হিংসার উন্মত্ততায় সারা পূথিবী আজ প্রকম্পিত। হিংসা, বিদ্বেষ, মননে সহনশীলতার অভাব “মানব সভ্যতা” বিকাশে আজ সব থেকে অন্তরায়। আমরা যেন কেউ কাউকে আজ সহ্য করতে পারছি না। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি, এক সম্প্রদায়ের মানুষ অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি যে ক্ষোভ, যে আচরণ করছে তাতে বিবেকবান মানুষ আজ শংকিত-স্তম্ভিত। হিংসা ও ক্ষোভের যে স্ফুলিঙ্গ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে জানি না এর শেষ কোথায়? বাতাসে আজ পোড়া বারুদের গন্ধ, দম বন্ধ করা বিষাক্ত এ বাতাসে কত সময় বেঁচে থাকা যাবে? ঘূর্নায়মান রাজনীতির চাকা সভ্যতাকে পিষ্ঠ করে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। যাকে আমরা ‘‘উন্নয়ন” বলে যত্ন করে চুমু খাচ্ছি। ভালবাসা বঞ্চিত পৃথিবীটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে কাঁদছে। সে কান্না আমরা শুনতে পাচ্ছি না। প্রবাহমান নদীর স্রোতধারার গন্তব্য থাকে সমূদ্রের দিকে।
ক্ষুদ্রত্বের থেকে বিশালত্বের দিকে ধাবমান মানসিকতায় আজ চড়া পড়ে যাচ্ছে, গজিয়ে উঠছে দ্বীপ, উপদ্বীপ, বদ্বীপ। ভঙ্গুর মননে শুদ্ধতার চর্চা থেকে সত্য, সুন্দরের অর্ন্তধান ঘটছে। হৈ হৈ, রৈ রৈ করে এগিয়ে আসছে হিংসার বাতাবরনে তৈরী নব্য এক সমাজ ব্যবস্থা। সবাইকে পদানত করে “আমার” ‘‘আমিত্বের” বড়াই – ‘‘আমিই শ্রেষ্ট” এ অহংবোধে আচ্ছন্ন উম্মাদের হাতে কতটুকু নিরাপদ এ বাসযোগ্য পৃথিবী? কিন্তু, বিশ্বাস করি এ দর্প চূর্ন হতে বাধ্য। গর্জনরত সমূদ্রের ঢেউ এক সময় কূলে আছড়ে পড়ে তার সমাপ্তি ঘোষণা করে, কারণ সেখানে থেকেই শুরু হয় ভূপৃষ্ঠ। সবুজে শ্যামলে, ফসলে, ভরে থাকে সে তটদেশ আবার সেখান থেকেই হয় সভ্যতার জয়যাত্রা। অনেক বাক, চড়াই উতরে যে নদীর যাত্রা গন্তব্য তার সমূদ্র স্রোতে অনেক পলিমাটি নিয়েও সমুদ্র ভরাটের চেষ্টা তার কখনও সফল হয় না।
নদী মরে যায়, ভরাট হয়, সমুদ্র কখনও মরে না, ভরাট হয় না। বিশালতায়, ব্যপ্তিতে সে মহীয়ান। শুভ শক্তির কাছে অশুভ শক্তির পরাজয় সুনিশ্চিত। তবে তাঁর মাশুল দিতে হচ্ছে অনেক। আদিম যুগেও মারামারি খুন খারাবির মূল উৎস ছিল আধিপত্য তথা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার, দখল করার। নিজ দলভুক্ত বা গোত্রের আনুগত্য লাভের আশায় নির্দয়ভাবে কাউকে হত্যা করার দৃষ্টান্ত খুবই কম ছিল। কিন্তু আজকের সভ্য যুগে হত্যা, লুণ্ঠন, খুনখারাবির মূল কারণ ভোগ, লিপ্সা, আরো আরো চাই, জবর দখল, অন্যের ধর্মমত অবিশ্বাস জনিত কারনে উৎপীড়ন স্থানান্তরকরণ, দেশান্তরিত করার যে অপপ্রচেষ্টা এ যেন তারই মহোৎসব চলছে। বলা চলে এ এক ক্রান্তিকাল, ক্রান্তিলগ্নও বটে। বর্তমান শিশুদের ও নারীদের উপরন্তু নিপীড়ন, নির্যাতনের মাত্রা এত বেড়েছে এবং হিংস্রতার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটছে তাতে বিবেকবান মানুষও শিউরে উঠতে বাধ্য। রাগ, ক্ষোভ, হিংসার যে রকমফের ঘটছে, মানুষ যে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে তা সমাজের ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহের দিকে নজর দিলে সহজেই বোধগম্য হয়।
এত অস্থিরতা, দুরভিসন্ধি, আগ্রাসী মনোভাব তৈরীর পিছনে কি কি উপাদান কাজ করছে তা খুঁজে বের করা দরকার। ধার্মিকেরা ধর্ম নিয়ে, আচার অনুষ্ঠানের দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে আগে তো এত বাড়াবাড়ি করেনি আবেগ তাড়িত হয়নি, তাহলে আজ কি প্রয়োজনে ধর্মের নামে অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ তুলে তুলকালাম কান্ড ঘটানো হচ্ছে? কারা এর মদদ দিচ্ছে তা খুঁজে বের করতেই হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হতে দেয়া যাবে না। জমাট বাঁধা এ সম্প্রীতিতে ধর্মের নামে উষ্কানি দিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি, হানাহানি, কাটাকাটি সমাজ দেখতে চাই না। এ অঞ্চলের ধর্মীয় মূল স্রোত বহুধারায় বিভক্তিতেও ঐক্যের গানে, সাম্যের গানে ছিল ভরপুর তাই তো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অহংকার। যে অহংকারের বদৌলতে ইংরেজদের তাঁড়িয়ে, পাকিস্তানীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, যুদ্ধ করে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এ ভূখন্ডের মানুষ আমরা। আমরা হারিয়ে যেতে দেবো না এ অহংকারের বীজ ঐক্য, সাম্য, ভ্রাতৃত্বকে। যত বাঁধা আসুক দ্বিজাতি তত্বের বিষ বৃক্ষের ফল আর এ মাটিতে অংকুরিত হতে দেবো না। সম্প্রদায়িকতার মাটিতে বন্ধ্যাত্ব নেমে আসুক, সম্প্রীতিতে উর্বরতার ফসলে ভরে উঠুক, ধর্ম যেন কোন দিন আমাদের বিভেদ আর বিচ্ছেদের হাতিয়ার না হয়। আমরা যেন ভাবতে পারি, নিঃশ্বাস নিতে পারি মানুষের মনুষ্যত্ব নিয়ে।
প্রতিদিন যাপিত হোক মানবতার ফুল ফুটিয়ে। জীবন বহমান হোক-ধনী, দরীদ্র, হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান, বৌদ্ধ সকল মানুষের হাতে হাত ধরে। কেউ ছিটকে পড়লে পদদলিত না করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে যেন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। আমাদের যেন পিছন ফিরে আর না তাঁকাতে হয়। হিংসা, অসভ্য বর্বরতার প্রতীক, উন্মত্ততা আবেগের রসে ঘন পরিপূর্ণ আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার উদগিরনে জ্বালা মুখের নির্গত ধোঁয়া, যা শুধু সারা আকাশকে আচ্ছন্ন করছে না, মানব জাতিকেই ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে এবং মনোজগতে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। উন্মত্ততার আস্ফালনে সম্পদের ক্ষতিই শুধু নয়, মানসপটে যে চিত্র আঁকা হয়ে যায়, যে ভীতির সঞ্চার দূর্বল মনে প্রভাব বিস্তার করে তার পরিণতি হয় ভয়ংকর। উন্মত্ততার জেরে নষ্ট গাড়ী, বাড়ি, দোকান, সম্পত্তির ক্ষতি একদিন পুষিয়ে নেওয়া যাবে কিন্তু মনের কোনায় জমে থাকা যে অশ্রদ্ধা, নির্মমতার নিষ্ঠুর চেহারায় ছবি আঁকা হয়ে গেল, সে কোন দিন তা ভুলতে পারবে না। ভয় পেলে ছোট শিশুরা যেমন ঘুমিয়ে পড়লে কেঁপে কেঁপে উঠে তেমনি সমাজে হিংসার উন্মত্ততায় নিগৃহীতরাও তেমনি আজ প্রতিদিন কেঁপে কেঁপে উঠছে। অজানা আশঙ্কায় কেন প্রতিটা দিনরাত অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে? পুঞ্জিভূত ক্রোধের, আক্রোশের সমষ্ঠিগত যোগফলই হচ্ছে হিংসা।
যাকে দেখা যায় না, শোনা যায় না বোঝা যায় না ভিতরে ভিতরে কাল বোশেখীর ঝড়ের মত হঠাৎ মনের কোনে অন্ধকার ঘনিয়ে সভ্যতাকেই লন্ডভন্ড করে তছনছ করে দেয়। চিরদিনের কাছের মানুষ, প্রতিবেশী সব তখন অচেনা। ‘ধরো-মারোর’ জোসে নিজেকে ঠিক রাখার টালমাটাল সময়ে “ধর্মীয় ”চেতনার উসকানিতে তখন সব কিছুকেই নিজের মতের, পথের সাম্রাজ্যের আওতায় আনতে চাই। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য, সে এক অন্য রকম মানুষ যেন। অন্তরে তখন শুধু হিংসার আগুন যার লেলিহান শিখায় ভষ্মিভুত হয়, তিল তিল করে গড়ে তোলা সভ্যতার অবকাঠামো বিন্যাসে পারষ্পারিক সংস্কৃতি, কৃষ্টি, প্রথা, রীতিনীতি রেওয়াজের চিরাচরিত সম্পর্কের বাতাবরণ। মসজিদ, মন্দির থেকেও হৃদয় ভাঙনের তীব্রতা এত বেশী প্রকটিত হয় যে দীর্ঘদিনের চেনা জগতটা যেন হঠাৎই অচেনা হয়ে যায়। দীর্ঘদিনের যাপিত জীবনে পারষ্পরিক সৌহৃদ্যতার যে মুগ্ধতা একে অপরকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল এক দমকা হাওয়াতেই তা নিভে যায়। হিংসার এ উগ্রতার কাছে হিংস্র প্রানীরাও হার মানতে বাধ্য।
ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যে পশু দ্বারা পশু আক্রান্ত হয়, কিংবা যৌনক্ষুধা মেটাতেই কেবলমাত্র উন্মত্ত আচরন করে পশুরা, কিন্তু মানুষ? যারা “সৃষ্টির সেরা জীব” হিসাবে খ্যাত যাদের ধৈর্য্য, সহ্য, সহনশীলতার ক্ষমতা অনেক বেশী তাদের হাত দিয়ে তাদেরই মত মানুষের এমনি নির্বিচারে আক্রমণে পুড়িয়ে মারা, পেট্রোল বোমা নিক্ষেপে হত্যা করা, আগুন দিয়ে ভষ্মিভূত করা কি শোভা পায়? না পাবার বেদনা মানুষকে অন্যায় কাজে প্রলুব্ধ করে, উৎসাহিত করে, কিন্তু ক্ষোভ বা বেদনা তৈরীর যে ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় তা কি শুধু জাগতিক প্রয়োজনে সীমাবদ্ধ নাকি পরলৌকিক কল্পনার রং এ এমন ভাবে চিত্রিত যার লোভ সামলানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। মোদ্দা কথা পরলৌকিক জগতের স্বপ্ন সুখের অবাস্তবতার কাছে পার্থিব জগতের বাস্তবতা হার মানে আর তখন দূর্ভাগ্য আমাদেরও, কল্পনার জগতে ভাসতে গিয়েই আমরা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি। জিনিসের পরিমাপের জন্য ওজনের ব্যবস্থা তথা দাড়িপাল্লার ব্যবস্থা থাকলেও “সঠিকতা” নিরূপনে বিবেকবোধ যখন বিকল হয়ে যায়, তখন তা নিরূপনে কোন মাপকাঠি থাকে না। শান্তি প্রিয় মানুষও অশান্তির বাতাবরনে তখন নিজেকে জড়িয়ে গর্হিত কর্ম করে আত্মতুষ্টিতে ভোগে, হয়তো সেটা তার দ্বিচারিতা। তারপরেও উল্টো রথে হাটা কিছু সাহসী মানুষ এখনও বিদ্যমান বিধায় আমরা আজও সমাজে মুখ দেখাতে পারছি।
পূথিবীটা বাসযোগ্য রাখার জন্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ঐক্যই পারে এ হিংস্রতা রুখতে। রুখে দাঁড়িয়েছে আবারও দাঁড়াবে। তবে সময় চলে যাচ্ছে, দ্রুত অন্ধকার থেকে আলোতে ফিরতেই হবে, হানাহানি, কানাকানির অবসান ঘটিয়ে সমাজের ক্লেদ ভরা কুসংস্কার ও রাজনীতির অশুভ বলয় থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। নীতি আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা থাকলেও সত্য, সুন্দরের জয় ধ্বজাকে ভুলুন্ঠিত হতে দেওয়া যাবে না। মানবিকতার প্রতি দৃঢ়তা ও কঠোরতাধে শৃঙ্খলিত বিবেক বোধকে আজ জাগ্রত করতেই হবে। অশনি সংকেতের ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে হাটে, ঘাটে, মাঠে, মানবতার জয় গান গাইতেই হবে। মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে ঐক্যতানে ঝংকার উঠুক, “আমরা মানুষ”, “মানুষের চেয়ে নহে কিছু মহীয়ান” কিংবা “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই” এই মন্ত্র- বাক্যে আমরা সবাই উজ্জ্বীবিত হয়ে উঠি। অনাগত ভবিষ্যতের উন্নয়নের জোয়ারে কুপমণ্ডুতা পরিহার করে যুগের সংগে তাল মিলিয়ে আমরাও যেন সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে পারি হাতে হাত ধরে এই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা। পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করার জন্য আমরা প্রজ্ঞা, বুদ্ধি, জ্ঞান যা আমাদের আছে তাকে কাজে লাগিয়ে মনের আকাশে জমে থাকা কালো মেঘকে ঘূর্নিতে রূপান্তরিত না করে বর্ষার স্নিগ্ধ স্রোতধারায় সকল মোহ কালিমাকে ধুয়ে মুছে যেন সাফ করতে পারি।
লেখক: কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত
Discussion about this post