বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম -বছরের ১১ মাস তেমন খোঁজ না থাকলেও রোজার মাসে দৌড়-ঝাপ ও বিভিন্ন ধরনের ক্যাম্পেইন শুরু করে রূহ আফজা, টার্গেট রোজাদার ব্যক্তি। রুহ আফজা হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াকফ) বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় পানীয়। হামদর্দ এর প্রতিষ্ঠাতা হাকীম আব্দুল মজিদ ১৯০৭ সালে এই ফর্মুলেশনটি তৈরি করেন। তবে এখন ঘরে ঘরে পরিচিত এই পণ্যটিতে কি পরিমাণ প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়, যে রংটি ব্যবহার করা হয় তা ফুড কোড মেনে হয় কিনা- এ ব্যাপারে কিছুই কিছুই জানা নেই বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সিটিটিউশন)। তাছাড়া টকটকে যে লাল বর্ণ দেখা যায় এটি ফলের রসের কি না তাও জানে না বিএসটিআই। এবং বিএসটিআই সর্বশেষ কবে রুহ আফজা’র মা পরীক্ষা করেছিল তাও সঠিক ভাবে বলতে পারছে না বিএসটিআই’র মান ভবন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (মান ভবন) বিএসটিআই এর ফিল্ড অফিসার শহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, “রুহ আফজায় প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয় এটি শতভাগ সত্য। তবে কি পরিমাণ ব্যবহার করা হয় তা আমাদের অজানা। কারণ তারা এই ব্যপারে আমাদের কাছে আসে না।”
তিনি আরো বলেন, “রুহ আফজায় কী রং ব্যবহার করা হচ্ছে সেটিও আমাদের জানা নেই। কারণ এ ব্যাপারে তারা আমাদের কাছে আসেনি। তারা জানে এটি খেলে মানুষের সামান্য সমস্যা হলেও হয়ত মানুষ মরবে না।”
রমজানে রোজাদার ব্যক্তিরা অনেক আগ্রহ নিয়ে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করে। বাংলাদেশে এই পানীয়ের তালিকায় অন্যতম হচ্ছে রূহ আফজা। হামদর্দের প্রচারণায় এমনও বলা হয় যে রূহ আফজা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত পানীয়। সিয়াম ব্রত পালন শেষে গ্রহণ করা কোটি মানুষের পছন্দের পানীয়টি সম্পর্কে স্বাভাবিক আগ্রহ রয়েছে সাধারণ্যে। তারা জানতে চায় এর প্রস্তুত প্রণালী ও উপকরণ সম্পর্কে। বাংলানিউজের পক্ষ থেকে বিষয়টি অনুসন্ধানে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের মেঘনা ঘাটে অবস্থিত হামদর্দ ল্যাবরেটরিজে (ওয়াকফ) সজেমিনে যাওয়া হয়। এখানেই তৈরি হয় দেশ ও ‘বিশ্বখ্যাত’ কোমল পানীয় রুহ আফজা।
কারখানায় ঢুকতেই ফটোগ্রাফার ও আমাকে নিরাপত্তা কর্মীর বাধার মুখে পড়তে হল। গণমাধ্যম কর্মী হিসাবে পরিচয় দিতেই মূল ফটকে দায়িত্বরত ব্যক্তি বললেন, হেড অফিসের অনুমতি লাগবে। এরপর ফোন করা হলে হেড অফিস থেকে জানানো হয়, রুহ আফজা আপনাদের যা জানা দরকার ত জানতে হেড অফিসে আসেন। কারখানায় সাংবাদিক ঢোকা যাবে না। অবাধ তথ্য প্রবাহের এই যুগে, যেখানে তথ্য অধিকার আইন বলবৎ রয়েছে, সেখানে জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে জানতে বাধার মুখে পড়তে হলো!
এরপর প্রায় ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করলাম। কিন্তু প্রিয় পানীয় রুহ আফজার কারখানায় ঢোকার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল।
এরপর রাজধানীর বাংলা মোটরে অবস্থিত হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াকফ) বাংলাদেশের সহকারী পরিচালক জাফর সাদিক এর কাছে জানতে চাই, রুহ আফজায় কি পরিমাণ প্রিজারভেটিভ মেশানো হয় আর এতে ব্যবহার করা রংটি কি ধরনের?
রংটি স্বাস্থ্য সম্মত কি না এই ব্যাপারেও প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এই ব্যাপারে কারোর সাথে আমাদের কথা বলা নিষেধ আছে।”
ফের প্রশ্ন করতে তিনি বলেন, “আমরা বলতে পারবো না।”
মেঘনা ঘাটে তাদের কারখানায় যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বলি। সেখান থেকে এখানে খোঁজ নিতে আসার কথা বলা হয়েছে জানালে তিনি বলেন, “ওখানে যাওয়ার দরকার নেই। আপনাদের কোনো কিছু জানার দরকার হলে প্রশ্ন লিখে দিযে যান। পরে আপনার উত্তর করে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।”
তিনি আরও বলেন, “রুহ আফজার ব্যাপারে আমাদের ওপর থেকে নিষেধ আছে যে কারোর সাথে কথা বলা যাবে না। আমাদের এই কথা বলে চাকরি দেওয়া হয়েছে।”
রুহ আফজায় কী পরিমাণে প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয় এবং যে রং ব্যবহার করা হয় সেটি স্বাস্থ্যসম্মত কিনা প্রশ্ন করলে ভিন্ন কথা বলেন হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াকফ) বাংলাদেশের ডেপুটি মার্কেটিং ডিরেক্টর আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, “যে খাদ্যে ৬০ ভাগ চিনি থাকে সেখানে প্রিজারভেটিভের দরকার পড়েনা।”
অর্থা রুহ আফজার বোতলের ভেতরে যা থাকে তার ৬০% হচ্ছে চিনি।
তিনি আরো বলেন, “প্রিজারভেটিভের কাজ ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করা। চিনির পরিমাণ বেশি থাকলে সেখানে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে না।”
এ প্রসঙ্গে উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “যেমন, মিষ্টির দোকানে কোনো প্রিজারভোটভ লাগে না।”
রং এর ব্যাপারে বলেন, “আর্ন্তজাতিক মানের ফুড ড্রাগ অ্যান্ড কসমেটিক (এফডিসি) রং ব্যবহার করা হয়।”
হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ(ওয়াকফ) বাংলাদেশের ডেপুটি মার্কেটিং ডিরেক্টর আমিনুল ইসলাম এর কথার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন থেকে যায়, রুহ আফজায় যদি ৬০ ভাগ চিনি থাকে তাহলে অনন্যান্য উপাদান রুহ আফজায় রাখার জায়গা কোথায়?
যেমন রুহ আফজার বোতলের লেবেল থেকে জানা যায়, রুহ আফজায় থাকার কথা ২৬ প্রকারের উপাদান। যেমন, কেওড়া পাতনলব্ধ নির্যাস ০.১৭ মিলি, লেবুর পাতনলব্ধ নির্যাস ০.০৪ মিলি, গোলাপের পাতনলব্ধ নির্যস ০.০৩ মিলি, ধনিয়া ০.২২৫ মিলি, গাজর ০.২২৫ মিলি, নুনে শাক ০.২২৫ মিলি, তরমুজ ০.২২৫ মিলি, পালং শাক ০.২২৫ মিলি, পুদিনা ০.২২৫ মিলি, ধুন্দল ০.২২৫ মিলি, কাসনী ০.২২৫ মিলি, খসখস ০.২৫৫ মিলি, শাপলা ০.২২৫ মিলি, গাওজবান ০.২২৫ মিলি, কমলা লেবুর রস ০.১০ মিলি, আনারসের রস ০.৩৫ মিলি। এই ১৬টি উপাদানের উল্লেখিত পরিমাণ মোতাবেক ওজন ৩.১৬৫ মিলি।
শুধু এসব উপাদানই নয়, এর সাথে আরো থাকার কথা সাদা চন্দন, নাসপাতি, আঙ্গুর, ডালিম, মাল্টা, আপেল, ছড়িলা, পাথরের পাতা ইত্যাদি। আর উপরের সবগুলো উপাদান ঠিকঠাকমত মিশিয়ে রুহ আফজা তৈরি হয়ে থাকলে তা সাধারণ্যে বিশেষ করে গণমাধ্যমকে দেখাতে এত আপত্তি কেন তাদের? কেন নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাটে যেখানে রুহ আফজা তৈরি হয় সেখানে কেন এত রাখ-ঢাক ভাব কেন?
আর কেনইবা হেড অফিসে রুহ আফজার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে সবাই মুখে কুলুম এটে বসে থাকেন!
বিষয়টি নিয়ে জনমনে সন্দেহ দানা বাঁধছে।
Discussion about this post