বিশিষ্ট ব্রিটিশ আইনজীবী, যুদ্ধাপরাধবিষয়ক আইন বিশেষজ্ঞ টবি ক্যাডম্যান বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে (আইসিটি) একটি ‘ব্যতিক্রমী ও স্পেশালাইজড কোর্ট’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, এই ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক আইন কিংবা বাংলাদেশে প্রচলিত ফৌজদারি আইন দ্বারা বিচার হচ্ছে না। বরং বিচার হচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন আইন দ্বারা যা বাংলাদেশের সংবিধান, এমনকি ট্রাইব্যুনালের নিজস্ব বিধিমালার সাথেও সাংঘর্ষিক।
নিউইয়র্কে বসবাসকারী বাংলাদেশী সাংবাদিকদের সাথে ম্যানহাটনের এক হোটেলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় (বাংলাদেশ সময় শুক্রবার সকাল) আলোচনাকালে এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বিচারকাজ এমন হওয়া উচিত যাতে মানুষের মাঝে ধারণার সৃষ্টি না হয় যে রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে কিছু লোককে বিচারের মুখোমুখি করেছে। ইতোমধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে সরকার শুধু বিরোধী দলকে, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের অভিযুক্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারের আওতায় এনেছে। সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ বিচার করছে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে টবি বলেন, আমি আমার অবস্থান থেকে একথা বলতে পারি না। কিন্তু সারাজেভোতে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে প্রসিকিউশন পক্ষে আমার আট বছরের সম্পৃক্ততা এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে অনুরূপ বিচারে যে আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি অনুসরণ করা হয়েছে সেসব অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে বলতে পারি যেহেতু বাংলাদেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন আইন ও নীতি অনুসরণ করে বিচার চলছে, কেউ যদি এটাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে করে তাহলে দোষ দেয়া যায় না। বাংলাদেশে তার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করার বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে দুই দফা ঢাকা সফরকালে তিনি আইনমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং তিনি সুপারিশ চাইলে তিনি যেসব সুপারিশ পাঠিয়েছেন সেগুলো আমলে নেয়া হয়নি। সরকার যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধবিষয়ক রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র্যাপকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি ঢাকা সফর করেন এবং বিচারকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য কী কী করা প্রয়োজন সে সম্পর্কিত সুপারিশ পাঠান। তার সুপারিশও খুব একটা বাস্তবায়িত হয়নি। যাদেরকে আটক রাখা হয়েছে তাদের ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার যে উত্তর দিয়েছে তা ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রশ্নের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
উল্লেখ্য, টবি ক্যাডম্যান লন্ডনের চেম্বার্স এট ৯ বেডফোর্ড রো-এর একজন আইনজীবী। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতে ইসলামীর পাঁচ শীর্ষ নেতার পক্ষে নিয়োগকৃত তিন ব্রিটিশ আইনজীবীর অন্যতম তিনি। তারা সরাসরি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্তদের পক্ষে হাজির হওয়ার অনুমতি চাইলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল তা খারিজ করে দেয়ায় তারা অভিযুক্তদের বাংলাদেশী আইনজীবীদের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। টবি বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় মুসলিম গণহত্যার বিচারের জন্য গঠিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর হিসেবে দীর্ঘ আট বছর কাজ করেছেন। ২০১১ সালের আগষ্ট মাসে তিনি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত হলে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করার অনুমতি না দিলে ফিরতি ফাইটে ঢাকা ত্যাগে বাধ্য করে। জাতিসঙ্ঘের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি এখন নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন।
জনৈক সাংবাদিকে প্রশ্নের উত্তরে টবি ক্যাডম্যান বলেন, এধরনের একটি বিচারের মাধ্যমে বাংলাদেশ এক বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছে, যা আশেপাশের দেশগুলো তাদের দেশে প্রয়োগের জনন্য অনুসরণ করতে পারে। শ্রীলঙ্কায় তামিলদের একতরফা বিচার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এটি আসলেই অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য বিপদ হয়ে থাকবে। এ ব্যাপারে আইসিটির করণীয় কিছুই নেই। কারণ মূল সমস্যা নিস্পত্তির জন্য আইসিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। বিচার সুষ্ঠু করতে হলে প্রেসিডেন্টের ১৬ নম্বর আদেশ বাতিল করতে হবে যাতে সব পক্ষকেই তাদের অপরাধের জন্য বিচারের আওতায় আনা যায়। প্রেসিডেন্টের ওই আদেশে অন্যান্য পক্ষের দ্বারা সংঘটিত অপরাধকে বিচারের আওতা বহির্ভূত রাখা হয়েছে, যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
এক প্রশ্নের উত্তরে টবি ক্যাডম্যান বলেন, যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতা বিরোধী অভিযোগের ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে অসংখ্য লোক নিহত ও নির্যাতিত হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হচ্ছে এসবের কোনোটাই তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তারা কোনো অপরাধ করে থাকলে দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইনে তার বিচার হতে পারে। কিন্তু তারা যদি স্বাধীনতার বিরোধিতা করে থাকে তাহলে তা অপরাধ বলে গণ্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি সম্প্রতি গোলাম আযমকে গ্রেফতার ও তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের উল্লেখ করে বলেন, মাওলানা দেলওয়ার হোসেইন সাঈদীর বিচারে সাক্ষীদের বক্তব্য থেকে যা পাওয়া গেছে সেগুলো দিয়ে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা কঠিন। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এগুলো প্রমাণের উপায় কি? বিচারকাজ সুষ্ঠু করার জন্য তিনি বিচার মনিটর করার জন্য পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা, সংবিধানের প্রথম ও পঞ্চদশ সংশোধনী সংশোধন করে অভিযুক্তদের সাংবিধানিক অধিকার পুনর্বহাল, আইসিটির বিচার প্রক্রিয়ায় ফৌজদারি আইন ও সাক্ষ্য আইন অন্তর্ভূক্ত করার আহবান জানান।
ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের অনুসরণে বাংলাদেশ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করছে মর্মে সরকারের দাবি সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে টবি বলেন, ন্যূরেমবার্গ ট্রায়াল কোনো অবস্থাতেই নিরপেক্ষ ট্রায়াল ছিল না। সেটি ছিল বিজয়ী পক্ষের ন্যায়বিচার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই সে বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং যুদ্ধের প্রভাব ও অনুভূতি বিচারকে প্রভাবিত করেছিল। বাংলাদেশের দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং আমাদের দৃষ্টিতে সমস্যাপূর্ণ। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনটি করা হয়েছিল পাকিস্তানী সৈন্যদের বিচার করতে এবং কোনো বেসামরিক আদালত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নয়। কিন্তু সেটি বহু পরে সংশোধন করা হয় একটি বেসামরিক ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যেটি বেসামরিক ব্যক্তি, মিলিটারি ও সহায়তাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিচার করবে। কিন্তু আইনের মধ্যেই সমস্যা রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক আইনের একটি নীতি হচ্ছে যে, অপরাধ সংঘটনের সময় কার্যকর ছিল না এমন কোনো আইন দিয়ে কোনো ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা, বিচার করা বা শাস্তি দেয়া যাবে না। অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে ১৯৭৩ সালে নয়। সেই আইনকে চল্লিশ বছর পর সংশোধন করে ভিন্ন অপরাধের জন্য দেশের লোকদের বিচার করতে প্রয়োগ করতে গেলে কী পদক্ষেপ নিতে হবে তা আমরা বলেছি। তিনি আরো বলেন, এ ধরনের অপরাধের অভিযোগ এনে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কোনো ট্রাইব্যুনালের পক্ষে কাজ করা কঠিন ব্যাপার। বলা যায় যে একেবারেই অসম্ভব। বসনিয়ায় তা সম্ভব হয়নি, সেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে শক্রতার শেকড় ছিল গভীরে প্রোথিত।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক কোনো আইন আইসিটি গ্রহণ করেনি এবং কোনো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের কাজকেও বিবেচনায় নেয়নি। সরকার এটিকে দেশীয় আদালত বলছে? কিন্তু আইসিটি প্রচলিত ফৌজদারি আইনে বিচার করছে না। অপরাধ বিধি ও অপরাধ সাক্ষ্য আইন আইসিটিতে গ্রহণযোগ্য নয়। অভিযুক্তের সাংবিধানিক সব রক্ষাব্যবস্থা আইসিটির আওতা বহির্ভূত। শুধু সাজা প্রদান শেষে আপিলের জন্য উচ্চতর আদালতে যাওয়ার সুযোগ ছাড়া ইন্টারলোকেটরি আপিল করার অধিকার রাখা হয়নি। আইসিটির বিচারকদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আপত্তি নিয়ে উচ্চতর আদালতে যাওয়ার কোনো অধিকার নেই। আইসিটির এখতিয়ার নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না। এসব বিচার বিশ্লেষণ করে কেউ এটিকে দেশীয় বা জাতীয় আদালতও বলতে পারবেন না।
Discussion about this post