আমাদের ছোটপর্দার যে কজন নির্মাতা চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে এসেছেন, তাদেরই একজন মানিক মানবিক। প্রখ্যাত সাহিত্যিক রশীদ হায়দারের কিশোর উপন্যাস ‘শোভনের স্বাধীনতা’ অবলম্বনে প্রথম ছবি নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন তিনি। মানিক মানবিকের চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শিশুতোষ এ ছবি র্নিমিত হচ্ছে সরকারী অনুদানে। ‘শোভনের স্বাধীনতা’ ছবির সিংহভাগ অংশের শুটিং এরই শেষ হয়েছে। বাকি অংশের শুটিং শুরু হবে শিগগিরই। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ১৬ ডিসেম্বর এটি মুক্তি দেওয়ার ইচ্ছে আছে নির্মাতার। সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘শোভনের স্বাধীনতা’ ছবিটি সম্পর্কে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হলো নির্মাতা মানিক মানবিকের। তিনি ছবিটির নানা দিক সম্পর্কে জানিয়েছেন বাংলানিউজকে। টিভিমিডিয়ায় নাট্যকর্মী মানিক মানবিকের অভিষেক হয়েছিল নাট্যকার হিসেবে। তার রচনা ও পরিচালনায় বেশ কিছু একক ও ধারাবাহিক নাটক নাটক দর্শক প্রশংসা পেয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘সামসুদ্দীনের একুশ’, ‘একজন অসহায় মানুষ’, ‘হেট মাথা হেট মুন্ডু’, ‘চারুলতার পূর্বাপর’, ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে’, ‘এপিথ ওপিঠ’, ‘নো প্রবলেম ডট কম’, ‘সংসার সুখের হয় বেদনার গুণে’, ‘দ্বিমাত্রিক’ প্রভৃতি উলেখযোগ্য। বড় পর্দায় ‘শোভনের স্বাধীনতা’ তার প্রথম কাজ। প্রথমবারই কাজ করছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধের মতো গৌরবময় বিষয় নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের। মিডিয়া কাজ শুরু করার পর থেকেই স্বপ্ন দেখছি, চলচ্চিত্র নির্মাণের। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার প্রথম চলচ্চিত্রটি হবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। সেই থেকেই ভালো একটি গল্পের অনুসন্ধান করছিলাম। রশীদ হায়দারের ‘শোভনের স্বাধীনতা’ উপন্যাসটি এসময় আমার হাতে আসে। প্রথমবার পড়ার পরই এটি আমার হৃদয় স্পর্শ করে। চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদানের জন্যে পান্ডুলিপি আহ্বান করলে আমি এ উপন্যাসটিকে চিত্রনাট্য তৈরির জন্য বেছে নেই। এটি শিশুতোষ উপন্যাস হলেও এতে মুক্তিযুদ্ধের অনেক বাস্তর ঘটনার প্রতিফলন আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশের অনেক প্রথিতযশা পরিচালক বেশ কিছু ছবি নির্মাণ করেছেন। মানিক মানবিকের ছবিটিতে নতুনত্ব কী থাকছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের দেশে অনেক ভালো ভালো পরিচালক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি বানিয়েছেন। তাদের কাজও অসাধারণ। আমিও সেই পথেই হাটার চেষ্টা করছি। ছবির কাহিনী বিন্যাসে অবশ্যই ভিন্নতা আনার চেষ্টা করেছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সব শ্রেণীর মানুষেরই ভূমিকা ছিল। সেখান থেকেই একটি শ্রেণীর মানুষের অবদানকে আলাদাভাবে এ ছবিতে তুলে ধরেছি। এরা হলো সে সময়ের উঠতি বয়সী কিছু তরুণ। যারা সবাই ছিল এসএসসি পরীক্ষার্থী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাদের মনে কিভাবে তীব্রতা পেয়েছে তারই প্রকাশ আমার এ ছবিটি। ‘শোভনের স্বাধীনতা’ ছবিটি নির্মাণের জন্য প্রাপ্ত সরকারী অনুদান প্রসঙ্গে মানিক মানবিক বললেন, চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারী অনুদান আমার মতো অনেক নির্মাতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ করে দিয়েছে। তবে যে পরিমাণ অর্থ সরকার প্রদান করছে, তা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। । সরকার এ ছবির জন্যে আমাদেরকে নগদ ১৪ লক্ষ টাকা অনুদান দিয়েছে। এছাড়ার এফডিসির আনুষাঙ্গিক ব্যয়নির্বাহের জন্য আরও ১০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।অনুদানের টাকা তিনটি কিস্তিতে আমার হাতে হস্তান্তর করা হয়েচ্ছে। অনুদান পাশ করার ৩ দিন পর সরকার শতকার ৩০ ভাগ টাকা দিয়েছে। এরপর ৫ মাসের মধ্যে ছবির কাজ শতকরা ৪০ ভাগ সম্পন্ন দেখানোর পর আরেকটি কিস্তিতে টাকা পেয়েছি। আর বাকি টাকা আরেকটি কিস্তিতে দিবে ছবির কাজ শেষ হবার পর। বর্তমানে যারা অনুদান পাচ্ছেন তারা ছবির জন্যে নগদ ৩৫ লক্ষ টাকা পাচ্ছেন। এফডিসির খরচ বাবদ পাচ্ছে ১০ লক্ষ টাকা। এটাও পর্যাপ্ত নয়। ছবি নিমার্ণের বাজেটে ১ কোটি টাকা বরাদ্ধ থাকলে তবুও একটি ভালো ছবি নির্মাণ সম্ভব। ‘শোভনের স্বাধীনতা’ ছবির প্রধান চরিত্র শোভন। এ চরিত্রে অভিনয় করছেন নবীন এক কিশোর। নাম ভূমিকার এই অভিনেতা সম্পর্কে মানিক মানবিক বলেন, ছবিটিতে এসএসসি পরীক্ষর্থী কিছু তরুণের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তুলে ধরা হয়েছে। কাহিনীর চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজন ছিল বেশ কয়েকজন কিশোর। সে উদ্দেশ্যেই নটরডেম কলেজের একদল ছাত্র নিয়ে আমরা গ্রুমিং শুরু করি। প্রথমে ২০০ জন। এরপর ৪০ জন। সবশেষে ২০ জন থেকে বেছে নেই ১৩ জন ছাত্রকে। টানা দুইমাস চলে এ গ্রুমিং রাউন্ড। গ্রুমিংয়ে প্রত্যেকটি ছেলের উপর পর্যবেক্ষণ করা হত। ১৩ জন থেকেও একজন ছেলেকে পেলাম, যার মধ্যে সত্যিই অভিনয়ের প্রতি আসক্তি আছে। তার নাম রাইয়ান। আমার ছবির মূল চরিত্র শোভনের দায়িত্বটা তাকেই দিলাম। ছেলেটির অভিনয়ে প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও অভিনয়ের প্রতি তার একাগ্রতা আমাকে মুগ্ধ করে। ছবির প্রয়োজনে তার ভেতর থেকে বাকিটা বের করে নেওয়া তো একজন পরিচালকের কাজ। ‘শোভনের স্বাধীনতা’ ছবির অভিনয়শিল্পীদের বিষয়ে মানিক মানবিক জানান, মূল চরিত্র শোভন ছাড়াও শোভনের সহপাঠী কিশোর মুক্তিযোদ্ধার বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছে ১৩ জনের কিশোর দল। রাইয়ান, জীম, নাঈম, দীপ্ত, সাকিব, মাসুম. ধর্ম, নাঈমুজ্জামান, ফয়সাল, সাদমান, অরিজিৎ, সৈকত, জর্জদীপ্ত এই তেরজন কিশোরের প্রত্যেকেই নটরডেম কলেজের প্রথমবর্ষে অধ্যয়নরত। ঢালিউডের জনপ্রিয় নায়ক ফেরদৌস ও নায়িকা নিপুণ অভিনয় করছেন ছবিটির গুরুত্বপূর্ণ দুই চরিত্রে। এতে ফেরদৌসের চরিত্রটির নাম সুমন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোর দলটিকে সংগঠিত করতে তাকে দেখা যাবে দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করতে। নিপুণ অভিনয় করছেন রাজাকারের মেয়ে ময়না চরিত্রে। তবে সে স্বাধীনতা কামী। বাবার দেশবিরোধী কর্মকান্ড সে মেনে নিতে পারে না। বর্ষিয়ান অভিনেতা আতাউর রহমান এ ছবিতে করছেন শোভনের রাজাকার মামার চরিত্রে অভিনয়। মামী চরিত্রে চিত্রলেখা গুহ, বাবা চরিত্রে খায়রুল আলম সবুজ ও মা চরিত্রে ওয়াহিদা মল্লিক অভিনয় করেছেন। এছাড়াও আছেন স্বদেশ সুমন, চৈতি ও মাহমুদুল ইসলাম মিঠু, আলমগীর, মোশারফ, রনধীর বাপ্পী, শহীদ, হিরন্ময় হীরা ও অনেকে। ছবিটির শুটিং প্রসঙ্গে মানিক মানবিক বলেন, পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেন, হাটখোলা, কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া, সোনারগাঁয়ের পানামসিটি সহ আরো কিছু লোকেশনে শুটিং শেষ করেছি। বর্তমানে ছবিটির শুটিং চলছে মুন্সীগঞ্জের কলাকুপা বান্দুরার বিভিন্ন লোকেশনে। ছবির ৮০ ভাগ শুটিং শেষ। চলতি মে ও জুন মাসের মধ্যেই শুটিংয়ের সব কাজ শেষ হবে। ৫০ ভাগ সম্পাদনার কাজও শেষ করেছি। ছবিটির কারিগরি দিক সম্পর্কে তিনি বলেন, আমার ছবিটি ৩৫ ট্রান্সফারে নির্মাণ করা হচ্ছে। ছবির পোস্ট প্রডাকশনের কাজ তো অনেক ব্যয় বহুল। এ ছবিটির পোস্ট প্রডাকশনের জন্যে ভারতে চেন্নাইতে নিয়ে যাব। বড় পর্দায় কাজ এ প্রথমবার হলেও ছোট পর্দায় কাজ করেছেন অনেকবার। বড় পর্দার পরিচলক কি এখন ছোট পর্দা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছোট পর্দা দিয়েই আমার পরিচিতি। এ জায়গাটা ছাড়া সম্ভব নয়। ছোট পর্দা নিয়েও নিয়মিত ব্যস্ত আছি। ‘সংসার সুখের হয় বেদনার গুনে’ নামে নতুন একটি ধারাবাহিকের কাজ করছি। যার ১৩ পর্বের শুটিং এরইমধ্যে শেষ। আগামী মাস থেকে এটিএনবাংলায় ধারাবাহিকটি প্রচার হবে। এছাড়াও ঈদে প্রচার হবে দুইটি নাটক ও একটি টেলিফিল্ম। ‘সামমেয় সমাপনা’ ও ‘হায় প্রেম হায় ভালোবাসা’ নাটক দুটো কোন চ্যানেলে প্রচার হবে তার অপেক্ষায় আছে। আর ‘ম্বপনের স্বপ্ন এবং কল্পনার বাস্তবতা’ টেলিফিল্মটির শুটিং আগামী মাস থেকে শুরু করবো। বড় পর্দায় নতুন কাজ নিয়ে তিনি বলেন, ‘শোভনের স্বাধীনতা’ ছবির পর নতুন আরেকটি ছবির কাজ শুরু করবো। ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় নির্মান হবে ছবিটি। এর নাম ‘শ্রী চরনেষু’। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রযোজকদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কথা শেষ হয়েছে। এখন শুধু সরকারী অনুমোদনের অপেক্ষায় আছি। ভারতীয় শিল্পী জিৎ গাঙ্গুলি এ ছবিতে কাজ করবেন। সব ঠিক হলে এ বছর শেষের দিকে ছবির কাজ শুরু করবো।
Discussion about this post