয়-ভদ্রমহিলাগণ আমরা আর কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে কুয়েত আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে অবতরণ করবো। আমি অত্যান্ত দুঃখিত যে আপনাদেরকে সঠিক সময় মত কুয়েতে পৌঁছাতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করবেন”। বিমান ক্যাপ্টেন’র এই বিনয়ী মনভাবের কথা শুনে আমি অত্যান্ত মুগ্ধ হলাম। এ যাত্রায় যত কষ্টই হোক না কেন, সব ভুলে গেলাম।
আধ ঘন্টা পর বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স কুয়েত এয়ারপোর্টে লান্ডিং করলো। যাত্রীরা সব ক্র’দের বাই বাই জানিয়ে নেমে গেলো। আমিও সবার আগে-ভাগে নেমে গেলাম। জীবন- জীবিকার তাগিদে এই যে আসা-যাওয়ার পালা, চলছে চলতে থাকবে। কিন্তু পদ্মাসেতুর টাকাটা ফান্ডে না গিয়ে গেলো একজনের পকেটে। সেতু হবে কি না জানি না, তবে পদ্মা পারের মানুষ এখন ভাঙ্গোনের কবলে।
নদী ভাংতে পারে, ঝড়-বৃষ্টি-শিলা পরে জমিনের ফসল নষ্ট হতে পারে, বন্যায় ফসলাদি পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। প্রকৃতিক দুর্যোগ ও রাজনৈতিক কারণে জন জীবন বিপন্ন হতে পারে কিন্তু প্রবাসীদের রিমিটেন্স প্রবাহ কখনই থেমে থাকবে না। সারা বছরই দেশে অর্থনৈতিক মুক্তির ভিত্ শক্তিশালী করে চলবে। দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে যাদের ভূমিকা অপরিসীম তাদের প্রতি বাংলাদেশ সরকার এবং সংস্লিষ্ট সকলকে আন্তরিকতা ও ভাল সার্ভিস দিয়ে দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়িয়ে আস্থা অর্জন করা উচিত।
Discussion about this post