মঈন উদ্দিন সরকার সুমন :: অনেক বাংলাদেশি শ্রমিককে কয়েক বছর আগেও কুয়েতের অলিতে গলিতে পেপসি ক্যান টোকাতে দেখা যেত। স্বল্প বেতনে সংসারের চাপ কুলাতে না পেরে অনেক প্রবাসী বেছে নিত অন্যায়ের পথ। কথায় আছে অভাবে স্বভাব নষ্ট। আর এর ফলে বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে কুয়েতে অপরাধের তালিকায় শীর্ষস্থানে থাকাতে দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর কুয়েতে বাংলাদেশের শ্রমিক নিয়োগে বাধা ছিল। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি ও কুয়েত সরকারের আন্তরিকতায় এবং কিছু প্রবাসী বাংলাদেশির সহযোগিতায় কুয়েতে বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগের প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়। বছর দুইয়ের মধ্যে অর্ধলক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিক নতুন ভিসায় কুয়েতে এসেছেন। প্রথম অবস্থায় তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ দিয়ে কুয়েত এলেও বর্তমানে খরচ সাত লাখের ওপরে দাঁড়িয়েছে। কুয়েতে শ্রমিক প্রেরণে বর্তমানে কোনো নীতিমালা না থাকায় বা থাকলেও যথাযথ প্রয়োগ না থাকার কারণে হাতবদলের পালায় পড়ে ভিসার মূল্য এখন আকাশচুম্বী হতে যাচ্ছে। রাতারাতি পয়সাওয়ালা হওয়ার আশায় কিছু প্রবাসী মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছেন। তাদের অনেকেই জানেন না কোন কোম্পানির ভিসা বের হচ্ছে, কোথায় বা কী কাজ, বেতন কত। সঠিক তথ্য না জেনে পরিচিত বিভিন্নজনের কাছ থেকে পাসপোর্ট এবং টাকা সংগ্রহ করে জমা দিচ্ছেন আরেকজনের কাছে। এই চক্রাকারে অনেক মধ্যস্থতাকারী ও সাধারণ মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। ক্রেতারা ভিসা নিয়ে টাকা পরিশোধ করার পর জানতে পারে ওই ভিসা বাতিল করা হয়েছে। এই নিয়ে কত ধরনের প্রতারণা চলছে, ভুক্তভোরীরাই বলতে পারবেন। ভেরিফিকেশন, মেডিকেল চেকআপসহ পদে পদে প্রত্যেকটি কাজ সারাতে হয়রানির শিকার হন বিদেশগামীরা। কিছুদিন আগে মিডিয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, পাসপোর্টের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনে হয়রানি হয়। তারা টাকা ছাড়া কাজ করে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টা খতিয়ে দেখবে বলে জানান। অন্যদিকে সৌদি আরবে কর্মী পাঠানোর জন্য সরকার-নির্ধারিত খরচের চেয়ে বেশি টাকা নিলে সেই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি। এ ক্ষেত্রে কুয়েতের ভিসার খরচটা সরকার কর্তৃক নির্ধারণ হলে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে থাকত কুয়েতে আসা। ভিসার মূল্য পরিশোধে স্থানীয়ভাবে একটি বড় অঙ্কের টাকা পাচার হয়। যা রেমিটেন্স খাতে প্রভাব ফেলে। মজুরি উপার্জনকারী, অর্থ প্রেরণকারী নির্বাচিত দেশ কুয়েত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে ১১০৬.৮৮ মিলিয়ন ইউএসডি, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ১০৭৭.৭৮ মিলিয়ন ইউএসডি, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ১০৩৯.৯৫ মিলিয়ন ইউএসডি রেমিটেন্স আয় করে কুয়েত থেকে। এই হিসেবে ২০১৫ সালে ২৯.১ মিলিয়ন, ২০১৬ সালে ৩৭.৮৩ মিলিয়ন ইউএসডি রেমিটেন্স হ্রাস পায়। এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। অর্থবছর ২০১৬-২০১৭ জুলাই ৮০.০৩, অর্থবছর ২০১৬-২০১৭ আগস্ট ৮৭.৬৯, অর্থবছর ২০১৬-২০১৭ সেপ্টেম্বর ৭৮.১২, অর্থবছর ২০১৬-২০১৭ অক্টোবর ৮৭.৭৩, অর্থবছর ২০১৬-২০১৭ নভেম্বর ৮৫.৮৩, অর্থবছর ২০১৬-২০১৭ ডিসেম্বর ৮৫.৪৭, অর্থবছর ২০১৬-২০১৭ জানুয়ারি ৮৪.১৬, অর্থবছর ২০১৬-২০১৭ ফেব্রুয়ারি ৭৫.৩০, অর্থবছর ২০১৬-২০১৭ মার্চ ৮৩.৮০, অর্থবছর ২০১৬-২০১৭ এপ্রিল ৮৭.৯৩ মিলিয়ন ইউএসডি রেমিটেন্স যোগ হয় কুয়েতে থেকে। ২০১৬-২০১৭ জুলাই থেকে এপ্রিল অব্দি রিপোর্টে দেখা যায়, প্রতি মাসে গড়ে ৩.০৫৬ মিলিয়ন ইউএসডি হ্রাস রেমিটেন্স খাতে কুয়েত উপার্জনকারী দেশ হিসেবে। অনেকের সঙ্গে আলোচনা করে বোঝা যায়, কুয়েত থেকে রেমিটেন্স প্রেরণে হ্রাসের কারণ হিসেবে তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, প্রবাসী শ্রমিকদের ওভারটাইম কমে যাওয়া, আকামা নবায়নসহ বিভিন্ন ফি কোম্পানিকে পরিশোধ করা রেমিটেন্স খাতে প্রভাব পড়লেও সবচেয়ে বড় প্রভাব ভিসার উচ্চ মূল্যকে দায়ী করেন অনেকে। যেই ব্যক্তি নতুন ভিসা নিয়ে কুয়েত আসেন তার দুই থেকে প্রায় আড়াই হাজার কুয়েতি দিনার খরচ হয়েছে কুয়েত আগত অসংখ্য নতুন প্রবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। এই খরচের বড় একটি অংশ কুয়েতে পরিশোধ করতে হয়েছে তাদের। এই মূল্য পরিশোধে অবৈধভাবে হুন্ডির পথ বেছে নিয়েছেন। অন্যদিকে স্থানীয় আইনে বেতনের বেশি টাকা পাঠানো বাধা থাকাতে হুন্ডি ও বিকাশের মতো পথ বেছে নেন প্রবাসীরা। ভিসা ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত অসংখ্য ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে কিছুটা নিশ্চিত হওয়া যায় একটি ভিসা বের করতে বাংলাদেশের এক লাখ টাকার মতো খরচ হয়। ভিসা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মধ্যস্থতাকারী অনেকে যাঁরা মাঠে তৃণমূল ব্যবসা করেন, তাঁরা বলেন হাতে গোনা কয়েকজনের সিন্ডিকেট করে এর মূল্য নির্ধারণ করে রেখেছেন। প্রবাসীরা মনে করেন, এখনই সময় পদক্ষেপ নিয়ে এই সিন্ডিকেট চক্রকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের। হুমকির মুখে কুয়েতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার রক্ষায় সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন মনে করেন দেশপ্রেমিক প্রবাসীরা। যদিও কুয়েতের আইনে ভিসা বেচাকেনা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। স্থানীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে ভিসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত আটক, কিছু কোম্পানি শ্রমিকদের বেতন ঠিকভাবে দিচ্ছে না, অনেক কোম্পানির লোকজনের কাজ নেই ইত্যাদি। কথা হলো, কুয়েতে ভিসা বিক্রি নিষেধ তা হলে কী কারণে সাত লাখ টাকা ভিসার মূল্য? জানা যায়, কোনো এক কোম্পানিতে ভিসার জন্য এক ব্যবসায়ী চুক্তি করে আসার পর আরেক ব্যবসায়ী ওই ভিসা কেনার জন্য মূল্য বাড়িয়ে দেন। অনেকের সাথে কথা বলে জানা যায়, ভিসা বের হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা এর গোপনীয়তা রক্ষা করার চেষ্টা করেন। কারণ জানতে চাইলে বলেন, একজন চুক্তি করলে অন্যজন মূল্য বাড়িয়ে দেন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইনের শ্রমিক এত কম বেতনে আসতে চায় না। শ্রমিক চাহিদা মেটাতে ওই দেশের শ্রমিকের বিমান ভাড়া পর্যন্ত বহন করে। সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশের ভিসার মূল্য সাত লাখ টাকা। বাংলাদেশ সরকার প্রায় সব দেশের ক্ষেত্রে বিদেশে যেতে খরচের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। কুয়েতের বিষয়টা অতিদ্রুত সরকারের নজরে আসা দরকার। সম্প্রতি কিছু ঘটনা শোনা যায়, দূতাবাসও এর সত্যতা স্বীকার করেছে যে কয়েকটি কোম্পানিতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের আকামা (ওয়ার্ক পারমিট) হয়নি। এদের মধ্যে দশ মাস হয়েছে এমন শ্রমিকও আছে। তা ছাড়া কিছু শ্রমিক নিয়মিত বেতন পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে হয়তো বিগত দিনের চিত্র আবার কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেখতে পাবেন। কুয়েতস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস কেন, সব মিশনই অনেক শক্তির অধিকারী কারণ দূতাবাস দুই দেশের সরকারের সহযোগিতা পায়। তারা ইচ্ছা করলে যে কোনো অপরাধীকে সহজেই চিহ্নিত করতে পারে এবং শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে। কুয়েতে শ্রম আইনে একজন শ্রমিক দৈনিক আট ঘণ্টা সপ্তাহে ছয়দিন কাজ একদিন ছুটি। ওভার টাইম করলে প্রতি ঘণ্টায় সোয়া এক ঘণ্টার হিসেবে পারিশ্রমিক দেওয়ার নিয়ম। কুয়েত শ্রম আইন অনুযায়ি কুয়েতে প্রত্যেক শ্রমিকের বেতন মাস শেষে ব্যাংকের মাধ্যমে কোম্পানিকে পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক। কুয়েত শ্রম আইনের অনুচ্ছেদ তিন এর ৭০ ধারায় বছরে ৩০ দিন বেতন সহকারে ছুটি পাবে। শ্রমিকদের সুবিধার্থে কুয়েত সরকার অনেক আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছে। অনেকে আইন না জানার কারণে বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের পাওনা থেকে। অন্যদিকে কিছু কর্মকর্তা তাদের এই পাওনা অন্যভাবে তুলে নিচ্ছে নিজ ক্ষমতাগুণের বলে। শ্রমিকদের পাওনা ও সমস্যা সমাধানে দূতাবাসের করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে দূতাবাস কর্মকর্তারা বলেন, তাঁরা শ্রমিকদের যে কোনো সমস্যা স্থানীয় আইন অনুযায়ী সমাধানের চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে দূতাবাস থেকে সত্যায়িত করে ভিসা নিয়ে যে সকল শ্রমিক কুয়েত এসেছেন তাদের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হলে ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে যে কোনো পদক্ষেপ সহজে নিতে পারে দূতাবাস, কারণ তাঁরা কোনো ভিসা সত্যায়িত করার আগে ওই কোম্পানির সুযোগ সুবিধা বাসস্থানসহ যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। সে কারণে খুব সহজেই এর সমাধান দিতে পারেন। বড় সমস্যা হয় যে সব শ্রমিক কুয়েতের দূতাবাসের সত্যায়িত ব্যতীত বাংলাদেশ থেকে চলে আসেন সেই সব শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে তেমন একটা জোর ক্ষমতা চালাতে পারে না দূতাবাস। বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রত্যেক ভিসা দূতাবাসের সত্যায়িত বাধ্যতামূলক করে যে কোনো সমস্যায় দূতাবাসের জবাবদিহিতা সরকার কর্তৃক মনিটরিং ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করলে হয়তো কিছুটা লাঘব হবে বলে সাধারণ প্রবাসীরা মনে করেন। লেখক : প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক
Discussion about this post