মুম্বাই: পাঁচ ঘণ্টা প্রতীক্ষার ১৮ মিনিট সময় পাওয়া গেল বিদ্যার কাছ থেকে। বিদ্যা বাগচি ওরফে বিদ্যা বালানের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় বসেছিলেন জিনিউজ। যেই ১৮ মিনিটের আলোচনায় বিদ্যা তার ক্যারিয়ারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবই জানালেন। সেই সঙ্গে জানালেন তার শতভাগ বাঙালি হওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথাও।
প্রশ্ন: বিদ্যা, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন!
বিদ্যা: থ্যঙ্ক ইউ।
প্রশ্ন: যেভাবে আপনি দেশের সব ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডগুলো ছিনিয়ে নিচ্ছিলেন, তাতে জাতীয় পুরস্কার না পাওয়াটাই বরং ইনজাস্টিস হত…
বিদ্যা: আমি কিন্তু সেটা মনে করি না। জাতীয় পুরস্কারের পরিধি অন্য সব অ্যাওয়ার্ডের থেকে অনেক বড়। সব ভাষার আঞ্চলিক ছবির নায়িকারাও এই বিরাট গণ্ডির ভিতরে আসেন। হিন্দি ছবি, মানে বলিউড ছবির সব শ্রেষ্ঠ পুরস্কারগুলো পাওয়া সত্ত্বেও একজনের ভাগ্যে জাতীয় পুরস্কার না-ও জুটতে পারে। ওটা অনেক টাফ্ কম্পিটিশন। কারণ ওখানে রিজিওনাল পারফরম্যান্সকেও সমান গুরুত্ব দেয়া হয়। আমার ভাগ্য প্রসন্ন, তাই অন্যসব অ্যাওয়ার্ডের সঙ্গে আমি জাতীয় পুরস্কারটাও পেয়ে গেলাম।
প্রশ্ন: আর জাতীয় পুরস্কারের পর কলকাতার মিডিয়াকে দেয়া প্রথম সাক্ষাত্কার এটাই…তাই তো?
বিদ্যা: হ্যাঁ। এটাই প্রথম সাক্ষাত্কার। বিশেষ করে, কলকাতা থেকে ফোন এলে আমি খুব খুশি হই।
প্রশ্ন: বাংলার মিডিয়া যখন এক দক্ষিণী নায়িকাকে নিয়ে আনন্দে উত্ফুল্ল হয়, কেমন লাগে?
বিদ্যা: আরে, আমি তো কলকাতারই মেয়ে। আই অলওয়েজ সে দ্যাট, আই অ্যাম আ বেঙ্গলি অ্যাট হার্ট! আমি যে আজ এই পর্যন্ত এসেছি, তার নেপথ্যে তো কলকাতার মানুষই রয়েছেন। আমার প্রথম ছবি গৌতম হালদারের ‘ভালো থেকো’ পুরোটাই কলকাতায় শুটিং, তারপর ‘পরিনীতা’, শরত্চন্দ্রের উপন্যাস। কলকাতায় আর দার্জিলিংয়ে শুটিং। তারপর ধরুন ‘ভুলভুলাইয়া’, ওখানেও আমার চরিত্রের নাম মঞ্জুলিকা। যে একজন বাঙালি নৃত্যশিল্পী। এরপর এবার ‘কাহানি’, বাঙালিপনার পুরো ক্যানভ্যাস জুড়ে আমি। যদিও এখানে আমি বাঙালি মেয়ে নই। তবে, বাঙালি ঘরের বউ। পশ্চিমবঙ্গ আর কলকাতা আসলে আমার ঘরবাড়ি, ক্যারিয়ারের সূত্রে।
প্রশ্ন: তার মানে আপনি শতকরা ৭৫ ভাগ বাঙালি?
বিদ্যা: (হাসি) তাই? কিন্তু আমি তো ১০০ ভাগ বাঙালি হতে চাই, তা কবে হবো?
প্রশ্ন: হয়তো ‘কাহানি’র জন্য জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর?
বিদ্যা: হাসি…
প্রশ্ন: সমোলোচকরা এখনই বলাবলি করছেন যে, আপনার ২০১২ সালের জাতীয় পুরস্কারটাও বাঁধা। যে লেভলের পারফর্মেন্স দিলেন আপনি।
বিদ্যা: (অবাক হয়ে) তাই নাকি? তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ভাল লাগছে যে, এতো মানুষ অ্যাপ্রিশিয়েট করছেন।
প্রশ্ন: বিদ্যা ম্যাজিক তো আগের সব কাহিনিই বদলে দিচ্ছে। দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছে বিদ্যার ‘কাহানি’।
বিদ্যা: এই সবই ঈশ্বরের মহত্ত্ব। কিন্তু আমার মনে হয়, সিনেমা নিয়ে চিন্তাভাবনা বদলেছে। সিনেমার ভাষাও বদলেছে। দর্শকরাও বুঝতে পারছেন সেই ভাষা, নিজেকে মিলিয়েও নিতে পারছেন তা সঙ্গে। এখন হিন্দি ছবিতে নায়িকারা শুধুই শো-পিস হিসেবে থাকেন না। কিংবা মেয়েদের শক্তিরূপিনী মায়ের ভুমিকায়, কিংবা ভালত্বের সর্বসেরা উদাহরণ হিসেবেও দেখনোর দিন শেষ। সব মানুষই যেমন দোষে গুণে মিলিয়ে তৈরি হয়, তেমনি মেয়েরাও পর্দায় দোষে গুণে ভরা একটি চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে। দর্শকরা তা সগ্রহণও করছে। ভাগ্যক্রমে আমি সেইসব চরিত্রেই অভিনয় করার সুযোগ পাচ্ছি, যাদের মধ্যে সাহস আর দুর্বলতা দুটোই আছে। কাজে ভিন্নতাও আছে। আমি বিভিন্ন ধরনের নারীচরিত্রকে পর্দায় তুলে ধরতে পারছি।
প্রশ্ন: যেকোনো নারী চরিত্রকে গঠন করার পেছনে পরিচলকের ভূমিকা উপেক্ষা করা যায় না। আপনার কেরিয়ারগ্রাফে পরিচালকদের ভূমিকা কেমন?
বিদ্যা: নিশ্চয়ই। যখন মিলন লুথারিয়া ‘দ্য ডার্টি পিকচার’ ছবির প্রথম পরিকল্পনাটি নিয়ে এসেছিলেন, আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি। উনি আমাকেই কেন নির্বাচন করলেন, সেটার ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। তারপর মিলনের সঙ্গে একতা কাপুরও এলেন আমাকে বোঝানোর জন্য। কথা বলতে বলতে মনে হলো যে, কখন যেন চরিত্রটার মধ্যে ঢুকে পড়ছি। সিল্কের দুঃখ, কষ্ট, অসম্মান, অবমাননা সবই আমার অনুভূতির জগতে চলে আসছে। আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলাম যে, আমিও এই ধরনের চরিত্র একাই কাঁধে বয়ে নিয়ে যেতে পারি। আমার বিশ্বাস আর কাজের মধ্যে অনেক ফারাক। কী করে স্ক্রিনে ফুটিয়ে তুলব সেই রক্তমাংসের সিল্ককে? এখানেই মিলন লুথারিয়া এলেন উদ্ধারকর্তার ভূমিকায়। আঙুল ধরে বাচ্চাদের যেমন করে হাঁটতে শেখায় বাবা, ঠিক তেমনভাবেই মিলন আমাকে সিল্ক করে তুলেছিলেন। মিলন আমাকে একজন আদর্শ শিক্ষকের মতো গাইড করেছেন। আমার বিশ্বাস জোরদার ছিল যে, তিনি ‘ডার্টি পিকচার’র মধ্য দিয়ে সমাজে সিল্কের মতো নারীদের একটা ‘ক্লিন’ পিকচার তৈরি করতে পারবেন। অশালীনতার লেশমাত্র না রেখে তিনি কেমন পরিচ্ছন্ন ছবি বানালেন! মিলন দেখাতে পেরেছেন কতখানি সম্মান দেয়া যেতে পারে
একজন মহিলাকে।
অন্যদিকে সুজয় আমার বন্ধুর মতো। সুজয়ের অনেক স্ক্রিপ্ট এর আগে রিজেক্ট করেছি। এই ছবির চরিত্রটা ভালো লাগায় রাজি হয়েছি। সুজয় ফোন করে আমাকে গল্পটা শুনিয়েছে। ‘কাহানি’র ভেতরের কাহিনিটাই হলো রহস্য। যা বিদ্যাকে তৈরি করতে হয়েছে তিল তিল করে। একটা গোটা ছবিতে আমাকে কোনো গান বা নাচ করতে হয়নি। অলিগলির মধ্যে দিয়ে শুটিং। সুজয়কে তো প্রথমে কোনো প্রডিউসার টাকা দিতে রাজি হচ্ছিল না। শর্ত দিচ্ছিল গেস্ট অ্যাপিয়েরেন্স হিসেবে কোনো নামকরা সেলিব্রিটিকে নিতে হবে। সুজয় কোনো কম্প্রোমাইজের রাস্তায় হাঁটেনি। একদিন আমাকে বললো, নিজের বাড়ি মর্টগেজ দিয়ে শুটিং শুরু করবে। আমি ওকে আরো কিছুদিন চেষ্টা করতে অনুরোধ করলাম। তারপর অবশেষে পাওয়া গেল প্রডিউসার। বিদ্যার চরিত্রটা আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জই ছিল বলতে পারেন।
প্রশ্ন: বিদ্যা তো পুরো বছরই মাত করেছে, সেই সঙ্গে ‘সিল্ক’র দাপটে ‘শীলা’, ‘মুন্নি’, ‘চিকনি চামেলি’রা সব মুখ লুকাচ্ছে! ব্যাপারটা কেমন উপভোগ করছেন?
বিদ্যা: (হাসি) তাই নাকি! ওরে বাবা! শুনুন, সিল্ক কিন্তু শুধুই ‘উ লা লা’ গার্ল নয়। সিল্ক মানে শুধু নারীর শরীরও নয়। প্রথমত, দর্শক ভালোবেসেছে সিল্ককে। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি মহিলা নিজের জীবনকে কোনো না কোনোভাবে সিল্কের সঙ্গে আইডেনটিফাই করেছে। তাদের মনের কোণে জায়গা করে নিয়েছে। মোট কথা, সিল্ক কোনো কম্পিটিশন ছুঁড়ে দেয়নি চিকনি চামেলি বা মুন্নির দিকে। শরীর ব্যবহার করে শীলা বা মুন্নির সঙ্গে যুদ্ধে নামতে চায়নি। এজন্যই দর্শক ভালোবেসেছে তাকে। সিল্ক জীবনের সব অমসৃণ পথ তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে, শরীর দিয়ে পার হয়েছে। খুব কঠিন। কিন্তু এই কঠিন পরীক্ষাতেই সিল্ক জিতেছে।
প্রশ্ন: শরীরের প্রসঙ্গ যখন এলো, আপনাকে তো ‘দ্য ডার্টি পিকচার’র জন্য ভীষণভাবে ফিজিক্যাল স্ট্রেস নিতে হয়েছে। চরিত্রের প্রয়োজনে দেহের ওজন অস্বাভাবিক বাড়ানো বা কমানো কি পরিমাণ চাপ ফেলেছে?
বিদ্যা: দেখুন, সুযোগটা পেয়েছি এটাই সবচেয়ে বড় কথা। আমি পুরো ১২ কেজি ওজন বাড়িয়েছিলাম। শেষদিকের সিল্ককে জীবন্ত করে তোলার জন্য। ফ্যাট জাতীয় খাবার খেয়ে।
প্রশ্ন: এখন তো জিরো ফিগারের নায়িকারা সেক্সি বিদ্যাকে দেখে রীতিমতো প্রমাদ গুণছেন, তাদের দিন কী ঘনিয়ে এলো?
বিদ্যা: (হাসি) আপনার বডি টাইপ যাই হোক না কেন, সেটাই সেলিব্রেট করা উচিৎ। সেটাই সুন্দর, যদি রোগা হও, তা-ও সুন্দর। যদি স্বাস্থ্যবতী হও, সেটাও সুন্দর। শরীরের ওপর অযথা জোর খাটিয়ে রোগা হওয়ার কোনো মানে নেই। দেখুন, ১২ কেজি ওজন বাড়িয়েও লোকে আমাকে সেক্সি বলেছে।
প্রশ্ন: তবুও সিল্ক চরিত্রের ওপর আপনার জীবনের বাজি ধরা ছিল। ছবি ফ্লপ করলে, অতিরিক্ত মেদবহুল চেহারা, যেটা দর্শক দেখে ফেলেছে, সেটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াতো না ক্যারিয়ারে?
বিদ্যা: দেখুন, সিল্কের ইমেজের কাছে বিদ্যার স্টার পাওয়ার কিন্তু বড় নয়। অতিরিক্ত মেদ জমেছে সিল্কের শরীরে, বিদ্যার শরীরে নয়। বিদ্যা শুধু আশা ভরসা অক্ষুণ্ণ রেখেছে সিল্কের ওপর। এখানেই চরিত্রটা ক্লিক করেছে। আমার তো মনে হয় অভিনেত্রী বিদ্যার ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাবই পড়তো না।
প্রশ্ন: আজ যখন আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখেন, প্রতিবিম্বে কোনোদিন ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের সংগ্রামী বিদ্যাকে দেখতে পান? তখন কি রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়তে ইচ্ছা করে না?
বিদ্যা: সত্যি বলছি, একদম না! আয়নায় দেখা অতীতটা খুব সুন্দর। স্বপ্নময়। প্রিয়জনের ভালবাসা। বড়দের আশীর্বাদ। আমার এগিয়ে চলা। সত্যি বলতে কী, অতীতের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। অতীতই গড়ে দিয়েছে আজকের বিদ্যাকে।
প্রশ্ন: কিন্তু সেইসব সুখগুলোর কী হবে, যারা একদিন ‘চলবে না’ বলে লিড রোল থেকে বাদ দিয়েছিল আপনাকে?
বিদ্যা: ওইসব আমারও মনে আছে। কিন্তু তাদের সম্পর্কে আজ আমার কোনো অভিযোগ নেই। বরং, তারা আমাকে জীবনের কঠিন পথটা চিনতে শিখিয়েছিলেন। আমি কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি।
প্রশ্ন: যতোদূর জানি, আপনি নিশাচর ধরনের। এতো রাত জেগে থাকেন কেন? প্রেম, না পরিশ্রম?
বিদ্যা: পরিশ্রম, পরিশ্রম! শুধুই হার্ড ওয়ার্ক, প্রেম নয়।
প্রশ্ন: চান্স পেলে কোনোও বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করবেন? তাহলে কিন্তু আপনি ১০০ ভাগ বাঙালি হতে পারবেন!
বিদ্যা: যা বলেছেন। আমার ঘরবাড়ি তো কলকাতাই। শ্বশুরবাড়িটাও বাঙালি হবে কি না জানি না। ভালো বাঙালি পাত্র পেলে তো ভালোই হয়। ১০০ ভাগ বাঙালি হতে চাই আমি।
প্রশ্ন: শেষ প্রশ্ন, আপনার বাংলা গানের ভাণ্ডার তো দিন দিন বেশ শক্তিশালী হচ্ছে শুনেছি। একটা গেয়ে শোনান।
বিদ্যা: (একটু চুপ থেকে) আমাকে আমার মতো থাকতে দাও/ আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি/ যেটা ছিল না, ছিল না…হুঁ…হুঁ… আমার মনে হয় বাকি লাইনগুলো আমি ভুলে গেছি।
প্রশ্ন: সেটা না পাওয়াই থাক…
বিদ্যা: ঠিক। (সুর করে) সব পেলে নষ্ট জীবন…
Discussion about this post