মো: মোস্তফা কামাল
বৃটেনে উচ্চশিক্ষার্থে আসা বাংলাদেশি ছাত্ররা ইমিগ্রেশনের পরিবর্তিত আইনে বিপাকে পড়েছে। অনেক ছাত্রই নিরুপায় হয়ে বৃটেন ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। কেউ দেশে ফিরে যাচ্ছে। আবার কেউ পাড়ি জমাচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলোতে। বৃটেনে অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থীদের ওপর নানা কড়াকড়ি আরোপের নতুন এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে, ওয়ার্ক ভিসার ওপর কড়াকড়ি এবং অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে ১৪০ মিলিয়ন পাউন্ডের একটি তহবিল গঠন। বৃটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাড ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, যে সব চাকরি বৃটিশ জনগণের পাওয়া উচিত সেগুলো যেন বিদেশি কর্মীরা না পায়। পরে বিষয়টি ¯পষ্ট করে জানানো হয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কি অনুপাতে বিদেশি কর্মীদের নিয়োগ দিচ্ছে তা প্রকাশের একটি বাধ্যবাধকতা যোগ করা হবে। এ খবর দিয়েছে গার্ডিয়ান। ব্রেক্সিট চূড়ান্ত হওয়ার আগে অভিবাসন কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা হিসেবে নতুন এসব কড়াকড়ি আরোপের ঘোষণা দেয়া হয়েছে বলে খবরে বলা হয়। প্রতি বছর বৃটেনে আসা ৬ লাখ অভিবাসীদের মধ্যে ১ লাখ ৬৭ হাজার ইউরোপের বাইরের দেশগুলো থেকে আসে। রাড বলেন, তার মন্ত্রণালয় দ্রুতই নতুন স্টুডেন্ট ইমিগ্রেশন সিস্টেম নিয়ে আলোচনা করবে। একইসঙ্গে আমলে নেয়া হবে শ্রম বাজার কড়াকড়ি করার বিষয়টি। নতুন ব্যবস্থার অধীনে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদেশি কর্মী নিয়োগের আগে অনুমোদন পেতে হবে। অ্যাম্বার রাড বলেন, বৃটিশ জনগণ যে কাজ করতে সক্ষম সে কাজগুলো যেন বিদেশি শ্রমিকরা না পায় সেটা নিশ্চিত করতে এ ব্যবস্থা। তিনি আরো ঘোষণা দেন, এ বছরে আইনের অধীনে বাধ্যতামূলক অভিবাসন অবস্থা যাচাই করার বিষয়টি কার্যকর হবে ডিসেম্বর মাস থেকে।
নতুন নীতি অভিবাসীদের জন্য বেশ খানিকটা কঠিন হয়ে দাড়াবে। যারা অবৈধ অভিবাসী তাদের জন্য বাধ্যতামূলক জেল। যারা অবৈধ ব্যবসা চালাবে তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেয়া হবে। যারা অবৈধ অভিবাসীদের চাকরি দেবে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বন্ধ করে দেয়া হবে এবং জরিমানা করা হবে। আইন ভঙ্গকারীদের জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। নতুন এই নীতি ব্রিটেনকে অভিবাসীদের জন্য অসুখী দেশে পরিণত করবে বলে অনেকে মনে করছেন। বিশেষ করে যারা অবৈধ অভিবাসী এতদিন আইনের ফাঁক ফোকর ব্যবহার করে এখানে বসবাস করছে তাদের সময় শেষ। যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে তাদেরকেও জেলে পাঠানো হবে এবং দেশে ফেরত পাঠানো হবে।বৃটিশ ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ (ইউকেবিএ) অভিবাসনের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ, স্টুডেন্ট ভিসায় কাজের সুযোগ বন্ধ, ওয়ার্ক পারমিট হ্রাস এবং ভিসা জটিলতার কারণে লন্ডনে বিভিন্ন বিষয়ে পড়তে আসা ও পড়ালেখা শেষে বিভিন্ন পেশায় কর্মরতাদেরও একপ্রকার বাধ্য হয়েই বৃটেন ছাড়তে হচ্ছে। বাড়িভাড়া, যাতায়াতসহ জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় এবং আয় কমে যাওয়ায় ছাত্রদের এখন সেখানে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। জানা যায়, এ বছর ৪ জুলাই থেকে বৃটিশ ইমিগ্রেশন কতৃপক্ষ (ইউকেবিএ) ছাত্রদের কাজের সুযোগ বন্ধ করে টিয়ারফোরের জন্য কঠোর ইমিগ্রেশন নীতিমালা কার্যকর করেছে। নতুন নিয়মে সরকারি অর্থে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে পড়তে আসা শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র কাজের সুযোগ পাবে। প্রাইভেট কলেজের বিদেশী শিক্ষার্থীরা কাজের সুযোগ পাবে না। এমনকি তারা ডিপেন্ডেন্ট আনতেও পারবে না। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা যাদের কোর্সের মেয়াদ ১২ মাসের বেশি তারাই নির্ভরশীল ব্যক্তিকে (স্বামী, স্ত্রী, সন্তান) বৃটেনে আনতে পারবে। বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলংকান মালিকানাধীন অনেক প্রাইভেট কলেজ গড়ে উঠেছে বৃটেনে। এসব কলেজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী বৃটেনে পড়তে আসে। শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগই পড়ালেখার পাশাপাশি পার্টটাইম চাকরি করে টিউশন ফি দিয়ে থাকে। এতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী যেমন লাভবান হয় তেমনি বৃটেন সরকারও লাভবান হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি কাজ করে ট্যাক্স প্রদান, যানবাহন ব্যয়, পণ্য কিনে যে অর্থ ব্যয় করে তার পরিমাণ বিলিয়ন পাউন্ড। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা শেষে পোস্টস্ট্যাডি ওয়ার্কের আওতায় দু’বছর ফুল টাইম চাকরির অধিকার পেত। নতুন নিয়মে এমন সুযোগগুলো আর থাকছে না।শিক্ষার্থীদের এসব সমস্যা নিরসনে আইনি লড়াই শুরু করেছে এউকেপিএসসি নামের একটি সংগঠন। বাংলাদেশি মালিকানাধীন ব্রিট কলেজের সিইও মোসাদ্দেক আহমদ জানান, নতুন নিয়মের কারণে আকস্মিক বৃটেনে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই শিক্ষার্থীদের ওয়েলফেয়ারকে গুরুত্ব দিয়ে শতাধিক কলেজ মালিকদের সমন্বয়ে গঠিত এসোসিয়েশন (এউকেপিএসসি) ইউকেবিএ’র অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু করেছে। আইনি লড়াইয়ে জয় পাওয়ার ব্যাপারে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।বৃটেনের অভিবাসন মন্ত্রী জানিয়েছেন, অভিবাসী শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে ২০ ঘন্টার বেশী চাকরী করতে পারবেনা। যদি তারা অমান্য করে তাহলে তাদের জেলে যেতে হবে। তিনি আরো বলেন, নতুন অভিবাসন নীতিতে ব্রিটেন সরকার অভিবাসীদের এদেশে আসা বন্ধ করতে চায়না বরং আরো বেশী শ্রমিক আনতে চায়। কিন্তু তা বৈধ উপায়ে হতে হবে। তাদেরকে ব্রিটেনের অভিবাসন আইন মেনে চলতে হবে। নইলে ব্রিটেন তাদের জন্য যন্ত্রনাদায়ক একটি দেশে পরিণত হবে। বৃটিশ লাল পাসপোর্ট পেতে হলে অভিবাসীদের জানতে হবে বৃটেনের ইতিহাস ঐতিহ্য, রাজনীতি, সাহিত্য, ধর্ম ও সংস্কৃতির নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জানতে হবে বৃটেনে অতীতে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার বিবরণ। মুখস্থ করতে হবে জাতীয় সঙ্গীতের প্রথম স্তবক গড সেইভ দ্যা কুইন। জানতে হবে উইলিয়াম সেক্সপিয়ার থেকে নিয়ে বায়রন ও বিটলস সম্পর্কে। ট্রাফালগার বা ওয়াটার লুর যুদ্ধ কিংবা জেমসের বাইবেল সংক্রান্তও ধারণা রাখতে হবে। নতুন এই আইনে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বাংলাদেশ থেকে বিবাহ সূত্রে আগত অভিবাসীরা। পাশাপাশি যারা এ দেশে বহুদিন ধরে আছেন অথচ বাংলাদেশি পাসপোর্ট রয়েছে। এমনকি যারা বৃটিশ পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেননি কিংবা অবহেলায় এতোদিন করতে পারেননি। তারাই এই বিপদে পড়বেন। এমনও অনেক প্রবাসী বাংলাদেশিরা আছেন যারা ১০-১৫ কিংবা ২০ বছর ধরে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বসে আছেন। অবহেলা ও খামখেয়ালিপনায় বৃটিশ পাসপোর্ট আবেদন করেননি। তারাই এখন সবচেয়ে বড় বিপদের মধ্যে পড়েছেন।
নতুন এই আইনের ফলে বর্তমানে কমিউনিটিতে লাল পাসপোর্ট বা বৃটিশ পাসপোর্ট আবেদনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে।অভিজ্ঞ মহলের ধারণা যে, এই আইনের কারণে ইউরোপের বাইরের অভিবাসন আবেদন ৪৫% শতাংশ কমিয়ে আনবে। মনে রাখতে হবে যে, অভিবাসনের সিংহ ভাগ কিন্তু ইউরোপীয়। মাত্র ১৮% শতাংশ ইউরোপের বাইরের। এটাও লক্ষণীয় যে এই পরিবর্তন কেবল ইউরোপের বাহিরের লোকজনের ব্যাপারে প্রযোজ্য হবে, অর্থাৎ ইউরোপের কোন দেশে স্বামী/স্ত্রী আনতে প্রয়োগ করা হবে না। এই আইন কম আয়ের পরিবারগুলোকে বিচ্ছিন্ন রাখবে এবং তাদের জীবনে অনেক রকমের অশান্তি বয়ে আনবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন পরিকল্পনার ঘোষণা আসার পর বিরোধী লেবার দলসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা এর তীব্র সমালোচনা করেছেন। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপের সহ-সভাপতি পল ব্লোমফিল্ড এটাকে পাগলামি বলে আখ্যা দিয়েছেন। শেফিল্ড সেন্ট্রালের লেবার এমপি বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যে আমি বিস্মিত। তিনি আরো বলেছেন, ইউকেতে আমাদের কতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেটা তার জানা আছে বলে মনে হয় না। তিনি বর্তমান নিয়মকানুনও ঠিক বোঝেন বলে মনে হয় না, যেগুলোর জন্য তারই ভূমিকা রয়েছে। আর আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরে পড়াশোনা করছে সেখানে তারা কি বিরাট অবদান রাখছে সেটা বোধগম্য হওয়া তো দূরের কথা। তিনি আরো বলেন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর বৃটিশ অর্থনীতিতে ৮০০ কোটি পাউন্ড এনে দিচ্ছে। হাজার হাজার কর্মসংস্থান তৈরি করছে তারা। এতসব কিছুর পরও বৃটিশ সরকার কি পদক্ষেপ নেন সেটার দিকে তাকিয়ে লাখ লাখ অভিবাসী।
Discussion about this post