সত্যের সেনানী– কায়েস মাহমুদ..
সূর্য উঠছে। ঝলমল রোদ ছড়াচ্ছে ধীরে ধীরে। হ্যাঁ, এমনি কাল। এমনি সময় তখন। ইসলামের আলো তখন কেবল ছড়াতে শুরু করেছে। বলতে গেলে ইসলামের একেবারেই প্রথম দিক।
এমনই সময়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন আবদুল্লøাহ।
নেহাতই কম বয়স। সেই বয়সে দীনের দাওয়াত পাওয়া মাত্রই তিনি রাসূলের (সা) সাথী হয়ে গেলেন।
কিন্তু পিতা! পিতা সুহাইল কোনো ক্রমেই তখনো ইসলাম গ্রহণ করতে নারাজ। শুধু কি তাই! ইসলাম গ্রহণের ফলে পুত্রকে তিনি শাসাতে থাকেন সর্বক্ষণ।
কিন্তু এভাবে আর কত? আবদুল্লাহ প্রাণ খুলে কাজ করতে পারেন না আল্লাহর রাস্তায়। প্রাণ ভরে গ্রহণ করতে পারেন না রাসূলের (সা) সান্নিধ্য।
এক সময় মনবেদনায় তিনি চলে গেলেন হাবশায়। গেলেন বটে, কিন্তু বেশি দিন সেখানে থাকতে পারলেন না। আবারও ফিরে এলেন মক্কায়। পিতার গৃহে।
আবদুল্লাহকে হাতে পেয়ে সুহাইল এবার তাকে বন্দী করলেন। এবং তারপর থেকে আবদুল্লাহর ওপর চলতে থাকলো পিতার নির্যাতন।
নিজের সন্তান! কত আদরের! কত স্নেহের! কিন্তু সকল মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে গেল পুত্রের ইসলাম গ্রহণের কারণে।
অত্যাচার আর নির্যাতন! চলছে তো চলছেই।
এক সময় সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেল। আর সইতে পারছেন না পুত্র আবদুল্লাহ। পিতার হাত থেকে, বন্দিদশা থেকে মুক্তিও পাচ্ছেন না।
কী করা যায়? ভাবলেন আবদুল্লাহ।
তারপর কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নেয়ার চিন্তা করলেন।
তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে এমন ভান করলেন, যেন ইসলাম ত্যাগ করেছেন।
তার এই কৌশল বেশ কাজে লাগলো। এখন পিতার অত্যাচার আর নেই। নেই আর বন্দিদশা।
রাসূল (সা) হিজরত করেছেন মদিনায়। এরই মাঝে শুরু হয়ে গেল বদরের যুদ্ধ। সে এক ঐতিহাসিক যুদ্ধ! এই যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য সুহাইলের পুত্র আবদুল্লাহকে পাঠালো কুরাইশরা।
বদর প্রান্তর। চলছে যুদ্ধের মহড়া।
ঠিক এমনি এক সময়ে আবদুল্লাহ দ্রুত চলে গেলেন মুসলিম মুজাহিদদের কাতারে। শামিল হয়ে গেলেন তিনি জানবাজ সত্যের সৈনিকদের মাঝে।
বিস্ময়ে হতবাক কুরাইশরা। তাদের চেয়েও বেশি হতবাক পিতা সুহাইল।
ব্যাপার কী? তাহলে কি আবদুল্লাহ প্রকৃত অর্থেই ইসলাম ত্যাগ করেনি?
না, করেননি। কারণ ঈমানের নূর ও রশ্মি একবার যে হৃদয়ে প্রবেশ করে, সেই হৃদয় তো হয়ে যায় ওহুদ পর্বত। সেখানে থাকে না ভয়। থাকে না শঙ্কা।
আবদুল্লাহও এখন সেই সকল সাহসী মুজাহিদদের কাতারে, যারা ইসলাম, আল্লাহ ও রাসূলের (সা) জন্য সকল কিছুই ত্যাগ করতে প্রস্তুত।
বদর প্রান্তরে পিতার প্রতিকূলে পুত্রকে দেখে অপমান বোধ করলেন সুহাইল। তিনি ভীষণভাবে রেগে গেলেন। পুত্রকে যোগ্যতম শাস্তি দেয়ার জন্য প্রাণপণে এগিয়ে গেলেন। তার ইচ্ছা-বদর প্রান্তরেই হোক পিতা-পুত্রের ফয়সালা। কিন্তু কিছুই করতে পারলেন না সুহাইল। মুসলিম বাহিনীর রণকৌশল, শক্তি এবং আত্মত্যাগের যে সাহসী সৈকত আছড়ে পড়তে দেখলেন, তাতে ফিরে তিনি হতবিহবল হয়ে পড়লেন।
পুত্রকে উচিত শিক্ষা দেয়া তো দূরের কথা, নিজেরাই শিক্ষা গ্রহণ করতে বাধ্য হলেন। যুদ্ধে পরাস্ত হলো মুশরিক বাহিনী। বিজয়ের আলোয় উদ্ভাসিত মুসলিম বাহিনী।
যুদ্ধে আবদুল্লাহ ছিলেন রাসূলের (সা) সাথে। তিনি জীবন-মৃত্যুর চিন্তা দূরে রেখে কেবল আল্লাহ ও রাসূলের (সা) জন্য লড়ে গেছেন সাহসের সাথে। সুতরাং বদর বিজয়ের আনন্দে তিনিও সমান আনন্দিত।
শুধু বদর নয়।
বদরের পর রাসূল (সা) যতগুলো যুদ্ধ করেছেন, প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি রাসূলের (সা) সাথে ছিলেন। এমনকি মক্কা বিজয়ের সময়ও তিনি ছিলেন রাসূলের (সা) সঙ্গী।
মক্কা বিজয় করলেন রাসূল (সা)। বিনা রক্তপাতে ঘটে গেল এক মহান বিজয়।
মক্কা বিজয়ের পরও সুহাইল রয়ে গেলেন আগের মত, মুশরিক অবস্থায়। কিন্তু আশঙ্কা করলেন তার জীবননাশের। ভয়ে তিনি জড়োসড়ো। পুত্র আবদুল্লাহকে খুব সংকোচের সাথে বললেন, রাসূলের (সা) কাছে যেতে। রাসূল (সা) যেন তাকে নিশ্চয়তা দেন সেই জন্য।
পিতার কথা রাখলেন পুত্র আবদুল্লাহ। রাসূলকে (সা) বলতেই বললেন, ঠিক আছে, তোমার পিতাকে নিশ্চয়তা দেয়া গেল।
মহা খুশির সাথে সুসংবাদটি নিয়ে গেলেন আবদুল্লাহ তার পিতার কাছে। ছেলের জন্যই তিনি এই যাত্রায় রক্ষা পেলেন। Ñকথাটা মনে করে তিনি ভীষণ খুশি হলেন।
এরপর তিনি কিছুটা দোদুল্যমানতায় ভুগলেও শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করলেন।
হুনাইন যুদ্ধের জন্য কাফেলা প্রস্তুত। এই কাফেলায় আছেন আবদুল্লাহর পিতা সুহাইলও। তিনি তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। কিন্তু কিছু দূর যাবার পরই তিনি ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিলেন।
আবদুল্লাহ ঈমান গ্রহণ থেকে শুরু করে প্রতিটি যুদ্ধেই সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন।
রাসূলের (সা) ইন্তেকালের পরও তিনি যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন বেগবান বাতাসের ঘোড়া।
হিজরি ১২ সন।
এই সময়ে ইয়ামামার প্রান্তরে ভণ্ড নবী মুসাইলামার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে শহীদ হন সত্যের সাহসী সৈনিক আবদুল্লাহ।
পিতা সুহাইল তখনো জীবিত। তিনিও দেখলেন প্রাণপ্রিয় পুত্রের আত্মকুরবানির দৃশ্য! কিন্তু এতটুকু বিচলিত কিংবা কম্পিত নয় তার বুক। কারণ তিনি জানেন শহীদের মর্যাদা।
ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা) মদিনা থেকে মক্কায় এলেন হজের উদ্দেশ্যে। এসেই তিনি সাক্ষাৎ করলেন আবদুল্লাহর পিতা সুহাইলের সাথে। তাকে সান্ত্বনা দিতে গেলেন খলিফা আবু বকর (রা)। কিন্তু মুজাহিদের প্রাণ বলে কথা। আবদুল্লাহর পিতা সুহাইল হযরত আবু বকরকে (রা) বললেন, ‘রাসূল (সা) বলেছেন, একজন শহীদ ব্যক্তি তার পরিবারের সত্তর জনের শাফায়াত বা সুপারিশ করবে। আমার প্রত্যাশা, সেই সময় আমার পুত্র আবদুল্লাহ আমাকে ভুলবে না।’
শহীদ বলে কথা! সৌভাগ্যবান শহীদের পিতারই তো এমনি প্রত্যাশার প্রান্তসীমায় দাবড়িয়ে দিতে পারেন স্বপ্নের সোনালি ঘোড়া। যে ঘোড়া থামতে জানে না কখনো। মানে না কোনো বাধার পর্বত। বরং ক্রমশ এগিয়ে চলে সাহসের সাথে। বৈরী মরুঝড় উড়িয়ে।
সত্যের সেনানীরা তো এমনি হয়!
Mohsin_ahmed_03@yahoo.com
Discussion about this post