কুয়েত, ১৭ হাজার ৮১৮ বর্গ কিমি আয়তনের দেশটির পুরোটাই স্থল। ৪৭৫ কিমি স্থল সীমান্তের উত্তর- উত্তর পশ্চিমে ২৫৪ কিমি জুড়ে ইরাক, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমে ২২১ কিমি ব্যাপী সৌদি আরবের অবস্থান। কুয়েতের উপকূল রেখা পারস্য উপসাগরের ৪৯৯ কিমি জুড়ে বিস্তৃত।
দেশটি ছোট হলেও এখানে রয়েছে অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য। ছোট সময় গল্পে শোনেছি সিকান্দার বাদশার কথা। আর এই সিকান্দার বাদশার স্মৃতি বিজরিত দ্বীপ ফাইলাকা কুয়েতেই অবস্থিত। অনেক স্বপ্ন ছিলো এই দ্বীপটিতে ভ্রমন করব। দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন আজ পুরন হলো। এই দ্বীপটির বিভিন্ন ইতিহাস আর বর্তমান অবস্থা পাঠকদের উদ্দেশে শেয়ার করলাম। বাংলাদেশ প্রেসক্লাব, কুয়েত এর নির্বাচন সম্পন্ন হলো গেল কিছুদিন। এই উপলক্ষে ভ্রমনে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হলো। একদিন ভ্রমনে যাব সিকান্দার বাদশার প্রাসাদে। যে কথা সে কাজ বাংলাদেশ প্রেসক্লাব, কুয়েত এর নির্বাচন কমিশনার জাহাঙ্গীর খান পলাশ ও তার সহপার্টীদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ প্রেসক্লাব, কুয়েত এর সভাপতি মঈন উদ্দিন সরকার সুমন, সাধারন সম্পাদক আ হ জুবেদসহ ১০ জনের একটি দল পারস্য উপসাগর পারি দিয়ে সিকান্দার বাদশার দ্বীপে যেতে প্রস্তুত সবাই। সার্ক সমুদ্রতীরে অবস্থিত একটি পার্কে সবাই সমেবেত হলাম। সকালে নাস্তার পর্ব বোটে উঠার আগেই সেরে নিতে সফর সঙ্গী নজরুলে জোড়াজোড়ি। ইতিমধ্যে আলম নাস্তা পরিবেশ করছেন সবাইকে। চায়ের নেশায় কাতর জাহাঙ্গীর খান পলাশ, চা না হলে ইঞ্জিনই চলে না তার। তাই চা আর গাওহা (আরবী কফি) পর্ব শুরু বোটে উঠার আগ থেকেই। সফর সঙ্গী ফকরুল বাতিজা কাজী কে নিয়ে নিজের তৈরী তেহারীর ইয়া বড় পাতিল নিয়ে টানা টানি। প্রায় ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা সকাল সারে নয়টার উপরে সময়। বোট ছাড়ার জন্য জাহাজের ক্যাপ্টেন তাগাদা দিচ্ছে। তা শোনে পানি পেপসির কার্টুন উঠাতে শুরু করলো হাসেম আর কাসাদুল। অনেক পানি সাথে নেওয়ার পরেও টান পরেছিল পানি।
প্রায় এক ঘন্টা সময় জুড়ে আরব সাগর দিয়ে পারস্য উপসাগরে দ্বীপটি পৌছালাম। আগে থেকেই গাড়ী আমাদের অপেক্ষায় ছিল। একটি পিকাপে কয়েকজন ভিতরে আর কয়েকজন বাহিরে উঠে বসলাম। পুরো ফাইলাকা দ্বীপটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম এক অপূর্ব দ্বীপ ।
1990 সালে আক্রমণকারী ইরাকিরা দ্বীপটিকে ধ্বংস করে তার দৃশ্য এখনো আছে। বিভিন্ন ভবনে গোলা বারুদের আঘাতে ছিদ্র হয়ে আছে। নিচে পরে আছে অসংখ্য গোলা বারুদ। যুদ্ধে ব্যবহৃত ট্যাংক গুলোও সংরিক্ষিত আছে। এখানে দেখলাম সিকান্দার বাদশার প্রাসাদ, ইনজাক এর সমাধিস্থল, ৬০০০ বছর পূর্বের কারাগার, তখনকার আমলে যেখানে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে শিরচ্ছেদ করা হত সে স্থানটি, কুয়েতের প্রথম আমীরের বাসস্থান। প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুদাই করে এসব আবিষ্কার করে।
ফাইলাকা দ্বীপ আয়তনে ২০ বর্গকিমি এ দ্বীপটি কুয়েত শহর থেকে সমুদ্র পথেই ২০ কিমি। টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদীর মোহনা থেকে ৫০ কিমি দূরে অবস্থিত। ইতিহাস সমৃদ্ধ এ দ্বীপটিতে খ্রীস্টপূর্ব ২০০০ সালে মেসোপটেমিয়ানদের বসতি স্থাপন করতে শোনা যায়।
পারস্য উপসাগরের উত্তরে বর্তমানে যে দেশ ইরাক সেটিই একসময় মেসোপটেমিয়া বলে ইতিহাসে বিখ্যাত ছিল। অবশ্য এটা সেই প্রাচীনকালের কথা। গ্রীকরাই দিয়েছিল এই নাম। মেসোপটেমিয়া অর্থ দুই নদীর মধ্যবর্তী দেশ। আসলে মেসোপটেমিয়া ঘিরে বয়ে গিয়েছে দুটি নদী টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস। কালক্রমে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর পলিমাটি জমে নিম্নভূমি ভরাট হয়ে এক উর্বর অঞ্চলের সৃষ্টি হয়। এই উর্বর এলাকায় প্রায় ৬০০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকেই বিভিন্ন এলাকার মানুষ এসে সমবেত হতে থাকে। কালক্রমে এরাই মেসোপটেমিয়া সভ্যতার বীজ বপন করে।
এখানে নাকি অনেক ছোট ছোট টিলা ছিল। পরবর্তীকালে প্রত্নতত্ত্ববিদরা এসব টিলা খুঁড়ে মাটির বিভিন্ন স্তর থেকে বসতির নানা চিহ্ন আর ধ্বংসাবশেষ আবিস্কার করেন। আর এসব ধ্বংসাবশেষই প্রাচীন সভ্যতার সাক্ষ্য বহন করে।
2000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 4000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত কুয়েতের উপসাগর ছিল দিলমুন সভ্যতার আবাসস্থল। দিলমুনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল মূল ভূখণ্ড আক্কাজ, উম্ম আন নামিল দ্বীপ, এবং ফাইলাকা দ্বীপ।
বিজ্ঞানিদের মতে এই তথ্যগুলো ইঙ্গিত দেয় যে ফাইলাকাতে মানব বসতির চিহ্ন পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দের শেষের দিক থেকে ।
ফাইলাকা দ্বীপে পাওয়া সুমেরীয় কিউনিফর্ম গ্রন্থ অনুসারে দিলমুন রাজার উপাধি ছিল সার্ভেন্ট অফ ইনজাক অফ আকরোম , এখানে ইনজাক নামেই পরিচিত। দিলমুন সভ্যতার পরে ফাইলাকা মেসোপটেমিয়ার কাসাইটদের দ্বারা অধ্যুষিত ছিল, আনুষ্ঠানিকভাবে কাসাইট ব্যাবিলনের রাজবংশের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
ব্যবিলিয়ন শাসনামলে এখানে তৎকালীন রাজার প্রমোদ প্রাসাদ ও টেম্পল স্থাপনের কথা শোনা যায়। খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে মহাবীর আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট ফাইলাকা দ্বীপ দখলে নেয় এবং এর নামকরণ করেন ইকারস। আলেকজান্ডার এর প্রাচ্য নামই সিকান্দার বাদশা। এখানে এখনো ইকারস নামে স্থাপনা রয়েছে।
1990 সালের ইরাকি আক্রমণের আগে, দ্বীপটিতে দুই হাজারের বেশি বাসিন্দা এবং বেশ কয়েকটি স্কুল ছিল। আক্রমণকারী ইরাকিরা দ্বীপটিকে দখল করে জনশূন্য করতে এর সমস্ত বাসিন্দাকে মূল ভূখণ্ডে পাঠিয়ে দেয়।
1991 সালে বহুজাতিক বাহিনি ইরাকী বাহিনিকে পরাস্ত করে দ্বীপটির পুনর্দখল নেয় এবং আগ্রাসী বাহিনির পোঁতা সকল স্থল মাইন নিস্ক্রিয় করে। এখানকার সবকিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ইরাকী আগ্রাসী বাহিনি দ্বীপটির অনেক ক্ষতিসাধন করে যা এখনও পুরোপুরি মেরামত করা হয়নি।
বর্তমানে দ্বীপটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিত। সাপ্তাহিক ছুটিতে হাজার হাজার ভ্রমণপিয়াসীরা দ্বীপটিতে যাতায়াত করেন। যাওয়া আসার আরামদায়ক ফেরি, স্টীমার, বোট ইত্যাদির ব্যবস্থা রয়েছে। রাত্রি যাপনের জন্য মনোরম পরিবেশে হোটেলও রয়েছে দ্বীপটিতে। সেখানে ঘুরা ফেরা করার জন্য গাড়ী ভাড়া করে চড়ার সুবিধাও রয়েছে। চাইলে নিজেদের গাড়ী নিয়েও যেতে পারেন । চাইলে নিজেদের গাড়ী নিয়েও যেতে পারেন । এখানে আরো রয়েছে টুরিস্ট পার্ক, ফ্যামিলি পার্ক, হেরিটেজ পার্ক, স্যানিটোরিয়াম, হোটেল, সুইমিং পুল, তাঁবু ও চিড়িয়াখানা ইত্যাদি।
কুয়েত দেশটি ছোট হলেও এখানে রয়েছে অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য। 1990 সালে আক্রমণকারী ইরাকিরা দ্বীপটিকে ধ্বংস করলেও এখানে আসলে এখনো দেখা যায় সিকান্দার বাদশার প্রাসাদ, ইনজাক এর সমাধিস্থল, ৬০০০ বছর পূর্বের কারাগার এসব দৃশ্য দেখলে মনে করা যায় কেমন বর্বরতা চালিয়েছে ইরাকিরা আর কেমন ছিল প্রাচীন যুগ।
লেখক সাংবাদিক মঈন উদ্দিন সরকার সুমন।
ফাইলাকা দ্বীপের সম্পূর্ণ ভ্রমন কাহিনীর ভিডিও দেখতে নিচের লিংকে দেখুন
Discussion about this post