প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেছেন, আগামীতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেও ভারতের সঙ্গেও আইনি লড়াইয়ে বিজয়ের মাধ্যমে সমুদ্রে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, ‘মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয় আমার একার নয়। কতিপয় বিরোধিতাকারী ও স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া এ বিজয় বাংলার ১৬ কোটি মানুষের।’ শেখ হাসিনা বুধবার বিকালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে তাকে দেওয়া সংবর্ধনার জবাবে এ কথা বলেন। সংবর্ধনা দেয় যুবলীগ, যুবমৈত্রী, যুব মহিলা লীগ, বাংলাদেশ যুব আন্দোলন, জাতীয় যুব ঐক্যসহ মোট সাতটি যুব সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত যুব সংগ্রাম পরিষদ। প্রধানমন্ত্রী তার ৩৫ মিনিটের বক্তব্যে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মডেল হিসেবে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে আরো বলেন, ‘আমরা আমাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার রূপকল্প ২০২১ অনুসারে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলবো।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ২০২১ সালে এ দেশ হবে একটি দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও ডিজিটাল দেশ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালেই মায়ানমার-ভারতের কাছ থেকে সমুদ্রে আমাদের ন্যায্য অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। তাকে হত্যা করে ক্ষমতায় আসা স্বাধীনতাবিরোধী পক্ষ সে অধিকারের আইনি স্বীকৃতি আনতে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। ১৯৮২ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা আইন করেছে, যার প্রেক্ষাপট দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালেই রচনা করে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৮২ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা আইন অনুসারে ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকার সমুদ্রে ন্যায্য পাওনা আদয়ের ব্যবস্থা করে রেখে গেলেও পরবর্তী সরকার তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়নি। এবারের আওয়ামী লীগ সরকার আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে এ ব্যাপারে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে সমুদ্রে আরেকটি বাংলাদেশ অর্জন করে এনেছে। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘বিজয় পাওয়া সমুদ্রের ব্লক, গ্যাস, তেল ও জলজসহ সব সম্পদের মালিক এখন বাংলাদেশ। এখন আমরা সেসব সম্পদ উত্তোলন করে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাবো। কেউ আমাদের বাধা দিতে পারবে না। কেউ আমাদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারবে না।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিরোধী দল এ বিজয় অর্জনকেও সহ্য করতে পারছে না। সারা জাতি যখন সমুদ্র বিজয়ে উল্লাস-উচ্ছ্বাস করছে তখন তারা এ থেকে কি বিজয় এসেছে তার বিচার শুরু করেছে। তারা জাতিকে বিভ্রান্ত করে এ বিজয় নস্যাতের ষড়যন্ত্রে নেমেছে বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অথচ তারা ক্ষমতায় থাকতে এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। শেখ হাসিনা বিরোধী দলের সমালোচনা করে আরো বলেন, ‘সমুদ্রে অধিকার প্রতিষ্ঠা করার আগেই বিরোধী দল তেল-গ্যাস ও ব্লক টেন্ডার দেয়। এটা এক ধরনের ভাওতাবাজি, ধোঁকাবাজি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিরোধী দল কিছু দিতে পারে না। খালি নিতে পারে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলে মানুষ কিছু পায়।’ বিরোধ দলীয় নেতার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সমুদ্র বিজয়ে সরকারকে ধন্যবাদ দিয়ে আবার প্রত্যাহার করে নিলেন। এটা দুর্ভাগ্যজনক। আপনি সমস্ত জাতিকে বিভ্রান্ত করছেন। দয়া করে এটা বন্ধ করুন।’ পরশ্রী কাতরতা-ষড়যন্ত্র বন্ধ করে উন্নয়নে সামিল হতেও বিরোধী দলীয় নেতার প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন, নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করে জনগণের ক্ষমতায়নকে আরো শক্তিশালী করেছে।’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও আওয়ামী লীগের জনকল্যাণ নীতি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে নিজেদের অধিকার নিশ্চিত করতে একমাত্র আমরাই পারি।’ ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের রায় ঘোষণা করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালে জনগণের সেবা করার সুযোগ পেলে ভারতের সঙ্গে রায়েও বিজয় ছিনিয়ে আনবো, সে বিশ্বাস আমাদের আছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এদেশের সন্তান হয়ে যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে আমার মা-বোনদের তুলে দিয়েছিল, যারা অগ্নিসংযোগ, লুটপাট চালিয়েছিল তাদের বিচার শুরু হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বাংলার জনগণকে অভিশাপমুক্ত করবো।’ সংবর্ধিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকের এই সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে যুব-সংগ্রাম পরিষদ সারা বাংলার জনগণকে সংবর্ধনা দিয়েছে। আজকের এই অর্জন পুরো বাংলাদেশের অর্জন।’ তিনি জাতীয় উন্নয়নে যুবকদের এগিয়ে আসারও আহবান জানান। তিনি সমুদ্রসীমা অর্জনের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নৌবাহিনী, এবং আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের ধন্যবাদ জানান। শেখ হাসিনা বক্তৃতার শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদদের প্রতি স্মৃতিচারণ করেন। বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে তিনি ২০২১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়তে সকলের দোয়া ও সহযোগিতা চান। এর আগে বিকাল পৌনে ৪টায় সমুদ্র বিজয়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যুব-গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। বিকাল সাড়ে ৪টায় তাকে দেওয়া সংবর্ধনা নিতে সংবর্ধনা মঞ্চে উঠলে শত শত বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে উপস্থিত লাখো নেতাকর্মী। এরপর প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে মানপত্র পাঠ ও তাকে মানপত্র দেওয়া হয়। তাকে সংবর্ধনা ক্রেস্ট উপহার দেন যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর নেতৃত্বে আয়োজক যুব সংগ্রাম পরিষদ নেতারা। বিকেল সোয়া ৫টা থেকে ৫টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি, সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করছেন যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী।এছাড়া যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ মির্জা আজম এমপি, জাতীয় যুব ঐক্যের নেতা মোঃ খায়রুল আলম ও যুব মহিলা লীগের সভানেত্রী নাজমা আক্তারসহ আয়োজক সংগঠনগুলোর নেতারা বক্তব্য দেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে অনুষ্ঠানের সভাপতি যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী তার বক্তব্য শেষে উপস্থিত জনতাকে সমুদ্র বিজয়সহ দেশের সকল অর্জন ধরে রাখা এবং সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে একটি সমৃদ্ধশালী, অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার শপথ পাঠ করান।
ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন থানা-ওয়ার্ড থেকে মিছিল সহকারে সংবর্ধনাস্থল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে আসেন আয়োজক যুবলীগের নেতৃত্বাধীন যুব সংগ্রাম পরিষদসহ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এছাড়া আমন্ত্রিত মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, জাতীয় সংসদ সদস্য, ১৪ দলের কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতা, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসাবিদ, আইনবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষও অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন। ফলে লাখো জনতার মহাসমাবেশে পরিণত হয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।
Discussion about this post