ভূগোলের ছাড়পত্র (পাসপোর্ট) নিয়েই দেশান্তর হয় মানুষ। আদিগন্ত সীমানা পেরিয়ে মানুষ ছুটে দিগ্বিদিক, ছুটছি আমরাও। রুজি রুটির সন্ধানে রেমিটেন্সযোদ্ধা হিসেবে প্রবাসে কাটিয়ে দেয় সোনালী দিনগুলো, কষ্টের ঘানি টানতে টানতে হাঁফিয়ে উঠলেই ফিরে স্বদেশের টানে, কেউ জীবন নিয়ে আবার কেউ কেউ না ফেরার দেশের যাত্রী হয়ে। জীবন জীবিকা নির্বাহের জন্যে মাতৃভূমি ছেড়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রান্তিক কয়েদী হিসেবেই আজ আমরা। সুদূর প্রবাসে কষ্টের ঘানি টেনেও অনেকেই মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি করেন তাঁর অবস্থান। প্রগতিশীল চিন্তা চেতনায় ভ্রাতৃত্ববোধের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আমেরিকার বুকে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে সাহিত্য- সংস্কৃতি। প্রবাসেও আমরা সহসা খুঁজে ফিরি আমাদের শেকড়ের সন্ধান। প্রতিটিক্ষণে মা- মাটি- মানুষের মমতায় আমরা সিক্ত হই, জড়িয়ে যায় দেশপ্রেমে গভীর থেকে গভীরে। তাইতো দূর দেশে অবস্থান করেও আমাদের কৃষ্টি- কালচারকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরার লক্ষে কিছুকিছু সংস্কৃতিমনা মানুষ তাঁদের চিন্তা চেতনায় ভিন্নতার পরিচয় দেয়, তাঁদের সৃষ্টিশীল কর্ম- ভাবনায়। পরিবর্তিত সময়ে প্রবাসী পাঠকের রুচি যেমন উন্নত হয়েছে তেমনি লেখক, সাংস্কৃতিককর্মীদের দক্ষতাও বেড়েছে নিঃসন্দেহে।
দেশের বাইরে দেশজ সাহিত্য- সংস্কৃতির চর্চা- চর্যা বিকাশে কুয়েত প্রবাসী বাঙালীরা এযাবৎকাল অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এলেও মাঝে কিছুটা সময় এক্ষেত্রে বেশ স্থবিরতা বিরাজ করেছিল। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং তার প্রভাবে স্থানীয় নানাবিধ কারণে এই স্থবিরতা ঝেঁকেও বসেছিল বেশ। কোথাও শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির সুস্থ, রুচিশীল ধারা কোন কারণে স্তিমিত হয়ে এলে স্বভাবতঃই অপসংস্কৃতিৎ তথা অসত্য, অসুন্দরের আগাছার বাড় বাড়ে।
এই সম্পর্কে কবি সেলিম রেজা বলেন, মূলধারার সাহিত্য চর্চায় যারা আত্মনিবেদিত তারাই শিল্প- সাহিত্যে তাঁদের অবস্থান শক্ত করে তৈরি করছেন। বাকীরা কালেরগর্ভে হারিয়ে যাবে এমনটাই অতীত ইতিহাস বলে। নিম্নে তাঁর কিছু সৃষ্টিকর্ম ও অর্জনের তথ্য দেয়া হলোঃ
সম্পাদনাঃ ক) মৃত্তিকা-একটি সাহিত্যের কাগজ (৪র্থ সংখ্যা), খ) অভিষেক গ) দেশান্তর- অন্তরে নিরন্তর বাংলাদেশ, কুয়েত ঘ) স্লোগান-একটি প্রতিবাদী কবিতাপত্র।
যৌথ সম্পাদনাঃ ক) বৈশাখ ১৪১৪- বাংলাদেশ দূতাবাস, কুয়েত খ) উজান- ইতিহাস ঐতিহ্যের কাগজ, কুয়েত গ) দূর পরবাসে কবিতার আকাশে- বইমেলা ২০০৮ (কাব্য সংকলন)।প্রকাশিত গ্রন্থঃ ক) সপ্তর্ষী নক্ষত্রমালা-২০০৫ (কাব্যগ্রন্থ), খ) উত্তরণ- বইমেলা ২০০৬ (যৌথ কাব্য সংকলন), গ) কাল উত্তরণ- বইমেলা ২০০৭ (যৌথ কাব্য সংকলন), ঘ) স্বপ্ন মৃত্তিকায় নবীন ঘাসফুল- বইমেলা ২০০৯ (কাব্যগ্রন্থ), ঙ) কবিতা ভেসে আসে বহিমিয়ান বাতাসে-বইমেলা ২০১০ (যৌথ কাব্য সংকলন), চ) ইদানীং এবং অনিন্দিতা-বইমেলা ২০১২ (যৌথ কাব্য সংকলন), ছ) তবুও কবিতা-বইমেলা ২০১২ (যৌথ কাব্য সংকলন)। অর্জনঃ ক) সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য সাহিত্য পুরস্কার প্রবাসী সাহিত্য পরিষদ, কুয়েত’র একুশে সম্মাননা ২০০৬ খ) সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সাহিত্য অঙ্গন, কুয়েত’র বিশেষ সম্মাননা ২০১৫। কুয়েতে সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্যে তিনি বলেন, হাতেগুনা কয়েকজন শুধু নিজেদেরকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রুপে উপস্হাপন করে নিজেদেরকে জাহির করে। কমতো আর দেখা হল না। সাহিত্যের মাঠে কলুষতা বিরাজ করছে। সাধু সাবধান, হিতে যে বিপরীত হয়েছে তা তো দেখা হয়েছে। রাজনীতিতে মার খাওয়া ব্যক্তি রাতারাতি সাহিত্যিক বা সংস্কৃতিকর্মী বনে যাওয়া এখন তেমন কঠিন না কুয়েতে। সেরদরে বেচাকেনা করেন তাদের কথার ফুলঝুরি, রাতে বের হন মিথ্যাচারের তস্বি নিয়ে। সাধু বনে যায় সমাজে, তাদের দাম্ভিক্তা উপড়ে ফেলার জন্যে দরকার কাকতাড়ুয়াদের; ‘অন্যদৃষ্টি’ কিংবা ‘ঘ্যাচাং’ এর মত ভাঁজপত্র। যাক শুভবোধ উদয় হোক, সাহিত্যে ফিরে আসুক সুবাতাস। … যারা সাহিত্যে নিবেদিতপ্রাণ তাঁদের জয় হবেই… ধন্যবাদ যারা মূলধারার সাহিত্য চর্চায়- চর্যায় নিবেদিত।
কবিতা লেখার বিষয়ে কবি বলেন, ‘অনেকের মতে জীবনের দ্বারপ্রান্তে এসে কড়ানাড়ে স্বপ্ন, আজ সেই স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার এক অন্যরকম অনুভূতি-এক অন্যরকম অভিজ্ঞতায় নত আমিও; চলে আড্ডা সেইসাথে গল্পের সাতকাহন। জয়তু স্বপ্ন জয়তু স্বপ্নকণা…’ আপনারা যারা সত্য-নিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে অনেকটা এগিয়ে তাঁদের কাছে অনুরোধঃ সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি, রাজনীতির নামে অপরাজনীতি, সাহিত্যের নামে লেজুড়মার্কা বা মুখোশধারী ব্যক্তিদেরকে চিহ্নিত করে বাঙালী কমিউনিটিতে তাঁদের মুখোশ উম্মোচন করে দেয়া। তাহলে সত্যিকার মেধা-মননের মূল্যায়ন হবে সমাজে। বৈশ্বিক মানদন্ডে সাহিত্য যেন আসন করে নেয় এই চিন্তা মাথায় রেখেয় আমার সাহিত্যচর্চা, কিন্তু যারা শুধু মাত্র কুয়েতকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চা করেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, কিছু জানতে আর জানাতে চাইলে দূরে দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করুন। ‘আমরা আমরাই’ স্লোগান বাদ দিয়ে নিজের তৈরী গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে দেখুন সাহিত্য কতটা উর্বর, প্রগতিশীল চিন্তা চেতনায় নিজেরদেকে নিয়োজিত করে দেখুন সাফল্য একদম দোরগোড়ায়।
প্রগতিশীল সাহিত্যের কাগজ ‘মৃত্তিকা’ মানেই এখন সেলিম রেজা। দেশে-বিদেশে সাহিত্য আসরে মান বৈচিত্র্যে সুনামের অংশীদার হিসেবে ‘মৃত্তিকা’ জায়গা করে নিয়েছে। এবারের ৪র্থ সংখ্যা বর্ধিত কলেবরে প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প-অনুগল্প মিলে (১৬০ পৃষ্ঠায়)প্রকাশিত হল। দেশ-বিদেশের নামকরা দৈনিক, সাপ্তাহিক, ওয়েব পোর্টালসহ বিভিন্ন সাময়িকীতে ‘মৃত্তিকা’র আলোচনায় আমি বেশ খুশি, কারণ নিজ চেষ্টায় কিছু করার আনন্দ আলাদা। তাছাড়া ‘মৃত্তিকা’ প্রকাশন নামে একটি প্রকাশনী করেছি। এই প্রকাশনী থেকে এবারের বইমেলা-২০১৬ তে দুইটি কবিতার বই আসছে। কবি ও সম্পাদক (পাক্ষিক পুরাতনপাতা) রমজান বিন মোজাম্মেল এর সম্পাদনায় একটি কাব্যসংকলন এবং আমার নিজের কাব্যগ্রন্থ ‘কবি ও কবিতার পড়শি’ শিরোনামে ।
প্রবাস জীবনের নিত্যদিনের হালখাতায় সুতীক্ষ্ণ নজর রেখে, হাজার বছরের বাঙালীর ইতিহাস- ঐতিহ্যের প্রতি শতভাগ নিবেদিত থেকে বৈশ্বিক মানদন্ডে বাংলা শিল্প- সাহিত্য- সংস্কৃতির নিরন্তর উৎকর্ষতা সাধনের লক্ষ্যে অবিচল নিষ্ঠার ঘোষণা ‘মৃত্তিকা’র পথচলা কে আমি সর্বন্তকরণে সাধুবাদ জানাই। রুচিশীল প্রকাশনার অব্যাহত সাফল্যের সাথে ‘মৃত্তিকা’র দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বময়। বাংলার জয় হোক। বাঙালীর জয় হোক। ধন্যবাদ… কবি ও সাংবাদিক মঈন উদ্দিন সুমন, আপনাকে ও আপনার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে যাদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও সাহসে আমি ও আমরা এগিয়ে।
Discussion about this post