সাযযাদ কাদির- বই পড়ার নেশা আমার হয়েছিল অতি অল্প বয়সেই। ১৯৫৫ সালে ভর্তি হয়েছিলাম ক্লাশ ফোর-এ। টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী হাই স্কুলে। নেশার শুরু এর পর থেকেই। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি ‘আউট’ বই পড়ার এ নেশা আমার বাবার ছিল, পিতামহীরও ছিল। তাই বাড়িতে পরিবেশ ছিল ওই নেশার অনুকূলে। মা বকতেন একটু-আধটু। বলতেন, বেশি আউট বই পড়লে স্কুলের বই পড়ার ক্ষতি হবে। তবে প্রশ্রয় দিতেন পিতামহী। বলতেন, আউট বই পড়লে জ্ঞান বাড়ে।
পড়তে-পড়তে ধারণা হয়ে গিয়েছিল কোন বই ওই বয়সে পড়া যাবে, কোন বই পড়তে হবে বড় হয়ে।
‘আউট’ বইয়ের মধ্যে ‘নাটক-নভেল’ পড়া ছিল পুরোপুরি নিষিদ্ধ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮), নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত (১৮৮২-১৯৬৪), সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৬৬) প্রমুখের বই হাতে দেখলে ক্ষেপে যেতেন মুরুব্বিরা। তারপরও শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ ও ‘চরিত্রহীন’ পড়ে ফেলেছিলাম সপ্তম-অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের ‘পাপের ছাপ’ পড়েছিলাম এর পর-পরই। আরও পড়েছিলাম সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের ‘পিয়ারী’। ঢাকার লেখকদের মধ্যে আবু যোহা নূর আহমদ (১৯০৭-১৯৭৩)-এর ‘যে যারে ভালবাসে’ (১৯৫৮), আ. ন. ম. বজলুর রশীদ (১৯১১-১৯৮৬)-এর ‘অন্তরাল’ (১৯৫৮), আকবর হোসেন (১৯১৭-১৯৮১)-এর ‘অবাঞ্ছিত’ (১৯৫০), বেদুইন শমসের (১৯১৯-১৯৬৪)-এর ‘বুড়িগঙ্গার বুকে’ (১৯৫৪) প্রভৃতি উপন্যাস পড়া দূরে থাকে নাড়াচাড়া করাতেও ছিল নিষেধের শাসন। আমার বয়স তখন ১২ ছাড়িয়ে। তাহলেও চিনতাম যৌন বিষয়ক বই ও পত্রপত্রিকা। সেগুলো থাকতো পিনবদ্ধ। ওই পিনের ওপর আঁটা থাকতো এক চিলতে কাগজ, তাতে ছাপা: “কেবল প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য”। কলকাতা থেকে আসতো ‘নরনারী’ নামের একটি পিনবদ্ধ পত্রিকা। পরে ঢাকাতেও ‘সচিত্র নরনারী’ নামে প্রকাশিত হয় একই রকম এক পিনবদ্ধ পত্রিকা। এ সব পত্রিকায় অবশ্য নামী সাহিত্যিকরাই গল্প-উপন্যাস লিখতেন, তবুও ‘অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নয়’ বলে ওগুলো ছুঁয়েও দেখতাম না কখনও। ‘যৌবনের ঢেউ’ নামে একটি যৌনশিক্ষামূলক বই ছিল পিনবদ্ধ। সে বইও তখন দেখি নি হাতে নিয়ে। কিন্তু ১৯৬০ সালের দিকে, তখন আমি নবম শ্রেণীর ছাত্র, পিনবদ্ধ এক উপন্যাস আসে হাতে। “সাঁচিবন্দর ফার্স্ট লেন” নামের ওই উপন্যাসটিই আমার প্রথম লুকিয়ে, সবার চোখ এড়িয়ে, পড়া বই। লেখক সালাদীন (জ. ১৯৩৪, নোয়াখালী); প্রকাশক সিটি পাবলিশার্স (৩৪ নর্থব্র“ক হল রোড, ঢাকা-১১০০)। ১৯৫৯ সালের অগস্টে প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পর বইটির আরও দু’টি মুদ্রণ হয়েছিল ১৯৬০ ও ১৯৬২ সালে। এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৭ সালে, প্রকাশ করেছে অনিবার্য প্রকাশনী (১৩ বকসীবাজার, ঢাকা-১১০০)। নিষিদ্ধ গলির যৌনকর্মীদের নিত্যদিনের সুখ-দুঃখের কাহিনী ভিত্তিক এ উপন্যাস সেই ষাটের দশকে শুরুতে যে আলোড়ন তুলেছিল তার কিছুই ঘটে নি নব্বুই দশকের শেষ পাদে। অথচ উপন্যাসটির জীবনানুগ বিশ্বস্ত বিবরণ Ñ প্রায় ফটোগ্রাফিক, ঝরঝরে ভাষা, লেখকের দরদি মনের প্রকাশ, চরিত্রায়ন প্রভৃতি প্রভূত প্রশংসা পেয়েছিল ওই সময়ের পাঠক-সমালোচকদের। তবে লেখকের জন্য কাল হয়েছিল ওই পরিবেশের বাস্তবানুগ চিত্রন। তাঁকে নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল নানা রকম গুজব। সেগুলো ছিল: লেখক সালাদীন বছরের পর বছর কাটিয়েছেন নিষিদ্ধ পল্লীতে; উপন্যাসের নায়িকা অরুণা বাস্তব চরিত্র; লেখকের লেখাপড়া, ভরণপোষণ Ñ সব কিছুর ভার নিয়েছিল সে; আর সে সব কথা লেখক অকপটে স্বীকার করেছেন তাঁর এক বন্ধুর কাছে ইত্যাদি। এ সব গুজব ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হয়তো ছিল লেখকের ‘উৎসর্গ’। সেখানে “আমার কথা” শিরোনামে তিনি লিখেছিলেন Ñ “ এ বই যাকে উৎসর্গ করলাম তার নাম দেওয়ার উপায় নেই, Ñ সে অধিকার সে আমায় দেয় নি। যদিও এ-কাহিনী তারই।”
উপন্যাসের নায়ক ভুলে গিয়ে পড়েছিল সাঁচিবন্দরে
“আধো আলো আধো অন্ধকারে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আবছা আলো-অন্ধকারে আমার চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে শুধু নারীমুখ। উগ্র এসেন্সের গন্ধ। সুপ্রচলিত সিনেমা গানের কলি ভেসে আসছে সে সব নারীকণ্ঠ হতে। এই নয় শুধু. সে সব মুখে বিড়ি সিগারেটও স্থান পেয়েছে। বিস্মিত হয়ে দেখতে লাগলাম এদিক আর ওদিক।
“স্থানে স্থানে জটলা বেঁধে আছে নারীপুরুষ হাসছে, কথা বলছে। সঙ্কীর্ণ গলিপথে জল জমে আছে মাঝে মাঝে। অথচ বৃষ্টির দিন নয় তখন। দু’পাশের বাড়িগুলো কোনটা দোতলা, কোনটা একতলা। কিন্তু শ্রী ও সংস্কারহীন। দু’একটি দরজা জানালা দিয়ে দেখা যায় হ্যারিকেন কিংবা চেরাগের স্তিমিত আলোক। দূরে গলির মোড়ে ইলেকট্রিক বাতি।…” (পৃষ্ঠা ২৫)
পঞ্চাশ দশকের ঢাকার অন্ধকার গলির জীবন আরও ফুটেছে এ উপন্যাসে। পরদিন নায়ক ছুটে যায় নিষিদ্ধ গলির আকর্ষণে
“… সারা দিন আবার কাটলো ছটফট করে। সন্ধ্যার জন্য উন্মুখ হয়ে রইলো মন।
সন্ধ্যার অনতিবিলম্বে আবার এসে দাঁড়ালাম গলির মোড়ে ইলেকট্রিক পোস্টের নিচে। দু’একজন করে লোক কোন দিকে না তাকিয়ে দ্রুত ঢুকছে আর বেরিয়ে আসছে। একটু সরে দাঁড়িয়ে গলির ভিতরের দিকে তাকালাম। স্পষ্ট দেখা যায় না কিছুই। কিন্তু বোঝা যায় একটু তীক্ষè দৃষ্টি ফেললেই, কলরবমুখর ব্যস্ত ত্রস্ত একটি গলি। আবছা দেখা যায় বেণী আর খোঁপাওয়ালা নারী-মস্তকগুলো। নিজের অজ্ঞাতেই পা চালিয়ে দিলাম। কিন্তু ভিতরে এসেই মাথা ঘুলিয়ে গেল। কাল সন্ধ্যার সে ঘরটির অবস্থান কিছুতেই ঠিক করতে পারছি নে। তিনবার গলির এ-মাথা ও-মাথা ঘুরে বেড়ালাম ভীত ব্যস্ত পদক্ষেপে। দু’পাশে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে তারা। গান গাইছে রকমারি, ‘রাতের অতিথি এসো আমারি দ্বারে’, ‘আমি বনফুল গো’, ‘ও দুনিয়াকে রাখওয়ালে’ ইত্যাদি।…”
এরপর সঙ্গে অরুণার সঙ্গে পরিচয় এবং কাহিনীর অগ্রগতি।
লেখালেখির জগতে বেশ সক্রিয় ছিলেন সালাদীন। “সাঁচিবন্দর ফার্স্ট লেন” ছাড়াও পর-পর তিনটি বই বেরিয়েছিল তাঁর Ñ বেলাভূমি (উপন্যাস, ১৯৫৯); বারংবার (প্রবন্ধ-নিবন্ধ সঙ্কলন, ১৯৬০); বৃত্ত ও বিন্দু (উপন্যাস, ১৯৬১)। এরপর একেবারে নিখোঁজ হয়ে যান তিনি সাহিত্যজগৎ থেকে। দীর্ঘ ২২ বছর পর প্রকাশিত হয় তাঁর চতুর্থ উপন্যাস ‘অববাহিকা’ (১৯৮৩)। জিবরান কাহলিল জিবরান-এর “দ্য প্রফেট”-এর অনুবাদ করেছেন সালাদীন। এ বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। ২০০২ সালে ‘অববাহিকা’র দ্বিতীয় খণ্ড ‘মোহনা’ প্রকাশিত হয়েছে যুক্ত ভাবে।
কিছু দিন আগে ‘জ্ঞান বিতরণী’র প্রকাশক মো. সহিদুল ইসলামের মাধ্যমে পরিচিত হই সালাদীনের সঙ্গে। প্রথমে কথাবার্তা আলোচনা টেলিফোন-সেলফোনে। পরে, গত ২০শে মে, মুখোমুখি দেখা তাঁর ভূতের গলির এপার্টমেন্ট। ৭৭ বছর বয়স। শারীরিক নানা সমস্যায় কিছুটা কাবু। ঘরেই থাকেন। বাইরে যান না বেশি। তবে পরিচয় হতেই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন যুবকের মতোই। কথা বলতে থাকেন নানা বিষয়ে। ষাটের দশকে টাঙ্গাইল ও কুষ্টিয়ায় চাকরি-জীবনের স্মৃতি চারণ করেন। উল্লেখ করেন বিভিন্ন ব্যক্তি ও ঘটনা। স্মৃতি অত্যন্ত সজীব। ছিলেন ম্যালেরিয়া উচ্ছেদ এবং স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। জানতে পারি সমাজকল্যাণ ও কর্মচারী বিষয়ক প্রশাসনে স্নাতকোত্তর এবং বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় মারকিন যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় অধ্যয়ন করেছেন তিনি। আমি অবশ্য প্রথমেই জানতে চাই তাঁর আসল নাম। তা তিনি বলতে নারাজ। অন্যান্য পরিচয়ও চান না দিতে। তবে বললেন, খ্যাতিমান লেখিকা রওশন সালেহা তাঁর বড় বোন। বলি, ‘তাহলে তো আপনি ফরহাদ মজহারের মামাশ্বশুর। ফরহাদ আমার বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের বন্ধু। সেই ১৯৬৬ সালে পরিচয়ের পর থেকে।’ এরপর আলোচনা গড়ায় ফরহাদকে নিয়ে। ‘সাঁচিবন্দর ফার্স্ট লেন’ প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই, কিন্তু আলোচনা করতে চান তাঁর ট্রিলজি নিয়ে। এর দুই খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে ‘অববাহিকা’ ও ‘মোহনা’, কিন্তু তৃতীয় খণ্ড ‘ব-দ্বীপ’ লেখা রয়েছে অসম্পূর্ণ। জানালেন, হাতে আর লিখতে পারছেন না। এজন্য খুঁজছেন একজন সহকারী। কিন্তু পাচ্ছেন না তেমন কাউকে। সবশেষে জানান, ‘সাঁচিবন্দর ফার্স্ট লেন’ লেখার নেপথ্যে কোনও ব্যক্তিগত প্রেরণা বা অভিজ্ঞতা ছিল না, ছিল রাশিয়ান লেখক আলেকসান্দর কুপরিন (১৮৭০-১৯৩৮)-এর গল্প-উপন্যাস, বিশেষ করে ‘ইয়ামা: দ্য পিট’ (১৯০৯-১৫) নামের উপন্যাসটি। এর পুরো নাম “… an overwhelming, truthful and staggering indictment of the immemorial evil of prostitution… the first and last honest work on the subject of prostitution.”
সাযযাদ কাদির: কবি, বহুমাত্রিক লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক
Discussion about this post