কাজী সোহাগ: প্রতিবেশী দেশ ভুটান থেকে দেশে ফিরে আসছেন শ্রমিকরা। কাজ নিয়ে সেখানে গেলেও ফিরছেন বেকার হয়ে। বৈরী আবহাওয়া, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা আর বৈষম্যের কারণে ভুটানে টিকতে পারছেন না বাংলাদেশী শ্রমিকরা। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। টাকা খরচ করে চাকরির নিশ্চয়তা পাচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে পড়ছেন নানা বিপাকে। ভুটানে কাজ করতে আগ্রহী শ্রমিকদের নিয়ে অন্যরকম প্রতারণা করে চলেছেন এদেশীয় কিছু আদম ব্যবসায়ী। বেশির ভাগ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ব্যানার বাদ দিয়ে ব্যক্তি উদ্যোগে এ ধরনের প্রতারণা করছেন। ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে কাজ করতে আসা বেশ কয়েক শ্রমিক জানালেন, মাত্র দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে তারা এ দেশে এসেছেন জীবিকা নির্বাহ করতে। আসার সঙ্গে সঙ্গে কাজও পাইয়ে দেয়া হয়েছে। তবে আমাদের দেশের শ্রমিকদের জন্য এখানে কাজ করা খুবই কষ্টদায়ক। ভুটানের প্রত্যন্ত এলাকায় আমাদের কাজ করতে পাঠানো হচ্ছে। সেখানে আবহাওয়া সব সময় থাকছে মাইনাসে। অবিরাম বরফ পড়ে। সংশ্লিষ্ট আদম ব্যবসায়ীরা আগে থেকে এ ধরনের পরিস্থিতির কথা আমাদের জানাননি। তারা শুধু বলেছেন, গেলেই কাজ দেয়া হবে। শ্রমিকরা জানান, এখানে কাজ করতে এসে প্রাণ বাঁচানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত ঠাণ্ডার কারণে নানারকম রোগ-ব্যাধিতে ভুগতে হচ্ছে। বেশির ভাগই জটিল চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় চিকিৎসা পাওয়াটা আরও কঠিন। তাই অনেক শ্রমিককে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হচ্ছে। অনেকে ৭-৮ দিন থেকে ফিরছেন দেশে। তাদের অভিযোগ, সাধারণত ভারত ও নেপালের শ্রমিকরা এ দেশে কাজ করতে আসেন। বেতন নির্ধারণে এখানে বৈষম্য রয়েছে চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশী হলে বেতন কম দেয়া হয়। অপরদিকে অন্যান্য প্রতিবেশী শ্রমিকদের জন্য বেতনের পরিমাণ বেশি। এর অন্যতম কারণ, আদম ব্যবসায়ীদের পারসেন্টেজ। এ প্রসঙ্গে ভুটানের তাকসান কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী অভিষেক জানান, প্রতিবেশী দুই দেশের তুলনায় বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য আমাদের বেশি টাকা ব্যয় করতে হয়। যারা এ দেশে শ্রমিক দেয়ার কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাদের ওই টাকা দেয়া হয়। শ্রমিকপ্রতি আমাদের কাছ থেকে নেয়া হয় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। ওই টাকা পুষিয়ে নিতে বাধ্য হয়ে বাঙালি শ্রমিকদের বেতন কম দিতে হয়। তিনি বলেন, এ ছাড়া অন্য দেশের শ্রমিক আমদানিকারকদের শ্রমিকপ্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দিলেই চলে। একই প্রতিষ্ঠানের আরেক কর্মকর্তা মাহেষ বলেন, বাংলাদেশী শ্রমিকদের মান অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। বিশেষ করে তারা যথেষ্ট পরিশ্রমী ও কাজের প্রতি আন্তরিক। তিনি জানান, ভুটানে বিল্ডিং তৈরির কাজের জন্য বাংলাদেশের শ্রমিকদের রয়েছে আকাশচুম্বি চাহিদা। বুয়েট থেকে পাস করা অনেক প্রকৌশলী এখানে কাজ করছেন মোটা অঙ্কের বেতনে। সুযোগ-সুবিধাও পান অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। তবে সাধারণ শ্রমিকদের জন্য ভুটান মোটেই উপযোগী নয় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশী প্রকৌশলীরা। তারা বলেন, বৈরী আবহাওয়ার পাশাপাশি এখান থেকে উপার্জিত টাকা পাঠানো একেবারে অসম্ভব। ছয় মাস বা এক বছর পর কোন শ্রমিক যখন ছুটি পাচ্ছেন, তখন তাদের পরিবারের জন্য টাকা নিয়ে যেতে হচ্ছে। শ্রমিকরা জানান, ভুটান থেকে বাংলাদেশে টাকা পাঠানোর কোন সুযোগ নেই। যদিও পার্শ্ববর্তী দেশের শ্রমিকদের এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না। বাংলাদেশী শ্রমিকদের চাহিদা কমাতে এটা এক ধরনের কৌশলী উদ্যোগ বলে অভিযোগ করেন তারা। বলেন, ব্যাংক কিংবা কুরিয়ার সার্ভিসের মতো প্রতিষ্ঠান না থাকায় এ ধরনের অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। শ্রমিকরা বলেন, কাজ করার আগে এসব তথ্য তাদের জানানো হয় না। এ কারণে ভুটানে এসে পড়তে হচ্ছে বিপাকে। বগুড়ার খায়রুল ইসলাম ছিলেন ভুটানের থিম্পুতে। জাস্টিন বিল্ডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ পেয়েছিলেন তিনি। অতিরিক্ত ঠাণ্ডার কারণে ২০ দিনের মাথায় দেশে ফিরতে বাধ্য হন। এখন নিজ গ্রামে মুদি দোকান দিয়ে কোন রকমে সংসার চলছে তার। এদিকে যার মাধ্যমে কাজ পেয়েছিলেন, তাকেও কোন দোষারোপ করতে পারছেন না তিনি। কারণ তার সঙ্গে চুক্তি ছিল ভুটানে যাওয়ামাত্র কাজ পাইয়ে দেয়ার। একই অবস্থার কথা জানালেন গাজীপুরের আসাদ, ময়মনসিংহ ত্রিশালের আবদুল মান্নান। তারা কাজ করতেন ভুটানের বামহ্যাং, ট্রাশিগ্যাং, মংগার-এর মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে। পারো এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে তারা বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে কাজ করতে এসেছিলাম। এখন ফিরতে বাধ্য হচ্ছি। এই আবহাওয়ায় কোনভাবে টিকে থাকা সম্ভব নয়। দেশে গিয়ে কি করবো, কোথায় থাকবো, টানাটানির সংসার কিভাবে চলবে তা ভেবে পাচ্ছি না। তারা তাদের হাত দেখিয়ে বলেন, এরই মধ্যে হাতের বেশ কয়েক জায়গায় পচন ধরেছে। দুর্গম এলাকা হওয়ায় চিকিৎসকও পাওয়া যায় না।
Discussion about this post