রাজধানী ঢাকা থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে সাভারে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে যে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে যেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সরকারের মন্ত্রী ও অন্য গণমান্য ব্যক্তিবর্গের পদধূলি পড়ে, সশস্ত্র বাহিনীগুলোর বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতর্পণ করা হয়, সেই অপূর্ব স্থাপত্যকর্মটির শিল্পীকে এ দেশের কজন মানুষ চেনেন আমরা জানি না। যাঁরা চেনেন, তাঁদেরও কজন তাঁকে মনে রেখেছেন, এই প্রশ্নও মনে উঁকি দেয়। বিশেষত যখন স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিজয় দিবস আসে, যখন সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি উদযাপনের সাড়ম্বর আয়োজন চলে।জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতির নাম সৈয়দ মাইনুল হোসেন। মুন্সিগঞ্জ জেলার দামপাড়া গ্রামে ১৯৫২ সালের ৫ মে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন কলেজশিক্ষক, মাতামহ ছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক পাস করেন ১৯৭৬ সালে। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের গণপূর্ত বিভাগ মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের জন্য একটা জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় এবং নকশা আহ্বান করে। প্রথমবার কোনো নকশা মনোনীত হয়নি। দ্বিতীয়বার জমা পড়েছিল ৫৭টি নকশা, সেগুলোর মধ্য থেকে গৃহীত হয় সৈয়দ মাইনুল হোসেনের করা নকশা।
জাতীয় স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন। ছবিটি ২০০৬ সালের মার্চে তোলা। তাঁর সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল ২০০৬ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে। তখন তাঁর বয়স ছিল ৫৪ বছর, ঢাকার শান্তিনগরে একতলা একটা পরিত্যক্ত বাড়ির একটি ঘরে বাস করতেন সম্পূর্ণ একা।
বিরল প্রতিভার অধিকারী স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনের ওই নিঃসঙ্গবাসের পেছনে ছিল এক জটিল মানসিক ব্যাধি। কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন; বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে, দুটি মেয়েকে নিয়ে তাঁর স্ত্রী বাবার বাড়ি চলে যান। মাইনুলকে দেখাশোনা করতেন তাঁর ছোট ভাই। শান্তিনগরের ওই বাড়িতে তাঁর জন্য খাবার আসত ছোট ভাইয়ের বাসা থেকে। এটুকু ছাড়া আর কারও কোনো মনোযোগ তিনি পাননি। তিনি কোথাও যেতেন না, কেউ তাঁর কাছে যেত না। তাঁর ঘরটির জানালা-দরজা সব সময় বন্ধ থাকত; বিছানায় মশারি ঝুলত দিনরাত ২৪ ঘণ্টা। সেই মশারির ভেতরে তাঁর সঙ্গে বাস করত তাঁরই রক্তভুক অজস্র মশা।
আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর ছেলেবেলার বন্ধু, বুয়েটের সহপাঠী ও রুমমেট বদরুল হায়দার। তিনিও একজন স্থপতি। আমার মনে আছে, নির্জন প্রায়ান্ধকার বাড়িটাকে ভুতুড়ে মনে হচ্ছিল। বন্ধু বদরুলের ডাকে স্থপতি মাইনুল তাঁর ঘরের ভেতর থেকে দরজার কাছে এসে দাঁড়ান। আমি তাঁর ঘরের ভেতরে উঁকি মেরে দেখতে পেয়েছিলাম অন্ধকার। বারান্দায় টিমটিম করে একটা বাল্ব জ্বলছিল। বাড়িজুড়ে একটা টুল, মোড়া বা চেয়ার ছিল না বলে আমরা বারান্দার মেঝেতেই বসে পড়েছিলাম। স্থপতি মাইনুল বসেছিলেন আমাদের সামনে তাঁর ঘরের দরজার চৌকাঠে। আমার সঙ্গে ছিলেন প্রথম আলোর আলোকচিত্রী জাহিদুল করিম। তিনি স্থপতির ছবি তোলার প্রস্তুতি শুরু করতেই বদরুল হায়দার তাঁকে চোখের ইশারায় থামিয়ে দিয়েছিলেন এই শঙ্কায় যে তার ফলে স্থপতি মাইনুল রেগে ঘরের ভেতরে ফিরে যেতে পারেন। তারপর আমাকে আলাপ জমাবার সুযোগ দিয়ে বদরুল হায়দার কিছু সময়ের জন্য বাড়ির বাইরে গিয়েছিলেন।আমি তাঁর সঙ্গে কথা শুরু করার কিছুক্ষণ পরই তাঁর মানসিক অসুস্থতা বুঝতে পারি। আমি যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, তিনি ঘরের বাইরে কেন বের হন না, কেন কারও সঙ্গে কথা বলেন না, তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন, কোনো এক অজানা আড়াল থেকে তাঁকে নিষেধ করা হয়, ভয় দেখানো হয়, হুমকি দেওয়া হয়।
কিন্তু যখন তাঁকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি, জানতে চাই স্তম্ভটির আকার অমন কেন—তখন তিনি স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের মতো কথা বলেন। আমার মনে পড়ছে, স্মৃতিসৌধের কাঠামো সম্পর্কে তিনি আমাকে যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তা ছিল এ রকম: ‘চারদিকে প্রচণ্ড চাপ। সেই চাপে কিছু একটা উঠে যাচ্ছে।’ স্মৃতিসৌধের ৭টা খাঁজ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ৭টা বড় আন্দোলন হয়েছিল। ওই খাঁজগুলো দিয়ে সেই সব আন্দোলন বোঝানো হয়েছে। সবচেয়ে নিচের খাঁজটা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, সবচেয়ে ওপরেরটা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ।
স্থপতি মাইনুল আমাকে বলেন, স্মৃতিসৌধের নকশার সম্মানী বাবদ তাঁর ২ লাখ টাকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আয়কর ধরা হয়েছিল ৫০ শতাংশ, অর্থাৎ এক লাখ টাকা। পরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে তদবির করে তিনি করের হার কমাতে পেরেছিলেন, শেষ পর্যন্ত কর দিয়েছিলেন ২০ হাজার টাকা।
সেই সাক্ষাতের এক দিন পর আমি তাঁকে সাভারে নিয়ে যাই। বহু বছর পর নিজের সৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর নীরবতা ভেঙে গিয়েছিল, নিজে থেকেই অনেক কথা বলেছিলেন। মনে আছে, স্মৃতিসৌধের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন যে ওটার আয়ু কম হবে। কারণ জেনারেল এরশাদের বিশেষ নির্দেশে ওটার নির্মাণকাজ শেষ করা হয়েছিল খুব তাড়াহুড়ো করে। এরশাদ সামরিক শাসন জারি করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন কয়েক মাস আগে। সারা দেশ তাঁর বিরুদ্ধে, বিন্দুমাত্র সমর্থন কোথাও নেই। তাই তিনি চাইছিলেন পরবর্তী ১৬ ডিসেম্বরে জাতীয় স্মৃতিসৌধের নির্মাণকাজ শেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সহানুভূতি-সমর্থন লাভ করতে। তাড়াহুড়োতেই নির্মাণকাজ শেষ করা হয়েছিল এবং সত্যিই ১৯৮২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করেন।
কিন্তু স্বৈরশাসক এরশাদ জাতীয় স্মৃতিসৌধের সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনকে আমন্ত্রণ জানাননি। মাইনুল আমাকে বলেছিলেন, আমন্ত্রণ না পেয়েও তিনি সেদিন সাভার গিয়েছিলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে রাষ্ট্রীয় ভিআইপিরা চলে যাওয়ার পর তিনি জনতার কাতারে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন নিজের করা নকশায় নির্মিত সৌধটি।
আমি ও স্থপতি মাইনুল ২০০৬ সালের মার্চে প্রথম সপ্তাহে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের প্রাঙ্গণে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও এর স্থপতির নাম কোথাও দেখতে পাইনি। আজও সেখানে তাঁর নাম যুক্ত করা হয়েছে কি না, জানি না।
আমাদের সেই সাক্ষাতের পর স্থপতি মাইনুল বেঁচে ছিলেন আর মাত্র আট বছর। ২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।
Discussion about this post