ফিরোজ মান্না: সাবধান! এবার শুরু হয়েছে মোবাইল হ্যাকিং। কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের ঘটনা পুরনো। সারা দুনিয়াতে কম্পিউটার হ্যাক হচ্ছে এটা প্রায় সকলের জানা। কিন্ত মোবাইল হ্যাক হচ্ছে এটা একেবাইরেই নতুন একটি আতঙ্ক। নিজের মোবাইল কখন হ্যাকাররা হ্যাক করছে তা টেরও পাওয়া যাচ্ছে না। যাদের মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার হচ্ছে-তাদের মোবাইল হ্যাক করতে হ্যাকারদের খুব বেশি বেগ পেতে হচ্ছে না। যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন না, তাদের মোবাইলও হ্যাক করছে হ্যাকাররা। এতে ব্যক্তিগত সব তথ্য কপি করে নিয়ে যাচ্ছে তারা। এমনকি আপনার নিজের নম্বরটি ব্যবহার করে হ্যাকাররা অনায়াসে কথা বলে যাবে আপনি টেরও পাবেন না। এমন এক আতঙ্ক এখন বিশ্বব্যাপী বিরাজ করছে।
তথ্যপ্রযুক্তির সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে ইন্টারনেট। ইন্টারনেট এখন সারাবিশ্বে অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। এ ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বের এক প্রান্তের মানুষ অন্য প্রান্তের মানুষের তথ্য জানতে পারছে। এমনকি ইন্টারনেটের মাধ্যমে একজন আরেকজনকে দেখে কথাও বলতে পারেন। এমন এক উদ্ভাবন মানুষের কল্যাণে-অকল্যাণে দুভাবেই ব্যবহার হচ্ছে।
বর্তমানে ইন্টারনেট হ্যাকিং আতঙ্ক এখন বিশ্বজুড়ে। ইন্টারনেট নিয়ে বিশ^জুড়ে নানা বিষয় চলছে তোলপাড়। আর এ সময়েই নতুন আতঙ্ক হিসেবে সামনে এসে দাঁড়িযেছে মোবাইল ফোন হ্যাকিং। তথ্য প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা যে কোন ব্যক্তিদের মোবাইল হ্যাক করে দিতে পারে। নিয়ে নিতে পারে ব্যক্তিগত অনেক তথ্য। আবার আপনার মোবাইল ফোন হ্যাক করে আপনার নম্বর ব্যবহার দিয়েই হ্যাকাররা কল করছে, এসএমএস পাঠাচ্ছে, এমনকি মোবাইল ফোনে সংরক্ষিত সব ধরনের অডিও-ভিডিও ফাইল, ফোন নম্বর, ফোনে ব্যবহার করা পাসওয়ার্ড, ব্যাংক এ্যাকাউন্ট নম্বর সব কিছুই হ্যাকারদের কাছে চলে যাচ্ছে কপি হয়ে। এছাড়া কল রেকর্ড ব্লক সব কিছুই এখন হ্যাকরদের নখদর্পণে। তারা চাইলেই যে কোন সময় যে কার মোবাইল হ্যাক করতে পারে। আপনার অগোচরেই এ কাজ হচ্ছে। কিন্তু ধরার কোন ধারণা নেই। আর এটা যে কখন হচ্ছে বোঝাও মুশকিল। হ্যাকারগোষ্ঠী এমনই শক্তিশালী যে বিশ্বের যে কোন তথ্য জানতে তাদের খুব একটা বেগ পেতে হয় না।
তথ্য প্রযুক্তিবিদরা বলেন, হ্যাকিং একটি প্রযুক্তি। এটি ভাল কাজেও ব্যবহার করা যায়।
আবার খারাপ কাজেও এর ব্যবহার হচ্ছে। হ্যাকিং প্রযুক্তি ঠেকাতে টেকসই ও মজবুত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। তা না হলে হ্যাকাররা একের পর এক সফটওয়ার ভেঙ্গে ঢুকে যাবে যে কোন কম্পিউটার ও মোবাইলে। ভারতে মোবাইল হ্যাকিং নিয়ে সরকারের বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মোবাইল ফোন হ্যাকিংয়ের কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য না পেলেও হ্যাকিংয়ের বিষয়টি এখানেও চলছে। অপরিচিত কোড (+৯) দিয়ে ফোন কল আসার বহু নজির রয়েছে। বাংলাদেশেও মোবাইল ফোন সিম ক্লোনিংয়ের ঝুঁকি খুবই বেশি। এমন হতেই পারে ক্লোনিং কিংবা হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু বিষয়টি যাচাই না হওয়া এবং সচেতনতার অভাবের কারণে জানা যাচ্ছে না। আগে থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলে দেশের কোটি কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের বড় ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। বিটিআরসির এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে একই নম্বরের সিম একাধিক হচ্ছে। ক্লোন পদ্ধতিতে এই কাজটি করা হচ্ছে। এটা ধরা কঠিন কাজ না হলেও যন্ত্রপাতির অভাবে কাজটি করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোসের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে হয়েছে। তিনি কোন সংবাদকর্মীর ফোন ধরেন না বলে তার ব্যক্তিগত সহকারীরা জানিয়েছেন। বিটিআরসি সম্পর্কে কোন তথ্য তিনি সংবাদ মাধ্যমে দিতে নারাজ। এর কারণ হিসেবে বিটিআরসির এক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত লাভের হিসাব রয়েছে। এজন্যই তিনি সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চান না।
মোবাইল হ্যাকিং নিয়ে সম্প্রতি ভারতের অন্যতম বৃহৎ মোবাইল ফোন অপারেটর বিএসএনএল গ্রাহকদের অভিযোগ থেকে জানতে পারে ফোন ব্যবহারকারীরা তাদের ফোনে এ্যাকাউন্ট রিচার্জ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রহস্যজনকভাবে ব্যালান্স শূন্য হয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের অভিযোগ বেশি আসতে শুরু করলে বিষয়টি যাচাই করতে গিয়ে উদঘাটিত হয় সিমকার্ড ক্লোনিং বা হ্যাকিংয়ের তথ্য। পরে ভারতের অন্য মোবাইল ফোন অপারেটররাও ফোন হ্যাক হওয়ার বিষয়ে সতর্কবার্তা পাঠায় গ্রাহকদের কাছে। ভারতীয় মোবাইল ফোন অপারেটরদের তথ্য অনুযায়ী প্রায় দেড় লাখ সিম ক্লোন বা হ্যাক হওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন তারা।
ভারতের নেটওয়ার্ক বিশেষজ্ঞরা জানান, হ্যাকাররা মোবাইল ফোনের সিমকার্ড ক্লোনিংয়ের জন্য ব্যবহার করছেন একটি ইউনিকোড। এ ইউনিকোডটি প্রথমে কলারের হ্যান্ডসেট কিংবা পিসি অথবা সার্ভারে মাদারফাইল হিসেবে এ্যাকটিভ করা হয়। পরে ওই কোড নম্বর যে কোন মোবাইল ফোন নম্বর প্রবেশ করালেই মোবাইল ফোন নম্বরটি কপি হয়ে যাচ্ছে। ভারতের নেটওয়ার্ক বিশেষজ্ঞ রাকসিত ট্যান্ডন এ ব্যাপারে কয়েকটি উদাহরণও তুলে ধরেছেন তার নিজস্ব সমীক্ষা থেকে। দেখা গেছে ভারতে মোবাইল ফোন হ্যাকিংয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে +৯২, #৯০ এবং #০৯ ইউনিকোড। অপরিচিত কোন নম্বর থেকে ফোন দিয়ে হ্যাকার নিজের পরিচয় দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট ফোন অপারেটরের গ্রাহক সেবা কেন্দ্রের কর্মী হিসেবে এবং ফোন ব্যবহারকারীকে নেটওয়ার্ক নির্বিঘœ আছে কিনা তা যাচাই করতে বিশেষ কোডটি চাপতে অনুরোধ করছে। যিনি কলটি রিসিভ করেছেন তিনি কলারের কথামতো কোড চাপার সঙ্গে সঙ্গে তার ফোন নম্বর যেমন ক্লোনিং হবে তেমনি তার ফোনের ডাটা কপি হতে শুরু“ করবে। এমনকি কলটি কেটে দিলেও কপি চলবে। ফোনের পাওয়ার সুইচ বন্ধ করা ছাড়া এই কপি বন্ধ করা সম্ভব না।
হ্যাকররা শুধু ফোন করে গ্রাহকদের কোড নম্বর চাপতে অনুরোধ করছে তাই নয়, তারা ওই কোড নম্বর ব্যবহার করে কলও করছে। এ ক্ষেত্রে বিপদ আরও বেশি। এ ধরনের কল রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে রিসিভারের হ্যান্ডসেটের সব তথ্য চলে যাবে হ্যাকারের কাছে। গত প্রায় এক বছর ধরে ভারতে এ ধরনের হ্যাকিং শুরু হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এ সংক্রান্ত একাধিক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী ‘#, + কিংবা *’ দিয়েই ইউনিকোডের শুরু হয়। এ কারণে এ ধরনের প্রতীক দিয়ে শুরু যে কোন ধরনের কল গ্রহণ না করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। এ ছাড়া কেউ ফোন করে গ্রাহকসেবা কর্মী পরিচয় দিলেই তার কথা অনুযায়ী কাজ না করা উচিত। ভারতের মতো চীনেও এই আতঙ্ক প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান আইটিইউর (ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন) কাছে দাবি জানিয়েছে যে, ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নিতে অনুরোধ জানিয়ে ছিল। ভারত ও চীনের সঙ্গে কয়েকটি দেশ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ এই দাবির সঙ্গে একমত ছিল। কিন্তু আইটিইউ ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইন্টারনেটের ওপর নিজ নিজ দেশের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছে।
মোবাইল হ্যাকিং আতঙ্ক কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের চেয়ে বেশি। কারণ বিশ্বে সর্বাধিক মানুষ কম্পিউটার ব্যবহার করেন। কম্পিউটার ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক কম। মোবাইল হ্যাকিং ব্যাপকহারে চললে মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় বলতে কোন কিছুই থাকবে না। সব তথ্য হ্যাকারদের কাছে চলে যাবে। যদিও বিশ্বব্যাপী হ্যাকিংয়ের বিরুদ্ধে শাস্তিযোগ্য আইন রয়েছে। এরপরও হ্যাকাররা বসে নেই। একের পর এক হ্যাকিং হচ্ছে কম্পিউটার। এখন চলছে মোবাইল হ্যাকিংয়ের পালা। এটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তথ্য প্রযুক্তিবিদরাও পরিষ্কার করে বলতে পারছেন না। মোবাইল হ্যাকিং ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
Discussion about this post