১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা শ্রমের উপযুক্ত মূল্য এবং দৈনিক অনধিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে অনেক শ্রমিক হতাহত হন। তাঁদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় আট ঘণ্টা করার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর থেকে দিনটি ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎস এই দিন। মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আর শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটার স্বপ্ন দেখারও দিন এটি।
মে দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে এবং আন্তর্জাতিকভাবে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ত্যাগের ও মহিমাময় দিন। এ দিনটি সবাই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। পৃথিবীর মেহনতি মানুষের জন্য আজকের দিনটি খুবই তাৎপর্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ দিনটির মাধ্যমে তারা তাদের কাজের প্রকৃত স্বীকৃতি পেয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ দিনটি উজ্জ্বল হয়ে আছে। এ দিনটির ত্যাগ মহিমা ও তাৎপর্য সবচেয়ে বেশি, বিশেষ করে পৃথিবীর শ্রমিকশ্রেণির কাছে। তাই এ দিনটি শ্রমিকের মর্যাদা রক্ষার দিন। তাদের ন্যায্য পাওনা আদায় তথা অধিকার আদায়ের দিন। শ্রমিকদের অস্তিত্ব ঘোষণার দিন।
এ দিনটিকে পাওয়ার জন্য মানুষ নিজের জীবন রক্ষার জন্য, ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবাদ-সংগ্রাম করেছে মালিকদের বিরুদ্ধে। যুগে যুগে দেশে দেশে সমাজে খেটে খাওয়া শ্রমিকশ্রেণি ও মেহনতি মানুষ দেশ-জাতির উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রেখেছে, তাদের জীবন চলে গেছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার হয়নি। যে কোনো দেশের উৎপাদন অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে শ্রমিকরাই বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। আবার তারাই সবচেয়ে বেশি শোষিত-বঞ্চিত হয়েছে। নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বহু জায়গায় তাদের প্রাণ চলে গেছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে।
বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যুগে যুগে সবচেয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়েছে এসব অসহায় গরিব শ্রমিকশ্রেণি। নির্যাতিত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষ তাদের অধিকার রক্ষা ও দাবি আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছে বছরের পর বছর। তারা সংগ্রাম করে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে নিজেদের দাবি আদায় করেছে। যে কোনো পেশাজীবী মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে কোনো রক্তপাত যে বৃথা যায় না, ইতিহাসে তার অনেক প্রমাণ রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই মহান মে দিবস। এরই ধারাবাহিকতায় শ্রমিক শ্রেণি আশার আলো খুঁজে পেয়েছে। তারা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে।
এই মহান মে দিবস হচ্ছে পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের বিজয় নিশান। এই কারণে মে দিবস বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমিকশ্রেণির মানুষ আত্মত্যাগের এক বিরাট ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তাদের সুমহান আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে স্বীকৃতি পেয়েছে শ্রমের মর্যাদা। শ্রমজীবী মানুষের কাছে ‘সিলভিস’ একটি কিংবদন্তি নাম। সিলভিস ছিলেন লোহা ঢালাই শ্রমিকদের তরুণ নেতা। তার নেতৃত্বে ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন সর্বপ্রথম আমেরিকায় দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি করে। মিল মালিকরা তাদের দাবি অগ্রাহ্য করলে মালিকদের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘাত বাঁধে। অনেক শ্রমিক নিহত হলে মিল মালিকরা তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। আর সে থেকেই পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে।
শ্রমের মর্যাদা রক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে রক্ত দিয়েছে পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ। তাই দিনটি শ্রমিকশ্রেণির মানুষের মহান দিন। নিজেদের জীবন দিয়ে তারা তাদের দাবি আদায় করেছে। তবুও প্রভুদের কাছে শোষকদের কাছে তারা মাথানত করেনি। মানুষের দাবি বা অধিকার ক্ষুণ্ন হয়, তখন মানুষ প্রতিবাদে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং রক্ত দিয়ে সে দাবি প্রতিষ্ঠিত করে। বিশ্বে এর অনেক নজির রয়েছে। তবে মহান মে দিবস তার অন্যতম। শ্রমিক আন্দোলনের প্রধান বিষয় ছিল শ্রমঘণ্টা নির্ধারণ। অর্থাৎ শ্রমিকরা তাদের মজুরির বিনিময়ে দৈনিক কতো ঘণ্টা শ্রম দেবে, তা নির্ধারণ ছিল না। শ্রমিকরা দৈনিক যত পরিশ্রম করত, মজুরি দেয়া হতো তার চেয়ে কম। তাই শ্রম নির্ধারণ ও শ্রমের বিনিময়ে যথার্থ মজুরির দাবিই ছিল শ্রমিক আন্দোলনের প্রধান বিষয়। ইতোমধ্যে মে দিবস পেরিয়েছে ১২৬ বছর। এত বছর পরও শ্রমিকরা নানা সমস্যায় জর্জরিত। আজো সমাজে তাদের অধিকার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনো দেশে দেশে শ্রমিক শোষণ চলছে। তাদের দেখা হয় অবহেলার চোখে।
মানবজাতির ইতিহাসে ‘দাসত্ব’ বা ‘দাসপ্রথা’ অন্যতম কলঙ্কিত একটি অধ্যায়। প্রস্তর যুগের পরবর্তী যেকোনো সময়ে মানুষ যখন গোষ্ঠীগতভাবে যেকোনো প্রশাসনিক কাঠামোয় বাস শুরু করেছে তখনই বলবান বা শক্তিশালীদের কাছে কিছু দুর্বল মানুষ ‘দাসত্বের’ শিকার হয়েছে। মিসরীয় সভ্যতার ফেরাউন যুগে, ইসলামপূর্ব আরবীয় এলাকায় বা ভারতীয় ইতিহাসের সুলতানি যুগের হাবসি ক্রীতদাস পর্বে আমরা ক্রীতদাসদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার কথা জানতে পারি। তবে ক্রীতদাসদের নির্মম অধ্যায়ের শুরু সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টাদশ শতকের মাঝ পর্যন্ত (১৭৬০-১৮৬৫ শতক)।
তখন আজকের বিদ্যমান নতুন মানবসভ্যতার শুরু। নতুন পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান চাহিদার জন্য সভ্যতার বিকাশকেন্দ্র ইউরোপ-আমেরিকার জন্য প্রয়োজন ছিল বিশাল কর্মীবাহিনী। আখ, তামাক, তুলা এগুলো সঠিক সময়ে ও প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত ও বিপণনের স্বার্থে প্রয়োজন পড়ে অজস্র শক্তিশালী শ্রমিকের। এ সমস্যার সমাধানে তারা খুঁজে নেয় আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলকে। বছরে ৮০ হাজার মানুষকে ছলনা, প্ররোচনা ও লোভ দেখিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে জাহাজযোগে আমেরিকা-ইউরোপে নিয়ে আসা শুরু হয়। নিয়ে আসা হয় ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলোতে। লোভ-লালসা দেখিয়ে আনা ছাড়াও প্রচুর কালো মানুষকে অপহরণ করেও জাহাজে তোলা হয়। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় পথেই মারা যেত অসংখ্য মানুষ। আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলোতে জমজমাট গড়ে ওঠে লাভজনক দাস কেনাবেচার হাট। জবরদস্তিমূলক খাটানো হয় শস্যক্ষেতে, দুর্গম রেলপথ নির্মাণে আর কয়লাখনিতে। লঙ্ঘিত হয় তাদের সব মানবাধিকার। আমেরিকার উত্তরাঞ্চল দাসমুক্ত ঘোষিত হওয়ায় দক্ষিণ-উত্তরের দ্বন্দ্বে শুরু হয় ভয়ানক গৃহযুদ্ধ। দীর্ঘ আট মাসের ভয়ানক গৃহযুদ্ধের পরিসমাপ্তি হয় ১৮৬৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ক্লেশহীন পরিশ্রমে দাসপ্রথার আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটলেও এ প্রথা নতুন আকারে, নতুন রূপান্তরে রয়ে গেছে পৃথিবীর দেশে দেশে।
দাসত্বের বিষয়টি সম্ভবত মানব ইতিহাসে শুরু থেকেই ছিল। আধুনিক সময়ের পুঁজিবাদ দাসত্বের প্রবর্তন করেনি। কম বেতনে বা বিনা বেতনে বা মানুষকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার দাসত্বপ্রথা এখনো চলছে। এই বিষয়টি নিয়ে পাশ্চাত্যে একটা প্রতিষ্ঠান ‘ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন’ (মুক্ত হয়ে চলার প্রতিষ্ঠান) আন্দোলন শুরু করেছে অধুনা। তারা বেশ জোরেশোরে সমসাময়িক দাসপ্রথার মুখোশ উন্মোচন করে দিতে এগিয়ে এসেছে।
দাসত্ব বলতে বোঝায় কোনো মানুষকে জোর করে শ্রম দিতে বাধ্য করা এবং এক্ষেত্রে কোনো মানুষকে অন্য মানুষের অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা। কাউকে তার ইচ্ছার পরিবর্তে দাস করা যেতে পারে। এটি হতে পারে তার আটক, জন্ম, ক্রয় করা সময় থেকে। দাসদের অনুমতি ব্যতিরেকে স্থান বা মালিককে ত্যাগ করা, কাজ না করার, বা শ্রমের মজুরী পাবার অধিকার নেই। কিছু সমাজে নিজের দাসকে হত্যা করা আইনসঙ্গত ছিল। দাসত্ববিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন অ্যান্টি স্ল্যাভারি ইন্টারন্যাশনাল দাসত্বের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে একে ‘জোরপূর্বক শ্রম দেওয়া’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, বর্তমান বিশ্বে এখনো ২ কোটি ৭০ লক্ষ দাস রয়েছে। এই সংখ্যা ইতিহাসের যে-কোনো সময়কার দাসের সংখ্যার তুলনায় বেশি। এমন কী প্রায় ৪০০ বছরের ইতিহাসে আফ্রিকা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আনা আফ্রিকান দাসের মোট সংখ্যাও এর প্রায় অর্ধেক। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এখনো বিশ্বের ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ জোরপূর্বক শ্রম, দাসত্ব, ও দাসত্ব সংশ্লিষ্ট প্রথার কাছে বন্দী।
প্রাচীনকালে এবং মধ্যযুগে সমাজে মানুষ কেনাবেচার একটি প্রথা ছিল । যা দ্বারা বিভিন্ন মুল্যের বিনিময়ে মানুষ কেনা যেত । এই প্রচলিত প্রথাটিকেই দাস প্রথা বলা হয়ে থাকে। দাস অথবা দাসী বর্তমান বাজারের পণ্যের মতই বিক্রি হত। বর্তমানে যেমন পণ্য বেচাকেনার বাজার আছে অতীতেও দাসদাসী বিক্রি অথবা কেনার আলাদা বাজার ছিল । সভ্যতা বিকাশের ধারায় মানবসমাজে উদ্ভব ঘটে দাসপ্রথার। কালের টানে একসময় বিলোপও হয়ে যায়। কিন্তু সভ্যতার গায়ে ক্ষতচিহ্নের মতো রয়ে গেছে এই অমানবিক প্রথার দাগ।
একটা সময় এই পৃথিবীতে মানুষ বেচা কেনার ব্যবসা চলত। ক্ষমতাসর্ম্পন্ন মানুষরা সেসব মানুষ কিনে দাস করে রাখত। কারণে অকারণে তাদের ওপর চালাত নির্যাতন। মধ্যযুগে পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার মতো ইউরোপেও জমে উঠেছিল এই ব্যবসা।
আফ্রিকান দস্যুরা বিভিন্ন গ্রামে হামলা করে শত শত মানুষকে ধরে নিয়ে এসে বন্দি করে রাখত। আর ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীরা তাদের কিনে এনে ইউরোপের বাজারে বেচত। তাছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকেও তারা দাস কেনা-বেচা করত।
শুধু ইউরোপে নয়, সারাবিশ্বের সমাজপতি, প্রভাবশালী ও দস্যুরা দুর্বলদের ধরে নিয়ে গিয়ে দাস বানাত এবং বিক্রি করত। ১০৬৬ সালের আগে অর্থাৎ রোমানদের সময়ে এবং তারও আগে ইংল্যান্ডে দাস প্রথার প্রচলন ছিল। অ্যাংলো-স্যাঙ্নরা এ প্রথার স্রসারণ করে। কিন্তু ১০৬৬ সালে নরমান্ডি রাজা উইলিয়ামের ইংল্যান্ড বিজয়ের পর ইংরেজ খ্রিষ্টান দাস প্রথা বন্দ হয়ে যায়। তাই বলে দাস প্রথার বিলুপ্তি ঘটেনি। এ বর্বরতা নিয়ে রক্তাক্ত হয়ে আছে ইউরোপের ইতিহাস। সে ইতিহাসের পাতায় পাতায় দাসদের করুণ আর্তনাদ গুমরে গুমরে কাঁদে।
ক্রমওয়েলিয়ানরা আয়ারল্যান্ড দখল করে নেওয়ার পর থেকে লাখ লাখ নারী, পুরুষ এবং শিশুকে জোর করে দাস বানানো হয়। তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ব্রিটিশ ওয়েষ্ট ইন্ডিজ ও ব্রিটিশ নর্থ আমেরিকায়। ১৬৫৯ থেকে ১৬৬৩ সাল পর্যন্ত ক্রমওয়েলিয়ানের সেনাবাহিনী হাজার হাজার আইরিশ ক্যাথলিককে দাস বানায়। কারণ তিনি ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের পছন্দ করতেন না।
১৬৩১ সালের ২০ জুন আয়ারল্যান্ডের কানটি কর্ক এলাকার আত্রক্রমণ চালায় আলজেরিয়ান দস্যুরা। তারা সেদিন দু’জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে শতাধিক লোককে ধরে নিয়ে গিয়ে শিকলবন্দি করে। পরে তাদের দাস হিসেবে প্রেরণ করে উত্তর আফ্রিকায়। গ্রামবাসী রাজার কাছে এ ঘটনা জানালে দশ বছর পর তাদের ফিরিয়ে আনা হয়। ১৫৫৪-৫৫ সালে ‘দ্য পাইওনিয়ার অব ইংলিশ হিসেবে পরিচিত হকিন্স ধনী ব্যবসায়ীদের নিয়ে দাস ব্যবসার একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। তিনটি জাহাজ নিয়ে যাত্রা শুরু করে আফ্রিকার উদ্দেশে। মাঝপথে তারা পর্তুগিজদের একটি জাহাজ ছিনতাই করে ছিনিয়ে নেয় ৩০০ দাস। আর ১৫৬৪ সালে দ্বিতীয় যাত্রায় তারা প্রায় ৪০০ আফিদ্ধকানকে অপহরণ করে বিক্রি করে।
১৮ শতকে এসে দাস প্রথা ত্রিমাত্রিক রূপ নেয়। লিভারপুল শহরের জন্য এটি অনেক লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয় । ১৭ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত ছিল গৃহদাস প্রথাও।
যেসব মানুষ হতদরিদ্র, যাদের বেঁচে থাকার বিক্লপ্প কোনো রাস্থা নেই, তারা অন্যের বাড়িতে দাস হয়ে থাকত। বেওয়ারিশ শিশুদের ধনীরা লালন-পালন করে গৃহস্থলির কাজে ব্যবহার করত।
কোন্টাকিন্টের কথা কেউ ভোলেননি নিশ্চয়ই! ভোলা সম্ভব? ‘রুটসঃ দি সাগা অব অ্যান আমেরিকান ফ্যামিলি’ উপন্যাসে নিজের পূর্বপুরুষের জন্ম ইতিহাস বর্ণনার মধ্য দিয়ে আমেরিকান লেখক অ্যালেক্স হ্যালি দাস প্রথার নির্মমতা, দাসদের করুণ জীবনের কথা তুলে এনেছিলেন আমাদের সামনে। এই উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত তুমুল জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘রুটস’ বিটিভির বদৌলতে এ দেশের মানুষও দেখার সুযোগ পান। সেই সূত্রেই কোন্টাকিন্টের সঙ্গে আমাদের এত পরিচিতি। আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয়তম এই টিভি সিরিয়াল কাঁদিয়েছে এদেশের মানুষকেও।
কোন্টাকিন্টের মতোই আরেক বিখ্যাত চরিত্র আংকল টম। আমেরিকান লেখিকা হ্যারিয়েট বিচার স্টো তার উপন্যাস ‘আংকল টম’স কেবিন’-এর কেন্দ্রীয় এই চরিত্রের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত মর্মস্পর্শীভাবে দাস জীবনের করুণ কাহিনী তুলে ধরেছেন। কালো মানুষদের ওপরে সাদা মানুষদের নির্মম, অমানবিক অত্যাচারের কাহিনী এসব। আমরা জানতে পারি, কী অসহনীয় জীবন শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা পার করেছেন।
এসব দাসের ছিল না কোনো স্বাধীনতা। প্রভুর ইচ্ছার বাইরে গিয়ে বিয়েও করতে পারত না তারা। নিদারুণ পরাধীনতার মধ্যে থেকেও এ দাসরা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে অত্যন্ত উঁচু মানের তুলা উত্পাদন করত। দাস প্রভুরাও তুলা চাষের জন্য ফ্রি লেবারের পরিবর্তে ক্যাপটিভ লেবারই পছন্দ করত। দাস প্রথাকে তারা জিইয়ে রাখতে চেয়েছিল নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে। তাদের ধারণা ছিল, দাস শ্রমিকদের কাছ থেকে শ্রমশক্তির পুরোটাই নিংড়ে নেয়া সম্ভব।
দাস প্রথাকে মানব ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসাবে বলা হয়। তবে এখন দাস প্রথাকে যত অদ্ভুতই মনে হোক না কেন, এক সময় এটিই ছিল স্বাভাবিক। বিত্তশালীদের আভিজাত্যের প্রতীক ছিল দাস। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর ঘরেও দাস থাকতো। অবশ্য এখন সবাই দাস প্রথাকে অমানবিক মনে করেন। এই দাস প্রথাকে উচ্ছেদ করতে গিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিল। সে যুদ্ধে আব্রাহাম লিংকন জিতেছিলেন এবং দাস প্রথার বিলোপ ঘটাতে পেরেছিলেন।
আধুনিক সমাজে দাস প্রথা রদ করা হয়েছে। তবে আধুনিক সমাজে আজ পর্যন্ত সত্যিই কী দাস প্রথার বিলোপ ঘটেছে? সমাজবিদরা বলছেন, দাসপ্রথার রূপান্তর ঘটেছে কিন্তু তা সমাজে আজও বিদ্যমান। এই দাসের বেশির ভাগই ঋণ শোধের জন্য দাসে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বৃহত্ জনগোষ্ঠী মহাজনদের কাছ থেকে অর্থ ধার নিয়ে পরবর্তী সময়ে অর্থ শোধ দিতে না পারায় দাসে পরিণত হয়েছে। এদের মধ্যে কিছু আছে যারা কয়েক প্রজন্মের জন্য দাস। তবে পৃথিবীতে বর্তমানে মানুষ পরিবহন মূলত হয়ে থাকে নারী ও শিশুদের যৌন ব্যবসায় খাটানোর জন্য। এটিকে বর্ণনা করা হয় ইতিহাসের সর্ববৃহত্ দাস বাণিজ্য’ হিসেবে। অবৈধ মাদকদ্রব্য পরিবহনে ব্যবহার করার কারণে একই সাথে এটি বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অপরাধ ক্ষেত্র।
মানুষের সুবিধাবাদী চরিত্রের কারণে দাসপ্রথা সমাজ থেকে নির্মূল হয়নি। হবেই এটা জোর দিয়ে বলাও যাচ্ছে না। যদি সরকার মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে। তাহলে দাসপ্রথা কমে আসার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে দাস রয়েছে। আমরা যাদের কাজের লোক বলি। তারা আমরা ঘুম থেকে ওঠার আগে বিছানা থেকে ওঠে, শুতে যায় আমরা শুতে যাওয়ার পরে। তাদেও কোন কর্ম ঘণ্টা নেই, নেই নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো। ছুটি নেই। অনেক বাড়িতে তাদেও ভালোমত খাবার দেয়া হয় না। অনেকে নিজেদের জন্য ভালোটা আর কাজের মানুষদেও জন্য কমদামের চাল বরাদ্দ করেন। ্সেব কিছুই তো প্রকারান্তরে দাসপ্রথার কথাই মনে করিয়ে দেয়। আমরা কথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণী এ নিয়ে কোন প্রতিবাদ করি না। কারণ তাহলে আমরা সুবিধাবঞ্চিত হবো। তাই এই প্রথা বজায় থাকছে। তাই বলাই যায় দাস প্রথা সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়নি।
ইতিহাস, দাসপ্রথা
কলোনিয়াল দাসপ্রথা শুরু হয় পর্তুগীজ জলদস্যুদের মাধ্যমে, আফ্রিকা থকে দস্যুরা কালোদের ধরে নিয়ে ইউরোপে বিক্রি করত। পরে ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয়রাও এই ব্যবসায় জড়িত হয়। এমন হত যে, হাজার খানেক ক্রীতদাস নিয়ে নৌজাহাজ রওনা দিয়ে ৫০০-এর কম দাস আমেরিকা গিয়ে পৌছাত। জাহাজে ক্রীতদীসদের কাত হয়ে শুতে হত, চিত হয়ে শোয়ার জায়গা ছিল না. নিউ ওয়ার্ল্ড বা আমেরিকা গড়ে ওঠে কালোদের মর্মান্তিক শ্রমে. তারা তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। দাস ছিল মুনিবের সম্পত্তি, বিনা পারিশ্রমিকে সে দাসকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারতো। সে সময় অনেকেই ঋণের দায় থেকে বাঁচতে দাসত্বকে বরণ করে নিতে বাধ্য হত। দাসের সন্তানও দাস বলে গণ্য হত। যুদ্ধে পরাজিত হয়েও অনেকসময় দাসত্ব বরণ করতে হত। অমানবিকভাবে সারা জীবনখেটে মরতে হত তাদের। এ চক্র থেকে বের হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না, যদি না তাদের মুনিব তাদের মুক্তি দেয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী শাসিত বাংলাসহ সারা বিশ্বেই দাস কেনা বেচার জন্য বাজার গড়ে উঠেছিল। এ বাজারে আফ্রিকার নিগ্রোদের চাহিদাই বেশি ছিল। তাদেও জোর করে ধরে আনা হত। আর বিক্রি করা হত ইউরোপের বাজারে।
দাস প্রথার উত্পত্তিকাল
আজ হতে প্রায় পৌনে ৪০০০ বছর আগের ব্যবলনিয় Code of Hammurabi-তেও দাসপ্রথার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। দাসত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা প্রথম সমাজ হলো গ্রিক সভ্যতার সমাজব্যবস্থা। গ্রিক সভ্যতার সূচনা যিশুর জন্মের আনুমানিক দুহাজার বছর আগে মাইনোয়ান যুগে। হোমারের দুই মহাকাব্য ইলিয়াড এবং ওডিসির রচনাকাল আনুমানিক ৭৫০-৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই দুই মহাকাব্যে দাসত্ব এবং দাসপ্রথার টুকরো কিছু ছবি পাওয়া যায়। কৃষি এবং শিল্প খাতে শ্রমের চাহিদা মেটানো হতো দাসদের দ্বারা। গ্রিকদের শিল্প যখন সমুদ্র পার হয়ে রফতানি শুরু হয় তখন দাসদের প্রয়োজনীয়তাও বৃদ্ধি পায়। দাস বেচাকেনার জন্য ব্যবসা শুরু হয়। এথেন্সের দাস ব্যবসায়ীরা এশিয়া মাইনর, সিরিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে দাস আমদানি করত। ফিনিসীয় দাস ব্যবসায়ীরা নিজেরাই এথেন্সের বাজারে দাস নিয়ে আসত। সিরিয়া, মিসর, আরব প্রভৃতি দেশের সঙ্গেও এথেন্স এবং অন্য গ্রিক রাষ্ট্রের দাস ব্যবসা শুরু হয়। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে এথেন্সের অর্থনীতি পুরোপুরিই দাসশ্রমনির্ভর হয়ে পড়ে। প্রাচীন রোম সভ্যতাতেও ছিল দাসপ্রথার প্রচলন। রোমান সাম্রাজ্যের বিজিত প্রদেশগুলো থেকে রোমে দাস সরবরাহ করতে হতো।
দাসপ্রথা ও ইসলাম
দাসপ্রথা ইসলাম প্রবর্তিত কোন ব্যবস্থা নয়। কিন্তু কেন যেন ইসলামের সমালোচনায় দাসপ্রথা একটি বেশ মুখরোচক বিষয়বস্তুতে পরিণয় হয়, আর আলোচনার ভঙ্গিটাও এমন থাকে যাতে পাঠকের কাছে মনে হতে থাকবে দাসপ্রথার মত ঘৃণ্য একটি ব্যবস্থাকে ইসলাম জন্ম দিয়েছে বা উন্নীত করেছে। অথচ আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ইসলাম দাসপ্রথার মতো একটি বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নিয়েছিল, ক্রীতদাসকে ভাতৃত্বের যে মর্যাদা দিয়েছিল, নেতৃত্বের যে সুযোগ দিয়েছিল, যে কোন নিরপেক্ষ বিশ্লেষক তার প্রশংসা না করে পারবে না।
দুই.
কুরআন এবং হাদিসে দাস-দাসি ও দাসপ্রথার অবস্থান
মূল আলোচনায় যাবার আগে আসুন কুরআনের কিছু আয়াত এবং কিছু হাদিস থেকে দাস-দাসি ও দাসপ্রথার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝবার চেষ্টা করি।
কুরআনের কিছু আয়াত:
আয়াত-১: দাসমুক্তকরণ ধর্মের ঘাঁটি
অতঃপর সে ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি। আপনি জানেন, সে ঘাঁটি কি? তা হচ্ছে দাসমুক্তি অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে অন্নদান- এতীম আত্মীয়কে অথবা ধুলি-ধুসরিত মিসকীনকে, অতঃপর তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, যারা ঈমান আনে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় সবরের ও উপদেশ দেয় দয়ার। [৯০:১১-১৭]
আয়াত-২: মুক্তিকামি ক্রীতদাসের জন্য সম্পদ ব্যয় করা বড় সৎকাজ
সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। [২:১৭৭, প্রাসঙ্গিক অংশ]
আয়াত-৩: নিজেদের সমান হয়ে যাবার ভয়ে দাস-দাসীদের দান না করা আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করার নামান্তর
আল্লাহ তা’আলা জীবনোপকরণে তোমাদের একজনকে অন্যজনের চাইতে শ্রেষ্টত্ব দিয়েছেন। অতএব যাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে, তারা তাদের অধীনস্থ দাস-দাসীদেরকে স্বীয় জীবিকা থেকে এমন কিছু দেয় না, যাতে তারা এ বিষয়ে তাদের সমান হয়ে যাবে। তবে কি তারা আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করে। [১৬:৭১]
আয়াত-৪: নিঃস্ব হলেও সৎকর্মপরায়ণ দাস-দাসীদের বিবাহ দিয়ে দিতে হবে
তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। [২৪:৩২]
দাসদাসি ও দাসপ্রথা সম্পর্কিত কিছু হাদিস:
হাদিস-১: স্বাধীন ব্যক্তিকে কেনাবেচা নিষিদ্ধকরণ
আবু হুরাইরা(রা.) হতে বর্ণিত:
নবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ[তায়ালা] বলেন:
আমি কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরূদ্ধে হবো,
[১] যে আমার নামে শপথ করে অত:পর বিশ্বাসঘাতকতা করে,
[২] যে কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে (ক্রীতদাস হিসেবে) বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করে,
[৩] যে কোন মজুরকে নিযুক্ত করে তার থেকে পরিপূর্ণ কাজ গ্রহণ করে অথচ তার পারশ্রমিক প্রদান করে না।
[সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২২২৭; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৩, বুক ৩৪, নম্বর ৪৩০;
হাদিস-২: দাস-দাসির অধিকার
আল-মা’রুর বিন সুওয়াইদ(রা.) হতে বর্ণিত:
[রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] বললেন:
তোমাদের দাসেরা তোমারদের ভাই যাদের ওপর আল্লাহ তোমাদের ক্ষমতা দিয়েছেন। কাজেই কারো নিয়ন্ত্রণে যদি তার ভাই থাকে, তবে সে যা খাবে তাকেও তাই খাওয়াবে, সে যা পরবে তাকেও তাই পরাবে। তাদের ওপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপাবে না যা তারা বহন করতে অক্ষম। যদি তা করো, তবে তাদেরকে সাহায্য কর।
[সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২৫৪৫ (প্রাসঙ্গিক অংশ); ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৭২১;
হাদিস-৩: দাস-দাসিকে সম্মানজনকভাবে সম্বোধন করা
আবু হুরাইরা(রা.) হতে বর্ণিত:
নবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “তোমাদের কেউ যেন [এভাবে সম্বোধন করে] না বলে, ‘তোমার প্রভুকে খাওয়াও’, ‘তোমার প্র্রভুকে অযু করাও’, ‘তোমার প্রভুকে পান করাও’; বরং বলবে, ‘আমার মুনিব (সাইয়্যিদ)’ বা ‘আমার অভিভাবক (মাওলা)’। আর তোমাদের কেউ যেন না বলে ‘আমার দাস/বান্দা (আবদ)’ বা ‘আমার দাসী/বান্দী (আমাত)’; বরং বলবে ‘আমার বালিকা (ফাতাত)’ এবং ‘আমর বালক (গুলাম)’।
[সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২৫৫২; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৭২৮;
হাদিস-৪: দাস-দাসির ন্যায়বিচার লাভের অধিকার
সামুরাহ(রা.) হতে বর্ণিত:
রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যদি কেউ তার ক্রীতদাসকে হত্যা করে আমরা তাঁকে হত্যা করবো, আর কেউ যদি তার ক্রীতদাসের নাক কেটে দেয়, আমরাও তার নাক কেটে দেবো।
[সুনান আবু দাউদ, হাদিস নম্বর ৪৫১৫; ইংরেজি অনুবাদ: বুক ৩৯, নম্বর ৪৫০১;
হাদিস-৫: দাস-দাসির ওপর অপবাদ আরোপের পরিণাম
আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত:
আমি আবুল ক্বসিম(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে বলতে শুনেছি, কেউ যদি তার ক্রীতদাসকে অপবাদ দেয় আর সেই ক্রীতদাস যদি সে যা বলছে তা হতে মুক্ত হয়, তবে তাকে (অপবাদ আরোপকারিকে) কিয়ামতের দিনে বেত্রাঘাত করা হতে থাকবে যতক্ষণ না সেই ক্রীতদাস তাই হয় যা সে বর্ণনা করেছে।
[সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৬৯৪৩, ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৮, বুক ৮২, নম্বর ৮৪১;
হাদিস-৬: দাস/দাসিকে চপেটাঘাত করার শাস্তি
মুআবিয়া বিন সুওয়াইদ হতে বর্ণিত:
আমি আমাদের এক ক্রীতদাসকে চপেটাঘাত করি, অত:পর পলায়ন করি। আমি ঠিক মধ্যাহ্নের আগে ফিরে এলাম এবং আমার পিতার পেছনে সালাত আদায় করলাম। তিনি তাকে (ঐ ক্রীতদাসকে) এবং আমাকে ডাকলেন এবং বললেন: সে তোমার প্রতি যা করেছে, তুমিও তেমন করো. সে [ক্রীতদাস] আমাকে মাফ করে দিল। তখন তিনি (আমার পিতা) বললেন, রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জীবদ্দশায় আমরা মুকাররিনের পরিবারভুক্ত ছিলাম এবং আমাদের একজন মাত্র ক্রীতদাসি ছিল। আমাদের একজন তাকে চড় মারলো। এই খবর রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে পৌঁছল এবং তিনি বললেন: তাকে মুক্ত করে দাও। তারা (পরিবারের লোকজন) বললেন: সে ছাড়া আমাদের আর কোন সাহায্যকারি নেই। কাজেই তিনি বললেন: তাহলে তাকে কাজে নিযুক্ত করো, আর যখনই তোমরা তাকে কাজ হতে অব্যাহতি দিতে সমর্থ হও, তাকে মুক্ত করে দাও।
[সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ৪৩৯১; ইংরেজি অনুবাদ: বুক ১৫, নম্বর ৪০৮১;
হাদিস-৭: দাসিকে বিবাহে উৎসাহ প্রদান
আবু মুসা(রা.) হতে বর্ণিত:
রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
যার একটি ক্রীসদাসি আছে আর সে তাকে শিক্ষাদীক্ষা দান করে, তার সাথে সদয় ব্যবহার করে, অত:পর তাকে মুক্ত করে বিবাহ করে সে দ্বিগুণ সওয়াব পাবে। [সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২৫৮৪; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি. ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৭২০;
তিন.
দাসত্বের পথ এবং ইসলাম
সর্বশেষ আসমানী কিতাব কুরআন যখন নাযিল হচ্ছিল তখন শুধু আরবে নয় বরং সারা দুনিয়ায় ক্রীতদাসপ্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল। স্বাধীন মানুষ দাসত্ব বরণ করত প্রধানত দুটি উপায়ে:
১. স্বাধীন ব্যক্তিকে বেচাকেনার মাধ্যমে ক্রীতদাস বানানো: এই পথটি ইসলামে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইসলামে কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে কেনাবেচা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-১]
২. যুদ্ধবন্দীদের ক্রীতদাস বানানো:
যুদ্ধবন্দীদের ক্রীতদাস বানানো সেই সময় একটি স্বাভাবিক রীতি ছিল। কোন মুসলিম যদি যুদ্ধে অমুসলিমদের হাতে বন্দী হতো তাকেও এই পরিণতি বরণ করতে হতো। ইসলামে যুদ্ধবন্দীদের ক্রীতদাস বানানো কোন জরুরী বিষয় নয়। ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ নিয়ে মুক্ত করতে পারে, বিনা মুক্তিপণেও মুক্ত করতে পারে, যুদ্ধবন্দি বিনিময় করতে পারে বা প্রয়োজনবোধে অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহের রীতি অনুসারে দাস-দাসীও বানাতে পারে। তবে কোন রাষ্ট্রের সাথে মুসলিমদের যদি এমন কোন চুক্তি থাকে যে তারা তাদের যুদ্ধবন্দীদের দাস বানাতে পারবে না, তবে সেই চুক্তি রক্ষা করা মুসলিমদের জন্য জরুরি।
২.১ কেন ইসলামে এই সুযোগ রহিত করা হলো না?
ইসলাম একটি বাস্তব ধর্ম। ইসলাম এমন কোন ধর্ম না যে কেউ এক গালে চড় মারলে আরেকটা গাল পেতে দিতে বলবে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নিজ অনুসারিদের বিপদ বা অস্তিত্ব সংকটের মুখে ফেলে দেবার ধর্ম ইসলাম নয়। যেখানে মুসলিমরা অমুসলিমদের হাতে যুদ্ধবন্দী হলে তাদেরকেও দাসত্ব বরণ করতে হতো, সেখানে ইসলাম যদি একই সুযোগ না রাখতো তবে তা হতো শত্রুর হাতে এক বিরাট মারণাস্ত্র তুলে দেওয়ার নামান্তর। কাজেই যতদিন মুসলিমদের জন্য এই নিশ্চয়তা না আসে যে তাদের যুদ্ধবন্দীদের দাসদাসী বানানো হবে না, ততদিন পর্যন্ত মুসলিমদের জন্যও এই সুযোগ রহিত করার কোন যুক্তি থাকতে পারে না।
২.২ দাসত্বের এই পথ বন্ধ করার উপায়
ইসলামে দাসত্ব বরণের এই পথটি যদিও খোলা রয়েছে তবে একটি বন্ধযোগ্য পথ, যা বন্ধ করার চাবি অমুসলিম রাষ্টসমূহের হাতেই দেওয়া আছে। যে কোন অমুসলিম রাষ্ট্র মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে এই ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যে ‘আমরা একে অপরের যুদ্ধবন্দীদের দাস-দাসী বানাবো না’, দাসত্বে প্রবেশের এই উন্মুক্ত পথটি বন্ধ করে দিতে পারে।
চার.
ইসলামে দাসমুক্তির পথসমূহ
১. যাকাত: ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ যাকাত। আর এই যাকাতের একটা খাত নির্ধারণ করা হয়েছে দাসমুক্তির জন্য। [দ্রষ্টব্য ৯:৬০]
২. কাফফারা: বিভিন্ন গুনাহ বা ভুলের কাফফারা নির্ধারণ করা হয়েছে দাস মুক্তকরণকে। [দ্রষ্টব্য ৫:৮৯, ৫৮:৩, ৪:৯২]
৩. লিখিত চুক্তি: ইসলাম দাস-দাসিদের তার মালিকের সাথে মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তির অনুমতি প্রদান করেছে।
তোমাদের অধিকারভুক্তদের মধ্যে যারা মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তি করতে চায়, তাদের সাথে তোমরা লিখিত চুক্তি কর যদি জান যে, তাদের মধ্যে কল্যাণ আছে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে অর্থ-কড়ি দিয়েছেন, তা থেকে তাদেরকে দান কর। [২৪:৩৩, প্রাসঙ্গিক অংশ]
৪. ক্ষতিপূরণ: কোন দাস/দাসিকে চপেটাঘাত করা হলে তার শাস্তি হিসেবে উক্ত দাস/দাসিকে মুক্ত করে দিতে হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৬]
৫. দাসমুক্তকরণে উৎসাহ প্রদান:
৫.১ দাসমুক্তিকে একটি বিরাট সওয়াবের কাজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। [দ্রষ্টব্য: আয়াত-২]
৫.২ বিভিন্ন প্রাকৃতিক নির্দশনের সময় দাসমুক্তির নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, যেমন; চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ কালে। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, ইংরেজি অনুবাদ: ভলি.২, বুক ১৮, নম্বর ১৬৩; ভলি.৩, বুক ৪৬, নম্বর ৬৯৫; ভলি.৩, বুক ৪৬, নম্বর ৬৯৬]
৫.৩ মুক্তিকামি দাসদাসীদের অর্থকড়ি প্রদান করে সাহায্য করতে বলা হয়েছে। [দ্রষ্টব্য ২৪:৩৩]
৫.৪ মালিকের অধিক পছন্দনীয় এবং অধিক দামী দাস-দাসীর মুক্তিপ্রাপ্তির সম্ভাবনা স্বাভাবিকভাবে কম থাকে। তাই ঘোষণা করা হয়েছে যে, সর্বোত্তম দাসমুক্তি হচ্ছে সবচেয়ে দামী এবং মালিকের অধিক পছন্দনীয় দাসকে মুক্ত করা। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৬৯৪]
৫.৫ দাস-দাসি নিজের সমান হয়ে যাবে এমন আশঙ্কায় যারা তাদের দান করা থেকে বিরত থাকে তাদের তিরস্কার করা হয়েছে। [দ্রষ্টব্য ১৬:৭১]
৫.৬ কোন ক্রীতদাস যদি একাধিক মালিকের আয়ত্বাধীনে থাকে এবং কোন একজন মালিক তার অংশ হতে ঐ দাসকে মুক্ত করে দেয় তবে উক্ত মালিকের জন্য ঐ ক্রীতদাসকে অপর অংশীদারদের হতেও মুক্ত করে দেওয়াকে জরুরী করে দেওয়া হয়েছে। মালিক তাতে অসমর্থ হলে, উক্ত ক্রীতদাসকে মুক্তি লাভের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করার নিমিত্তে কাজ করার অনুমতি দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, ইংরেজি অনুবাদ ভলি. ৩, বুক ৪৪, নম্বর ৬৭২]
৫.৭ দাসিকে শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে মুক্ত করে বিবাহকারীকে দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী বলা হয়েছে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৭]
পাঁচ.
ইসলামে দাস/দাসী’র অধিকার ও মর্যাদা
১. ভ্রাতৃত্বের মর্যাদা:
ইসলাম দাসদের ভাইয়ের মর্যাদায় উন্নীত করেছে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-২]
২. নেতৃত্বের অধিকার:
ইসলামে দাসও আমীর হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে তাকে মান্য করা সকলের জন্য জরুরি। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৭২২৯; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৯, বুক ৮৯, নম্বর ২৫৬;
৩. অন্ন-বস্ত্রের সমানাধিকার:
৩.১ মুনিব যা খাবে দাসকেও তাই খাওয়াতে হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-২]
৩.২ মুনিব যা পরবে দাসকেও তা-ই পরাতে হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-২]
৪. কাজ-কর্মে সহানুভূতি লাভের অধিকার:
৪.১ দাসের ওপর তার সামর্থ্যের অতিরিক্ত কোন কাজের বোঝা চাপানো যাবে না। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-২]
৪.২. দাসের ওপর অতিরিক্ত কোন কাজের বোঝা দিতে হলে নিজেকেও তাতে সাহায্য করতে হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-২]
৫. সম্মান লাভের অধিকার:
৫.১ দাস-দাসীদের ‘আমার বান্দা/দাস’ ‘আমার বান্দি/দাসী’ বলা যাবে না, বলতে হবে ‘আমার বালক’, ‘আমার বালিকা’। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৩]
৫.২ দাস-দাসীদের চপেটাঘাত পর্যন্ত করা যাবে না। তাদেরকে চপেটাঘাত করা হলে এর শাস্তিস্বরূপ তাদেরকে মুক্ত করে দিতে হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৬]
৫.৩ দাস-দাসীদের ওপর কোন অপবাদ আরোপ করা যাবে না। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৫]
৬. ধর্মীয় মর্যাদা:
ইসলামে একজন দাসের ধর্মীয় মর্যাদা একজন স্বাধীন মুসলিমের চেয়ে কোন অংশে কম নয় বরং বেশি। কেননা, যদি কোন দাস তার মালিকের প্রতি সৎ এবং বিশ্বস্ত থাকে এবং তার প্রভুর (আল্লাহর) ইবাদতও যথাযথভাবে করে তবে সে দ্বিগুণ সওয়াব পাবে। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, ইংরেজি অনুবাদ ভলি ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৭২২]
৭. ন্যায়বিচার লাভের অধিকার:
ইসলাম ক্রীতদাসের ন্যায়বিচার লাভের অধিকারকে নিশ্চিত করে। বিশ্বে যেখানে দাসদের ওপর চলছিল ইচ্ছামত অত্যাচার, নিপীড়ণ; দাসদের হত্যা করাও যখন ছিল আইনসিদ্ধ, সেই সময় ইসলাম ঘোষণা করে কঠোরতম সতর্কবাণী, কেউ কোন ক্রীতদাসকে হত্যা করলে তাকেও হত্যা করা হবে, কেউ কোন ক্রীতদাসের অঙ্গহানি ঘটালে তারও অঙ্গহানি ঘটানো হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৪]
৮. জৈবিক চাহিদা পূরণের অধিকার:
ইসলাম দাস-দাসীদের জৈবিক চাহিদা পূরণের অধিকার নিশ্চিত করেছে এবং নিজের দাস-দাসীদের বিবাহ দিয়ে দেওয়াকে মুনিবের জন্য দায়িত্ব হিসেবে নির্ধারণ করেছে। [দ্রষ্টব্য ২৪:৩২]
৯. পবিত্র জীবন যাপনের অধিকার:
ইসলামে দাসীদের পতিতাবৃত্তিতে নিযুক্ত করা কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
তোমাদের দাসীরা নিজেদের পবিত্রতা রক্ষা করতে চাইলে তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদের লালসায় তাদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য কারো না। [২৪:৩৩, প্রাসঙ্গিক অংশ]
১০. বিবাহের ক্ষেত্রে মতামত প্রদানের অধিকার:
কোন মুনিব তার ক্রীতদাসির সাথে আলোচনা না করে তাকে কারো সাথে বিবাহ দিতে পারবে না। [দ্রষ্টব্য: বুখারি, হাদিস নম্বর ৭০৫৬; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৯, বুক ৮৬, নম্বর ১০০;
১১. ক্রীতদাসি এবং তার শিশুর একত্রিত থাকার অধিকার:
কোন ক্রীতদাসীকে ভিন্ন কোথাও বিক্রি করে তার থেকে তার শিশুকে বিচ্ছিন্ন করার কোন অনুমতি ইসলামে নেই, এবং এই ধরণের বেচাকেনা নিষিদ্ধ। [দ্রষ্টব্য: সুনান আবু দাউদ, ইংরেজি অনুবাদ: বুক ১৪, নম্বর ২৬৯০]
ছয়.
শেষের কথা
এতক্ষণ তো দেখলেন প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ইসলামে দাস/দাসীদের অবস্থান কোথায় ছিল। এবার মাত্র কয়েক শতক আগে পাশ্চাত্যের Slave code-এ দাস/দাসীদের আইনসিদ্ধ অবস্থান কোথায় ছিল তার একটু নমুনা দেখা যাক:
Virginia, 1705 – “If any slave resists his master…correcting such a slave, and shall happen to be killed in such correction…the master shall be free of all punishment…as if such accident never happened.”
Alabama, 1833, section 31 – “Any person or persons who attempt to teach any free person of color, or slave, to spell, read, or write, shall, upon conviction thereof by indictment, be fined in a sum not less than two hundred and fifty dollars, nor more than five hundred dollars.”
Alabama, 1833, section 32 – “Any free person of color who shall write for any slave a pass or free paper, on conviction thereof, shall receive for every such offense, thirty-nine lashes on the bare back, and leave the state of Alabama within thirty days thereafter…”
Alabama, 1833, section 33 – “Any slave who shall write for any other slave, any pass or free-paper, upon conviction, shall receive, on his or her back, one hundred lashes for the first offence, and seven hundred lashes for every offence thereafter…”
South Carolina, 1712–No slave shall be allowed to work for pay, or to plant corn, peas or rice; or to keep hogs, cattle, or horses; or to own or operate a boat; to buy or sell; or to wear clothes finer than ‘Negro cloth’
সুতরাং ইসলাম প্রথম থেকেই একদিকে যেমন দাসপ্রথাকে নিরুৎসাহিত করেছে, অপরদিকে তেমনি দাস মুক্তিকে ধর্মীয়ভাবে উৎসাহিত কোরে প্রকৃত অর্থে ধীরে ধীরে ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্তির পক্ষেই দিকনির্দেশনা দিয়েছে।
তবে ইসলামের পক্ষে যুদ্ধ অর্থাৎ ‘জিহাদ/ কিতাল’ সংঘটিত হলে বর্তমান ও ভবিষ্যতে সব সময়ই যুদ্ধবন্দী হতে পারে। সাধারণত অমুসলিমরাই যুদ্ধবন্দী হয়। এই অমুসলিম যুদ্ধবন্দীনিদেরকে কিন্তু পবিত্র কোরআনে একটি বারও “দাস-দাসী” হিসেবে উল্লেখ করা হয় নাই। বরং তাদেরকে “মা-মালাকাত-আইমানুকুম” অর্থাৎ “ডান হাতের অধিকারভূক্ত” হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। যুদ্ধবন্দী হলেও তারাও মানুষ। কিন্তু তারপরও একটি পর্যায় পর্যন্ত স্বাধীন ব্যক্তির সাথে যুদ্ধবন্দীদের কিছুটা পার্থক্য থাকেই যায়। তাই বন্দী হলেও তাদের সাথে যেন অমানবিক আচরণ করা না হয়, বরং তাদের অধীকার সংরক্ষণ এবং তাদের সাথে কিরূপ আচরণ করতে হবে সেই দিকনির্দেশনাই দেয়া হয়েছে।
অর্থাৎ দাসদের পড়া-লেখা শেখার, মজুরি খাটার, কিছু উৎপাদন করার, গবাদি পশু রাখার, নৌকা রাখা/চালানোর, কেনা-বেচা করার, ভালো কাপড় পরিধান করার অধিকারই শুধু হরণ করা হয় নাই, মালিককে এতটুকু অধিকারও দেওয়া হয়েছিল যে যদি ক্রীতদাসকে সংশোধন করতে গিয়ে সে তাকে মেরেও ফেলে, তবু তার কোন শাস্তি হবে না, যেন এমন কোন ঘটনাই ঘটে নাই!
এরপরও যদি কেউ দাসপ্রথার কথা এলেই ইসলামের দিকে আঙুল উঁচু করতে চান, তবে বলতেই হবে, যারা চোখ বন্ধ করে ঘুমান তাদের জাগাবার সাধ্য কারো নেই।
আল- কোরআনে যেহেতু দাসপ্রথা বিলুপ্তির লক্ষ্যে দাস মুক্তির কথা বলা হয়েছে, তাই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় নুতন কোরে দাসপ্রথা চালু করার কোনই অবকাশ নেই। এ পৃথিবীর কোন প্রান্তে কখনো যদি কোন মানবগোষ্ঠী দ্বারা পুনরায় দাসপ্রথা চালু করা হয়, তাহলে এর বিরোধীতা করার সাথে সাথে সেখান থেকে প্রথমত দাস-দাসীদের ক্রয় কোরে হলেও তাদেরকে মুক্ত করা শুরু করতে হবে এবং একইসাথে দাসপ্রথা বন্ধের জন্য সেই জনগোষ্ঠীর শাসকশ্রেণী বা কর্তাব্যক্তিদের বোঝাতে হবে। তারা রাজি না হলে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা মুসলমানদের ইমানী দায়িত্ব বলে আমি বিশ্বাস করি। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করে হলেও সেই অত্যাচারীদের হাত থেকে অসহায় দাস-দাসীদের মুক্ত করতে হবে
আল-কোরআনে ইসলাম পূর্ব অধিকারভুক্ত ক্রীতদাসী এবং যুদ্ধবন্দী নারীদেরকে مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ/ ma malakat aymanuhkum/ মা- মালাকাত আইমানুকুম অর্থাৎ ‘ডান হাতের অধিকারভুক্ত’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। জাহেলি যুগে দাসপ্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল। তাই ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম পূর্ব অধিকারভুক্ত দাসীদের সাথে শুধুমাত্র তাদের মালিকদের যৌন সম্পর্কের বিষয়টি সরাসরি নিষিদ্ধ করার ব্যপারে আল-কোরআনে হঠাৎ করে কোন বিধান দেয়া হয় নাই। কারণ হঠাৎ করে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে তা তৎকালিন সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি প্রেক্ষাপটে মোটেই যুক্তিযুক্ত হত না। বরং দাসমুক্তির নামে কোনরূপ হটকারী সিদ্ধান্ত দেয়া হলে এবং হঠাৎ করে বিপুল সংখ্যক দাস-দাসীকে রাস্তায় বের করে দিলে নব্য ও উদিয়মান রাষ্ট্রের মাঝে ব্যপক বিপর্যয় ঘটে যাওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক ছিলনা। এরূপ হটকারী সিদ্ধান্তের ফলে যে সমাজে নানামুখি সমস্যার সৃষ্টি হয়েিছিল এবং দাসমুক্তির নামে হঠাৎ করে বিপুল সংখ্যক নারীকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়ায় তারা যে পতিতা বৃত্তিতে বাধ্য হয়েছিল, পৃথিবীর ইতিহাসের পাতা ঘাটলে সেই প্রমাণই মেলে। তাই ইসলামে দাসপ্রথাকে নিরুৎসাহিত করার মাধ্যমে তখনকার দাসপ্রথায় অভ্যস্ত সমাজ থেকে ধীরে ধীরে তা বিলুপ্ত করার প্রক্রিয়াটি যে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ ছিল, তা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
সুতরাং ইসলাম প্রথম থেকেই একদিকে যেমন দাসপ্রথাকে নিরুৎসাহিত করেছে, অপরদিকে তেমনি দাস মুক্তিকে ধর্মীয়ভাবে উৎসাহিত কোরে প্রকৃত অর্থে ধীরে ধীরে ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্তির পক্ষেই দিকনির্দেশনা দিয়েছে।
তবে ইসলামের পক্ষে যুদ্ধ অর্থাৎ ‘জিহাদ/ কিতাল’ সংঘটিত হলে বর্তমান ও ভবিষ্যতে সব সময়ই যুদ্ধবন্দী হতে পারে। সাধারণত অমুসলিমরাই যুদ্ধবন্দী হয়। এই অমুসলিম যুদ্ধবন্দীনিদেরকে কিন্তু পবিত্র কোরআনে একটি বারও “দাস-দাসী” হিসেবে উল্লেখ করা হয় নাই। বরং তাদেরকে “মা-মালাকাত-আইমানুকুম” অর্থাৎ “ডান হাতের অধিকারভূক্ত” হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। যুদ্ধবন্দী হলেও তারাও মানুষ। কিন্তু তারপরও একটি পর্যায় পর্যন্ত স্বাধীন ব্যক্তির সাথে যুদ্ধবন্দীদের কিছুটা পার্থক্য থাকেই যায়। তাই বন্দী হলেও তাদের সাথে যেন অমানবিক আচরণ করা না হয়, বরং তাদের অধীকার সংরক্ষণ এবং তাদের সাথে কিরূপ আচরণ করতে হবে সেই দিকনির্দেশনাই দেয়া হয়েছে।
দাসপ্রথা এবং আল-কোরআন
বর্তমানে পৃথিবীর কোথাও রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামপূর্ব দাসপ্রথার প্রচলন আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে মুনষ্যরূপী স্বার্থান্বেষী বর্বরদের কারণে এখনো পৃথিবীর আনাচে কানাচে আধুনিক দাসের সংখ্যা যে নেহায়েত কম নয় তার বাস্তব প্রমাণ রয়েছ I
সর্বাধিক আধুনিক দাসের চারণভূমি ভারত
দাসপ্রথা নাকি এখন অতীত? পরিসংখ্যান কিন্তু অন্য কথা বলছে। ভারতে এখনো বহু শিশুসহ অন্তত এক কোটি ৪৩ লাখ মানুষ আটকে আছেন আধুনিক যুগের দাসত্বের জালে।
সোমবার গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্স ২০১৪’র তালিকা অনুযায়ী ভারত রয়েছে ৫ নম্বরে। ভারত পেছনে ফেলেছে পাকিস্তানকেও। তবে এই তালিকায় সবাইকে পেছনে ফেলে দিয়েছে পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ মৌরিতানিয়া, এর পরেই উজবেকিস্তান।
দাসপ্রথা বিরোধী এনজিও ওয়াক ফ্রির নয়া সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতের ১.১৪০৯% মানুষ কোনো না কোনোও ভাবে দাসত্বের সঙ্গে জড়িত।
আধুনিক দাসেরা কেউ পাচারের শিকার, কাউকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়, কেউ বা বাধ্য হন যৌনকর্মী হতে, কাউকে কাউকে বলপূর্বক শ্রমে বাধ্য করা হয়।
সমীক্ষা বলছে, সংখ্যার বিচারে ভারতে বর্তমানে দাসের সংখ্যা সর্বাধিক। যদিও জনসংখ্যার শতাংশের হারে এগিয়ে আছে মৌরিতানিয়া।
অস্ট্রেলিয়ার এই এনজিওর করা সমীক্ষা বলছে, পৃথিবীতে মোট দাসের ৪৫% ভারত ও পাকিস্তানের। আর পৃথিবীতে এই মুহূর্তে ৩ কোটি ৫৮ লাখ মানুষ মানবতাবিরোধী এই প্রথার শিকার।
পৃথিবীজুড়ে ১৬৭টি দেশে সমীক্ষা চালিয়েছে ওয়াক ফ্রি। এদের মধ্যে ৫৮টি দেশে এই আধুনিক দাসেরা ১২২টি পণ্য উৎপাদনে জড়িত। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার (আইএলও) ধারণায়, এসব দাসদের জোরপূর্বক শ্রম থেকে বছরে ১৫০ বিলিয়ন লভ্যাংশ আসে।
এই মুহূর্তে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে চলছে মানবতাবিরোধী দাসপ্রথা। তবে ইউরোপের দেশগুলো এদিক থেকে অনেক এগিয়ে আছে। নেদারল্যান্ড, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, যুক্তরাজ্য, জর্জিয়া এবং অস্ট্রিয়া এই দাসত্বের বিমোচনের তালিকার উপরের দিকে রয়েছে। তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে আইসল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড, এখানে ৫ লাখ ৬৬ হাজার মানুষ আধুনিক দাসত্বের শিকার।
ওয়াক ফ্রির চেয়ারম্যান অ্যান্ড্রু ফরেস্ট বলেছেন, ‘দাসপ্রথা অতীতের, সাধারণত যুদ্ধপীড়িত এবং অভাবী রাষ্ট্রে এটার অস্তিত্ব ছিল ধারণা করা হয়। কিন্তু এই সংজ্ঞার পরিবর্তন হয়েছে। প্রায় সব দেশেই আধুনিক দাসত্ব রয়েছে।’
মানবাধিকার বিরোধী আধুনিক দাসত্ব এবং তাদের দুর্দশার জন্য আমরা সবাই দায়ী বলেও মত দেন তিনি।
সূত্র: এএফপি
………………………………
আল-কোরআনে দাসপ্রথা থেকে মুক্তির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই ধর্মীয় নির্দেশ ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যথাযথ বাস্তবায়ন করা মুসলিমদের জন্য ফরজ। আবার দাসপ্রথা দূরীকরণের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্র হোক বা না হোক, এ পৃথিবীতে এ ধরনের অন্যায় ও মানবতা বিরোধী প্রথা বহাল থাকার কোন অবকাশ নেই। কিন্তু তারপরও কোটি কোটি মানুষ এই প্রথার নির্মম স্বীকারে নিষ্পেষিত হচ্ছে। মুসলিমরাও এই অমানবিক কর্ম থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত নয়। তাহলে কি আমাদের বিশ্বাসে কোন ঘাটতি আছে? নাকি ধর্ম-কর্ম, কথায় ও কাজে বৈপরিত্য ও ছল-চাতুরী করাই আমাদের মজ্জাগত স্বভাব?
বর্তমানে রাষ্ট্রীয়ভাবে না হলেও বিভিন্ন দেশের সমাজের মাঝে যেভাবে দাসপ্রথা চালু আছে তা থেকে মুক্তির উপায় কি? এর দায় কি সেই দেশগুলোর শাসকরা এড়াতে পারবেন?
আল-কোরআনে যেহেতু দাসপ্রথা বিলুপ্তির লক্ষ্যে দাস মুক্তির কথা বলা হয়েছে, তাই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় নুতন কোরে দাসপ্রথা চালু করার কোনই অবকাশ নেই। এ পৃথিবীর কোন প্রান্তে কখনো যদি কোন মানবগোষ্ঠী দ্বারা পুনরায় দাসপ্রথা চালু করা হয়, তাহলে এর বিরোধীতা করার সাথে সাথে সেখান থেকে প্রথমত দাস-দাসীদের ক্রয় কোরে হলেও তাদেরকে মুক্ত করা শুরু করতে হবে। মানবতা রক্ষায় ও মুক্তির লক্ষ্যে প্রাথমিক ধাপ হিসেবে দাস-দাসী ক্রয় করে মুক্ত করে দেয়া ইসলামে অবৈধ করা হয়নি। তাছাড়া মুসলিম নারী-পুরুষরা শত্রুপক্ষের হাতে দাস-দাসী হিসেবে বন্দী হয়ে থাকলে তাদেরকে মুক্ত করে নিয়ে আসার জন্যও ক্রয়-বিক্রয় করার প্রয়োজন হতে পারে। এক্ষেত্রে একপক্ষকে ক্রয় করতে হলে তো অপরপক্ষকে বিক্রয়ও করতে হবে। কিন্তু তাই বলে কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে ক্রয়-বিক্রয়েরে মাধ্যমে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার কোন সুযোগ নেই। ক্রয় করে মুক্ত করার সাথে সাথে দাসপ্রথা বন্ধের জন্য সেই জনগোষ্ঠীর শাসকশ্রেণী বা কর্তাব্যক্তিদের বোঝাতে হবে। তারা রাজি না হলে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা মুসলমানদের ইমানী দায়িত্ব বলে আমি বিশ্বাস করি। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করে হলেও সেই অত্যাচারীদের হাত থেকে অসহায় দাস-দাসীদের মুক্ত করতে হবে।
কিন্তু কাম-লালসার অনুসারী কোন ধনকুবের মুসলমান যদি একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে আপন অভিরুচি ও খেয়ালের বশবর্তী হয়ে কোন অন্ধগলি হতে দু-চারজন সুন্দরী নারী ক্রয় করে এনে আপন গৃহে দাসী বানিয়ে রেখে খাওয়া ও পড়ার ব্যবস্থা করে এবং বিয়ে না করেই তাদের সাথে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলে- তাহলে ইসলামী আইন অনুসারে সেই ব্যক্তিটি কি দাসপ্রথার ধারকবাহক ও ব্যভিচার করার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবে না?
আল-কোরআনে, সূরা নিসা (মদীনায় অবতীর্ণ)-
(৪:১৮) অর্থ- আর তওবা তাদের জন্য নয়, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে যে পর্যন্ত না তাদের কারো মাথার উপর মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়- কেবল তখনই সে বলতে থাকে, “আমি অবশ্যই এখন তওবা করছি”। আর তওবা নেই তাদের জন্য, যারা কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। আমি তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।
কোন মুসলমান হঠাৎ কোন কবিরা গুণাহ কোরে ফেলার পর যদি তার ভুল বুঝতে পেরে তওবা করে এবং আর না করে, তাহলে সে মাফ পেতে পারে। কিন্তু জানা স্বত্তেও ইচ্ছাকৃতভাবে একই কবিরা গুণাহ বার বার করতে থাকলে কি সে প্রকৃত ইমানদার থাকতে পারবে? জানা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে কোন কবিরা গুণাহ বার বার করাটা কি কুফরি করা অর্থাৎ সেটাকে কবিরা গুনাহ হিসেবে অস্বীকার করার সামিল নয় কি?
ইসলামে দাসপ্রথাকে নিরুৎসাহিত করার মাধ্যমে তা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত করার জন্য যে ধরনের ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছিল, তা অত্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ বলেই আমি বিশ্বাস করি।
জাহেলি যুগে মালিকরা তাদের দাসীদের সাথে নিজেরাই শুধু নয়, অন্যের সাথেও যৌনকর্মে বাধ্য করত এবং পতিতাবৃত্তির মাধ্যমে অর্থ কামাই করা দোষের মনে করা হত না। তাছাড়া একজনের অধিকারে থাকা দাসী এমনকি স্ত্রীকেও অপরজনের সাথে বদল কোরে সাময়িক ঘনিষ্ট সম্পর্ক স্থাপনের রেওয়াজ চালু ছিল। একই ভাবে বলা যায় যে, পূর্ব থেকে চলে আসা প্রথাগত কারণে ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে সমাজে সেই জাহেলি কর্ম ও ‘মুতা’ নামক সাময়িক সম্পর্ক স্থাপনেরও হয়ত প্রচলন ছিল। যেহেতু সে মুহূর্তে আল-কোরআনে এ সম্পর্কে স্পষ্ট কোন দিকনির্দেশনা আসে নাই। তাই অনেক দিন থেকে অভ্যস্ত এরূপ বদ অভ্যাস থেকে নও মুসলিমদেরকে ধীরে ধীরে বের করে নিয়ে আসার মহৎ উদ্দেশ্যেই হয়ত সমসাময়িক কিছু হদিছে এর পক্ষে কিছু ইংগিত মিললেও বেশ কিছু বিধি নিষেধ আরোপের মাধ্যমে প্রথমত তা নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টা নেয়া হয়। তবে এই অনুমোদন বেশিদিন স্থায়ী ছিলনা অর্থাৎ অন্যান্য হাদিছে তা স্পষ্টভাবে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এভাবে এরূপ স্বেচ্ছাচারিতাকে গ্রহণ নয় বরং অচিরেই তা বর্জন করার পদক্ষেপ নেয়া হয়। তাছাড়া পবিত্র কোরআনে এ ধরনের স্বেচ্ছাচারী কর্মকে কখনই অনুমোদন দেয়া হয় নাই, তাই এগুলো হালাল মনে করার কোন সুযোগ কখনই ছিলানা, এখনও নেই এবং থাকবেও না। বরং ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে এ ধরনের স্বেচ্ছাচারী জীবনধারায় অভ্যস্তদের মধ্য থেকে যারা ইসলাম কবুল করতেন, তাদের জন্য আল-কোরআনে সাময়িকভাবে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় এবং এরূপ অনাকাঙ্খিত অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে কিছুটা শৃঙ্খলা ও নিয়মের মধ্যে বেধে দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়।
সূরা আল মু’মিনুন ২৩:৫-৭ (মক্কায় অবতীর্ণক্রম-৭৪) ও সূরা আল মাআ’রিজ ৭০:২৯-৩১ (মক্কায় অবতীর্ণক্রম-৭৯)-
(৭০:২৯) অর্থ- এবং যারা তাদের লজ্জা-স্থানের হেফাযত করে,
(৭০:৩০) অর্থ- তবে তাদের স্ত্রী অথবা তাদের (مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ) ‘ডান হাতের অধিকারভুক্ত’ ব্যতীত, তখন বাস্তবিকই তারা তিরস্কৃত হবে না।
(৭০:৩১) অর্থ- এরপর যারা এর বাহিরে অন্য কিছু অন্বেষণ করে, তারাই সীমা-লঙ্ঘনকারী
এর মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হলো যে, কোন পুরুষের স্ত্রী ছাড়াও ডান হাতের অধিকারভুক্ত নারী (দাসী) থাকলে তিনি ইসলাম গ্রহণের পর থেকে ইসলামী জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে প্রকৃত মুমিন হতে হলে আপন স্ত্রী এবং ডান হাতের অধিকারভুক্ত নারী (দাসী) ছাড়া অন্যদের সামনে লজ্জাস্থান হেফাজত করার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই নির্দেশনা শুধু তাদের জন্যই নয়, বরং স্বেচ্ছাচারী জীবনধারায় অভ্যস্ত সকল সময়ের ও সকল স্থানের সেই ব্যক্তিদের জন্যও প্রযোজ্য হবে, যারা সেই ভ্রান্তপথ থেকে ফিরে এসে আল-কোরআনের জীবন বিধান অনুসারে সরল পথে চলার জন্য ইসলাম কবুল করতে চান। তবে এটা ঠিক যে, এই আয়াতগুলোর মাধ্যমে ডান হাতের অধিকারভুক্ত যুদ্ধবন্দী নারীদের সাথে তাদের মুসলিম অভিভাবকরা উপপত্নীর ন্যায় সম্পর্ক জারি রাখতে পারবে কি পারবেনা সে বিষয়ে তখনও পর্যন্ত স্পষ্ট কোন নির্দেশনা দেয়া হয় নাই।
তবে আল-কোরআনের প্রাথমিক পর্যায়ে অবতীর্ণ অর্থাৎ মক্কী সূরায় প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীল/লজ্জাজনক বিষয়সমূহও হারাম করা হয়েছে অর্থাৎ ব্যভিচারের কাছেও যেতে নিষেধ করা হয়েছিল-
৭ নং সূরা আরাফ (মক্কায় অবতীর্ণক্রম-৩৯)
৩৩: অর্থ- তুমি বলে দাও, আমার পালনকর্তা হারাম করেছেন যাবতীয় প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীল/লজ্জাজনক বিষয়সমূহ এবং সকল গোনাহ এবং অন্যায়ভাবে বাড়াবাড়ি করা, আল্লাহর সাথে অংশীদার করা, যে বিষয়ে তিনি কখনো কোন সনদ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে এমন সব কথা বলা, যার ব্যাপারে তোমাদের কোন জ্ঞানই নাই।
১৭ নং সূরা বণী ইসরাঈল (মক্কায় অবতীর্ণ ক্রম-৫০)
৩২: অর্থ- আর তোমরা অবৈধ যৌন সংগম/ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটা একটা অশ্লীল পাপাচার ও মন্দ পথ।
ইসলাম প্রথম থেকেই একদিকে যেমন দাসপ্রথাকে নিরুৎসাহিত করেছে, অপরদিকে তেমনি দাস মুক্তিকে ধর্মীয়ভাবে উৎসাহিত কোরে প্রকৃত অর্থে ধীরে ধীরে ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্তির পক্ষেই দিকনির্দেশনা দিয়েছে।
আল-কোরআনে ইসলাম পূর্ব অধিকারভুক্ত ক্রীতদাসী এবং যুদ্ধবন্দী নারীদেরকে مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ/ ma malakat aymanuhkum/ মা- মালাকাত আইমানুকুম অর্থাৎ ‘ডান হাতের অধিকারভুক্ত’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। জাহেলি যুগে দাসপ্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল। তাই ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম পূর্ব অধিকারভুক্ত দাসীদের সাথে শুধুমাত্র তাদের মালিকদের যৌন সম্পর্কের বিষয়টি সরাসরি নিষিদ্ধ করার ব্যপারে আল-কোরআনে হঠাৎ করে কোন বিধান দেয়া হয় নাই। কারণ হঠাৎ করে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে তা তৎকালিন সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি প্রেক্ষাপটে মোটেই যুক্তিযুক্ত হত না। বরং দাসমুক্তির নামে কোনরূপ হটকারী সিদ্ধান্ত দেয়া হলে এবং হঠাৎ করে বিপুল সংখ্যক দাস-দাসীকে রাস্তায় বের করে দিলে নব্য ও উদিয়মান রাষ্ট্রের মাঝে ব্যপক বিপর্যয় ঘটে যাওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক ছিলনা। এরূপ হটকারী সিদ্ধান্তের ফলে যে সমাজে নানামুখি সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল এবং দাসমুক্তির নামে হঠাৎ করে বিপুল সংখ্যক নারীকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়ায় তারা যে পতিতা বৃত্তিতে বাধ্য হয়েছিল, পৃথিবীর ইতিহাসের পাতা ঘাটলে সেই প্রমাণই মেলে। তাই ইসলামে দাসপ্রথাকে নিরুৎসাহিত করার মাধ্যমে তখনকার দাসপ্রথায় অভ্যস্ত সমাজ থেকে ধীরে ধীরে তা বিলুপ্ত করার প্রক্রিয়াটি যে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ ছিল, তা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
তবে ইসলামের পক্ষে যুদ্ধ অর্থাৎ ‘জিহাদ/ কিতাল’ সংঘটিত হলে বর্তমান ও ভবিষ্যতে সব সময়ই যুদ্ধবন্দী হতে পারে। সাধারণত অমুসলিমরাই যুদ্ধবন্দী হয়। এই অমুসলিম যুদ্ধবন্দীনিদেরকে কিন্তু পবিত্র কোরআনে একটি বারও “দাস-দাসী” হিসেবে উল্লেখ করা হয় নাই। বরং তাদেরকে “মা-মালাকাত-আইমানুকুম” অর্থাৎ “ডান হাতের অধিকারভূক্ত” হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। যুদ্ধবন্দী হলেও তারাও মানুষ। কিন্তু তারপরও একটি পর্যায় পর্যন্ত স্বাধীন ব্যক্তির সাথে যুদ্ধবন্দীদের কিছুটা পার্থক্য থাকেই যায়। তাই বন্দী হলেও তাদের সাথে যেন অমানবিক আচরণ করা না হয়, বরং তাদের অধীকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয় সেই দিকনির্দেশনাই দেয়া হয়েছে।
এবার নিচের প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি-
এই অমুসলিম যুদ্ধবন্দীনিদের সাথে তাদের অভিভাবকরা কি এখনও বিবাহ ছাড়াই যৌন সম্পর্ক করতে পারবে?
আমি বুখারী শরীফের একটি পরিচ্ছেদে (পরিচ্ছেদ: ১৩৮৬, বুখারী শরীফ, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-৯১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন্স বাংলাদেশ) উল্লেখিত বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই-
সাথে বুখারী শরীফের লিংটি দিলাম- দেখে নিতে পারেন-
হাদিছের সাথে সংযোজিত এ ধরনের বক্তব্য সম্পর্কে আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আমি স্বীকার করছি। মুসলিম জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ ও আল্লাহর পরহেজগার বান্দাদের নামে চালানো এসব বক্তব্য আদৌ তাদের কিনা তা অবশ্যই খতিয়ে দেখা দরকার। আমি বিশ্বাস করি যে, যুদ্ধবন্দী সম্পর্কে ইসলামের বিধান ক্ষেত্র বিশেষে কিয়ামত পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।
আবারও বলছি- হাদিছ সম্পর্কে আমার কোন খটকা নেই। হাদিছের উপরে খন্ডিতভাবে পরিচ্ছেদে উল্লেখিত বসরি (র) ও আতা (র) এর বক্তব্যের কারনে অনেকেই দ্বন্দে ভোগেন এবং সাধারন পাঠকদের মনে ভুল ধারনার সৃষ্টি হতে পারে। শুধু তাই নয়, অনেকে অজ্ঞতা বশত এ ধরনের বক্তব্যকে হাদিছের উপরে স্থান দিতেও কোমর বেধে নেমে পড়েন। তাই কোন ভিত্তি না থাকলে হাদিছ গ্রন্থে এ ধরনের বক্তব্য সংযোজন না করলেই কি ভাল হয় না?
পরিচ্ছেদে উল্লেখিত বাঁদী/দাসীটি যে মালিকের অধিকারভুক্ত হবার পূর্বে তার আগের স্বামী কর্তৃক কিংবা অন্য কারও দ্বারা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিল, বিচ্ছিন্নভাবে দেয়া এই বক্তব্যে তো সেটাই প্রতীয়মান হয়। কিন্তু অন্যের দ্বারা গর্ভবতী কোন নারীকে শারীরিকভাবে ভোগের জন্য অপর কোন ব্যক্তিকে অনুমতি দেয়া কি মানবিক কিংবা ধর্মীয় দিক থেকে যুক্তিসঙ্গত ও বৈধ হতে পারে? তাছাড়া এ অবস্থায় এরূপ আচরণ করা জুলুমের নামান্তর নয় কি?
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ ধরনের ভুল ব্যাখ্যার উপর ভর করে মুসলিম সমাজের মধ্যে সুযোগ-সন্ধানী ও কাম-লিপ্সু স্বভাবের লোকেরা নানা অযুহাতে অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। অনেকে তো খাওয়া-পড়া ও মাসোহারার বিনিময়ে গৃহকর্মে নিয়োজিত নারীদেরকে ইসলাম পূর্ব দাসী/বাদীদের মতন মেনে নিয়ে তাদের সাথে ব্যভিচার করাকে জায়েজ ভাবছে (নাউযুবিল্লাহ)। বিপথগামীদের এরূপ নাজায়েজ আচরণ পরিবার তথা সমাজকে শুধু কলুষিতই করছে না, ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ সাধারণ মুসলিম এবং অন্য ধর্মের অনুসারীদের মনে ইসলাম সম্পর্কে খটকা ও বৈরি মনোভাবেরও জন্ম দিচ্ছে। ভোগলালসা মেটানোর জন্য গৃহকর্মে নিয়োজিত কোন নারীকে ভুল ব্যাখ্যার ছলনায় ক্রীতদাসী/বাঁদী বানিয়ে তার সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলার কোন প্রশ্নই আসতে পারেনা। কারণ আল-কোরআনে এ ধরনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন বক্তব্য বা ইংগিতও নেই, বরং কোন নারীকেই (স্বাধীন যুবতী বা গৃহপরিচারিকা হোক কিংবা ‘ডান হাতের অধিকারভুক্ত’ হোক) যেন রক্ষিতা রূপে (০৪:২৫) গ্রহণ করা না হয় সে ব্যাপারেই স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কাকে বিয়ে করা যাবে বা যাবেনা এ বিষয়ে আল-কোরআনের নির্দেশ-
সূরা নিসা (মদীনায় অবতীর্ণ- ক্রম ৯২)
(৪:২২) অর্থ- যে নারীকে তোমাদের পিতা-পিতামহ বিবাহ করেছে তোমরা তাদের বিবাহ করোনা। কিন্তু যা বিগত হয়ে গেছে। এটা অশ্লীল, গযবের কাজ এবং নিকৃষ্ট আচরণ।
(৪:২৩) অর্থ- তোমাদের (বিবাহের) জন্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তোমাদের মা, তোমাদের মেয়ে, তোমাদের বোন, তোমাদের ফুফু, তোমাদের খালা, ভাইয়ের মেয়ে; বোনের মেয়ে, তোমাদের সেই মায়েরা যারা তোমাদেরকে স্তন্যপান করিয়েছে, তোমাদের দুধ-বোন, তোমাদের স্ত্রীদের মা, তোমরা যাদের সাথে সহবাস করেছ সেই স্ত্রীদের কন্যা- যারা তোমাদের লালন-পালনে আছে। যদি তাদের সাথে সহবাস না করে থাক, তবে এ বিবাহে তোমাদের কোন গোনাহ নেই। তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রী এবং দুই বোনকে একত্রে বিবাহ করা; কিন্তু যা অতীত হয়ে গেছে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাকারী, দয়ালু।
(০৪:২৪) অর্থ- এবং (wal-muḥ’ṣanātu mina l-nisāi) স্বাধীন নারীদের মধ্যকার সকল বিবাহিতা (তোমাদের বিবাহের জন্য নিষিদ্ধ); তাদের ছাড়া- যারা (مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ/ ma malakat aymanukum/ মা- মালাকাত আইমানুকুম) তোমাদের ডান হাতের অধিকারভুক্ত রয়েছে, এটা তোমাদের জন্য আল্লাহর হুকুম। আর তোমাদের জন্য বৈধ এদের বাইরে (যারা আছে), যদি তোমরা চাও স্বীয় সম্পদের বিনিময়ে (muḥ’ṣinīna) বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য- ব্যভিচারের জন্য নয়। অতঃপর তোমরা তো তাদের মধ্য থেকে এর সুফল পেতে চাও, সুতরাং তাদেরকে প্রদান কর (ujūrahunna farīḍatan) তাদের পুরস্কার/ প্রতিদান (বিয়ের মোহরানা) ফরজ স্বরূপ। তোমাদের কোন দোষ নেই যাতে তোমরা পরস্পর সম্মত হও- (baʿdi l-farīḍati) ফরজের (মোহরানা নির্ধারণের) পরে। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিজ্ঞ, পরমজ্ঞানী।
(০৪:২৫) অর্থ- আর তোমাদের মধ্যে কেউ (l-muḥ’ṣanāti l-mu’mināti) ইমানদার সধবাদের বিয়ে করার সামর্থ্য না রাখলে, “(min fatayātikumu l-mu’mināti) ইমানদার ক্রীতদাসীদের/ যুবতীদের মধ্য থেকে ( مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ) তোমাদের ডান হাতের অধিকারভুক্ত নারীকে” (বিয়ে কর); আল্লাহ তোমাদের ঈমান সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞাত রয়েছেন। তোমরা (ইমানদাররা) পরস্পর এক, অতএব, তাদেরকে তাদের অভিভাবকের অনুমতিক্রমে বিয়ে কর এবং তাদেরকে প্রদান কর (ujūrahunna bil-maʿrūfi) তাদের পুরস্কার/ প্রতিদান (বিয়ের মোহরানা) ন্যায্যভাবে– (muḥ’ṣanātin) বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ নারী হিসেবে, ব্যভিচারিণী কিংবা উপ-পতি গ্রহণকারিণী হিসিবে নয়। অতঃপর যখন তারা বিবাহ বন্ধনে এসে যায়, তখন যদি কোন অশ্লীল কাজ করে, তবে তাদেরকে ইমানদার সধবাদের অর্ধেক শাস্তি ভোগ করতে হবে। এ ব্যবস্থা তাদের জন্যে, তোমাদের মধ্যে যারা পাপের ভয় করে। আর যদি ধৈর্য্য ধারণ কর, তবে তা তোমাদের জন্যে উত্তম। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম-করুণাময়।
(০৪:২৪) নং আয়াতে-
*এদের বাইরে (যারা আছে) বলতে- ১) ৪:২৩ নং আয়াতে উল্লেখিত ব্যক্তিরা ছাড়া ও ২) স্বাধীন (বিশ্বাসী/ অবিশ্বাসী) নারীদের মধ্যকার কোন সধবা নারী ছাড়া আর যারা আছে।
*তোমাদের জন্য বৈধ অর্থাৎ বিয়ের জন্য বৈধ বলতে- ১) স্বাধীন বিশ্বাসী অবিবাহিতা, বিধবা ও তালাকপ্রাপ্তা নারী [ইদ্দত পূর্ণ করার পর পবিত্র হলে অর্থাৎ অন্তঃসত্ত্বা না হলে] এর অন্তর্ভুক্ত, ২) “ডান হাতের অন্তর্ভুক্ত” ইসলাম পূর্ব দাসী/ যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে ইমান এনেছে এরূপ কোন অবিবাহিতা, সধবা ও বিধবা [পবিত্র হওয়ার পর অর্থাৎ অন্তঃসত্ত্বা না হলে] এর অন্তর্ভুক্ত এবং ৩) (৬০:১০) ও (০৫:০৫) নং আয়াত অনুসারে- অবিশ্বাসীদের পক্ষ ত্যাগ করে আসা/ হিজরত করে আসা ইমানদার সধবা নারীরা [যারা পূর্বের অবিশ্বাসী/ আহলে কিতাব সম্প্রদায়ভুক্ত স্বামী এবং পূর্ব ধর্ম/ আপন পক্ষ ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছে] এর অন্তর্ভুক্ত।
সুতরাং (০৪:২৪) নং আয়াত অনুসারে, বিশ্বাসী হোক বা অবিশ্বাসী হোক স্বাধীন নারীদের মধ্যে কোন সধবাকে বিবাহ করা হারাম।
যেহেতু (০৪:২৩ – ২৫) নং আয়াতগুলো নযিলের মাধ্যমে এর পর থেকে বিবাহিত স্ত্রী ছাড়া অন্য কারো সাথে যেকোন প্রকার যৌন সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই এরপর থেকে কোন পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করলে এবং তার অধীনে একাধিক ‘ডান হাতের অধিকারভুক্ত’ নারী থাকেলে তাদের সাথে উপপত্নীর ন্যায় আচরণ করার ব্যাপারে বিধি নিষেধ আরোপিত হয়। সুতরাং সেক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই নারীদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ (০৪:০৩) চারজন ইমানদার নারীকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। আর বাকীদের সাথে যৌন সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের জন্য সাধ্যমত উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সেই নারীদেরকেও ব্যভিচারী জীবন ছেড়ে দিতে হবে এবং তারা চাইলে ইদ্দত পালনের পর অন্যত্র বিয়ে করতে পারবেন। কিন্তু তাই বলে (০৪:২৩ -২৭) নং আয়াত নযিলের পরও ইসলামি জীবনধারায় অভ্যস্ত কোন মুসলিমের জন্য স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কোন স্বাধীন নারীকে কৃত্রিমভাবে ‘ডান হাতের অধিকারভুক্ত অর্থাৎ দাসী’ বানিয়ে তার সাথে উপপত্নীর ন্যায় আচরণ করার কিংবা মুতা নামক সাময়িক বিয়ের নামে অশ্লীলতা করার কোন সুযোগ তখনও যেমন ছিলনা, তেমনি এখনো নেই।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, (০৪:২৫) নং আয়াতে যেসব ইমানদার সধবাদের বিয়ে করার সামর্থ্যের বিষয়ে বলা হয়েছে- তাদের পরিচয় কি?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে (৬০:১০), (৬০:১১) ও (০৫:০৫) নং আয়াতের বক্তব্যকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে।}
…………………………………..
সূরা আল মুমতাহিনা (মদীনায় অবতীর্ণ- ক্রম ৯১)
(৬০:১০) অর্থ- ওহে যারা বিশ্বাস কর! যখন তোমাদের কাছে মুমিন/ইমানদার নারীরা হিজরত করে আগমন করে, তখন তাদেরকে পরীক্ষা কর। আল্লাহ তাদের ঈমান সম্পর্কে সম্যক অবগত আছেন। যদি তোমরা বুঝতে পার যে তারা বিশ্বাসী, তবে আর তাদেরকে অবিশ্বাসীদের কাছে ফেরত পাঠিও না। এরা অবিশ্বাসীদের জন্যে হালাল নয় এবং অবিশ্বাসীরা এদের জন্যে হালাল নয়। অবিশ্বাসীরা যা ব্যয় করেছে (সেই হিজরত করে আসা মুমিন/ইমানদার নারীদেরকে বিয়ে করার সময় যদি কিছু দিয়ে থাকে), তা তাদের দিয়ে দাও। অতঃপর, তোমরা তাদেরকে বিবাহ করলে তোমাদের অপরাধ হবে না, যদি তোমরা তাদের প্রাপ্য মোহরানা তাদেরকে দিয়ে দাও। তোমরা অবিশ্বাসী নারীদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রেখো না। *তোমরা যা ব্যয় করেছ তা চেয়ে নাও এবং তারাও চেয়ে নিবে যা তারা ব্যয় করেছে। এটা আল্লাহর বিধান; তিনি তোমাদের মধ্যে ফয়সালা করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।
(৬০:১১) অর্থ- তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যদি কেউ হাতছাড়া হয়ে অবিশ্বাসীদের কাছে থেকে যায়, অতঃপর তোমাদের যদি সুযোগ আসে, তখন যাদের স্ত্রীরা হাতছাড়া হয়ে গেছে, তাদেরকে তারা যা ব্যয় করেছিল (অর্থাৎ সেই নারীদেরকে বিয়ে করার সময় যা দিয়েছিল) তার সমপরিমাণ (৬০:১০-*অবিশ্বাসীদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে) আদায় করে দাও, ভয় কর আল্লাহকে যার প্রতি তোমরা বিশ্বাসী।
(৬০:১২) অর্থ- হে নবী! ঈমানদার নারীরা যখন আপনার কাছে এসে আনুগত্যের শপথ করে যে, তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, জারজ সন্তানকে স্বামীর ঔরস থেকে আপন গর্ভজাত সন্তান বলে মিথ্যা দাবী করবে না এবং ভাল কাজে আপনার অবাধ্যতা করবে না, তখন তাদের আনুগত্য গ্রহণ করুন এবং তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল অত্যন্ত দয়ালু।
(৬০:১৩) অর্থ- ওহে বিশ্বাসীগণ, তোমরা সেই জাতির সাথে সন্ধি স্থাপন করো না, আল্লাহ যাদের প্রতি রুষ্ট। তারা পরকাল সম্পর্কে নিরাশ হয়ে গেছে যেমন কবরস্থ অবিশ্বাসীরা নিরাশ হয়ে গেছে।
সূরা আল মায়েদাহ (মদীনায় অবতীর্ণ- ক্রম ১১২)
(০৫:০৫) অর্থ- আজ তোমাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ হালাল করা হল। আহলে কিতাবদের খাদ্য তোমাদের জন্যে হালাল এবং তোমাদের খাদ্য তাদের জন্য হালাল। তোমাদের (বিয়ের) জন্যে হালাল ইমানদার নারীদের মধ্যে যারা সধবা এবং তাদের সধবা নারীরা, যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তোমাদের পূর্বে, (অর্থাৎ যে বিশ্বাসী নারীরা আহলে কিতাব সম্প্রদায়ভুক্ত স্বামী এবং আপন পক্ষ ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছে) যখন তোমরা তাদেরকে মোহরানা প্রদান করে বিয়ে কর সচ্চরিত্র থাকার জন্যে, লাম্পট্য করার জন্যে কিংবা গুপ্ত প্রেমে লিপ্ত হওয়ার জন্যে নয়। যে ব্যক্তি বিশ্বাসের বিষয় অবিশ্বাস করে, তার শ্রম বিফলে যাবে এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
……………………………………….
{সূরা নিসা এর (০৪:২৫/ অবতীর্ণ ক্রম-৯২) নং আয়াতে যেসব ইমানদার সধবাদের বিয়ে করার সামর্থ্যের বিষয়ে বলা হয়েছে, এর পূর্বেই নাজিলকৃত সূরা আল মুমতাহিনা এর (৬০:১০/অবতীর্ণ ক্রম-৯১) নং আয়াতে তাদের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছিল এবং শর্ত সাপেক্ষে তাদেরকে বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে নাজিলকৃত সূরা আল মায়েদাহ এর (০৫:০৫/অবতীর্ণ ক্রম-১১২) নং আয়াতে পুনরায় এই ইমানদার নারীদের মধ্যে যারা সধবা তাদেরকে মোহরানা দিয়ে বিয়ে করা হালাল উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাদের সাথে কোন প্রকার অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করাকে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। এই ইমানদার সধবা নারীরা হোল তারাই, যারা ইসলামের জন্য পূর্বের অবিশ্বাসী/ আহলে কিতাব সম্প্রদায়ভুক্ত স্বামী এবং পূর্ব ধর্ম/ আপন পক্ষ ত্যাগ কোরে আসে অর্থাৎ হিজরত করে। ইসলাম ধর্মের প্রতি বিশ্বাসী ও আনুগত্যশীল এই নারীরা সর্বস্ব ত্যাগ করে আসায় অর্থাৎ হিজরত করার কারণে (০৪:২৪- নং আয়াত অনুসারে) সধবা হওয়া সত্বেও তাদেরকে বিয়ে করার বৈধতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদেরকে বিয়ে করার আগে তারা (৬০:১২) সত্যি সত্যি ইমান এনেছে কিনা তা যাচাই করে দেখতে বলা হয়েছে। মুসলিম পুরুষদের মধ্যে কেউ সেই নারীদের কাউকে বিয়ে করতে চাইলে, পূর্বের অবিশ্বাসী/আহলে কিতাবধারী স্বামী তাকে বিয়ে করার সময় যদি কিছু দিয়ে থাকে এবং দাবি করে, তাহলে আগের (অবিশ্বাসী/আহলে কিতাবধারী) স্বামীকে প্রথমত সেই দাবিকৃত অর্থ/সম্পদের সমপরিমাণ ফিরিয়ে দেবার এবং তারপর মোহরানা আদায় করে তবেই সেই নারীকে বিয়ে করার শর্ত আরোপ করা হয়েছে। সুতরাং তাদের মধ্যে কাউকে বিয়ে করতে হলে যে খরচ হবে তার পরিমাণ কোন ইমানদার ইসলামপূর্ব দাসী/যুদ্ধ-বন্দিনীকে বিয়ে করার খরচের চাইতে স্বভাবতই খানিকটা বেশিই হবে। তথাপি ইসলামের প্রতি অকৃত্রিম আনুগত্য ও বিশ্বাসের কারণে সর্বস্ব ত্যাগ করে আসা অর্থাৎ হিজরত করে আসা এই ইমানদার সধবা নারীদের মর্যাদা অনেক বেশি হওয়ায় তাদেরকে বিয়ে করার প্রতি সকল ইমানদার মাত্রই দুর্বলতা থাকাই স্বাভাবিক এবং সামর্থ্যবানেরা তাদেরকে বিয়ে করে ধন্য হতে চাইবেন। কারণ একজন ইমানদারের কাছে তাকওয়াই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সম্পদ। কিন্তু এই নারীদের বিয়ে করার মত সামর্থ্য যাদের নেই তাদেরকে সচ্চরিত্র থাকার জন্য (০৪:২৫ নং আয়াত অনুসারে) *ডান হাতের অধিকারভুক্তদের মধ্য থেকে ইমান এনেছে এমন কোন (مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ) নারীকে তার সম্মতি ও অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে এবং মোহরানা স্বরূপ কিছু দিয়ে বিয়ে কোরে সন্তুষ্ট থাকার উপদেশ দেয়া হয়েছে।}
এরপর (৪:২৬) ও (৪:২৭) নং আয়াতে স্পষ্টভাবে সাবধান কোরে দেয়া হলো যেন বিশ্বাসীরা কাম-লিপ্সুদের ছলনায় ভুলে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণের মাধ্যমে অর্থাৎ ব্যভিচারের পথে পা বাড়িয়ে আল্লাহতায়ালার নৈকট্য থেকে দূরে সরে না যায়।
সূরা নিসা (মদীনায় অবতীর্ণ)-
(৪:২৬) অর্থ- আল্লাহ তোমাদের পূর্ববর্তীদের দৃষ্টান্ত দ্বারা সব কিছু স্পষ্টরূপে বর্ণনা করে দিতে চান, তোমাদের হেদায়েত দান করতে চান এবং তোমাদের দিকে ফিরতে (ক্ষমা করতে) চান। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, পরমজ্ঞানী।
(৪:২৭) অর্থ- আল্লাহ তোমাদের প্রতি ফিরতে (ক্ষমা করতে) চান; কিন্তু যারা কাম-লালসার অনুসারী, তারা চায় তোমরাও যেন (তাঁর কাছ থেকে) অনেক দূরে বিচ্যুত হয়ে পড়।
সুতরাং এই আয়াত গুলো নাজিলের পর একজন মুসলমানের জন্য এই নির্দেশের বাহিরে বিবাহ বহির্ভূত যে কোন প্রকার যৌন সম্পর্কই ব্যাভিচার নয় কি?
অনেকে মনে করেন, জাতিসংঘের জেনেভা কনভেনশান প্রবর্তিত আন্তর্জাতিক আইন ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ মানতে বাধ্য এবং সে কারণেই নাকি ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় আর দাসপ্রথার প্রচলন হবার সুযোগ নেই। এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে আল-কোরআনের আইনের সীমাবদ্ধতাই শুধু নয়, বরং আল্লাহর আইন যে পরোক্ষভাবে মানব রচিত আইনের উপর নির্ভরশীল (নাউযুবিল্লাহ) – সেই ইংগিত কি বহন করে না? তাই এ ধরনের বক্তব্যের সাথে আমি একমত নই। এ বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত নিচের আয়াতের বক্তব্যের প্রতি আমি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি-
সূরা আল-ইমরান (মদীনায় অবতীর্ণক্রম- ৮৯)
(০৩:৭৯) অর্থ- কোন মানুষের জন্য সমীচিন নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, হেকমত ও নবুওয়ত দান করার পর সে বলবে, ‘তোমরা আল্লাহকে পরিহার করে আমার পূজারী/ দাস/ বান্দা হয়ে যাও’। বরং (বলা উচিত) ‘তোমরা আল্লাহভক্ত হয়ে যাও’, কারণ তোমরাই তো কিতাব শেখাচ্ছ এবং তোমরা তা অধ্যয়নও করছ।
আল্লাহর কিতাবের এই স্পষ্ট বক্তব্যের পরও কি কোন মানুষকে ক্রীতদাস বানিয়ে রাখার কোন সুযোগ থাকে? তথাকথিত ‘দাসপ্রথা’ ও ইসলামের ‘ডান হাতের অধিকারভুক্ত সংক্রান্ত বিধান’ এক বিষয় নয়। ক্ষেত্র বিশেষে আল-কোরআনের এই আইন কিয়ামত পর্যন্ত কার্যকর হতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি। আর তাই বর্তমানে বা ভবিষ্যতে কখনো এই বিধানটি প্রয়োগের প্রয়োজন হলে তার জন্য মানব রচিত international laws (জাতিসংঘের জেনেভা কনভেনশান) এর উপর নির্ভর করার কোন প্রয়োজন নেই। বরং আল-কোরআনে নাজিলকৃত আল্লাহতায়ালার দিক নির্দেশনাই যথেষ্ট বলে আমি বিশ্বাস করি। আশাকরি আমার বক্তব্যটা একটু বুঝতে চেষ্টা করবেন।
ইসলাম দাস প্রথাকে একদমই প্রমোট করেনি।এ বিষয়ে আল-কোরআনে প্রাথমিক পর্যায়ে নাযিলকৃত মক্কি-সূরার সাথে পরবর্তীতে মদীনায় নাযিলকৃত সূরার বক্তব্যকে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন না করার কারনে সাধারন পাঠকগণ প্রায়ই বিষয়টি বুঝতে পারেন না। তাই যুদ্ধবন্দী সম্পর্কিত আল-কোরআনে নাজিলকৃত সূরাগুলোর সাথে সহী হাদিছগুলো ধারাবাহিকভাবে পেশ করলে আসল বক্তব্য স্পষ্ট হবে এবং সবারই বুঝতে সুবিধা হবে।
কেউ স্যুট টাই পড়লে, তা ভিতরে যে জিনিষই থাক – সভ্য বলেই প্রতীয়মান হয়। একসময় এই বঙ্গে ইংরেজী জানাটাই ছিল শিক্ষিত হিসেবে নিজেকে জাহির করার একটা চেষ্টা। ইংলিশ স্পিকিং দেশে ইংরেজী জানা অশিক্ষিত লোকও থাকে! ৯/১১ এর পর বাংলামূলুকে কিছু আদমী দেখা গেল, যারা বেশী বেশী আমেরিকান কিংবা ব্রিটিশ হবার জন্য ইরাক যুদ্ধের পক্ষে জোর সমর্থন দিতো! অথচ ঐ আমেরিকা এবং ব্রিটেনে যুদ্ধবিরোধী মানুষ আছে, সংখ্যায় নগণ্যও নয়! যুদ্ধের বিপক্ষে বড় সড় প্রতিবাদগুলো সেখানেই বেশী হয়েছে। সে সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের ইরাক নীতি কিংবা বুশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াটা যেন তাদের কাছে অনেকটা জাত যাবার অবস্থা! অথচ, বুশবিরোধীতা খোদ মারকিনীরাও করেছে।
গ্রীক সভ্যতার নাগরিকেরা গ্রীক রাজ্যগুলোর বাইরে অন্য জাতিগুলোকে বর্বর বলে মনে করতো, বর্বররা ঠিক মানুষের কাতারে পড়ে না, ফলে তাদের দাস করার মধ্যে এক ধরণের জাস্টিফিকেশন দাঁড় করানো যায়। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টেটলও মনে করতেন দাসরা মনিব ছাড়া চলতে অক্ষম, দাসত্ব তাদের সারভাইভালের জন্য অপরিহার্য! আধুনিক সভ্যতাও ইউরোপে প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার পূণঃজাগরণ। একদিকে দাসবিদ্রোহ এবং অপরদিকে সাম্প্রতিক ফরাসী বিপ্লবের ধাক্কা – এ দুয়ের মাঝে পড়ে ফ্রান্স ১৭৯৫ সালে দাসত্বকে বিলোপে আইন করে। দাসদের উপর নির্ভরশীল অর্থনীতি হুমকির সম্মুখীন হলে, ১৮০১ সালে থমাস জেফারসন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অভিষিক্ত হবার পর, নেপোলিয়ন এর বিশেষ দূত ওয়াশিংটনে যান হাইতিতে ফ্রান্সের দাসত্ব আবার চালু করার ব্যাপারে। মানুষের সাম্য, বাকস্বাধীনতার স্লোগান তুলে স্বাধীনতা অর্জনকারী যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সের সেই দাসত্ব রক্ষায় আবার সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দেয়! উল্লেখ্য নেপোলিয়ন আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মডেল হিসেবে ফ্রান্সকে গড়তে একজন অগ্রপথিক ছিলেন। যে ফরাসী বিপ্লবের উপর ভড় করে আধুনিক সভ্যতার প্রসার ঘটেছে, মানুষের মুক্তি এসেছে – সেই সভ্যতা কিংবা কাদের মুক্তি তা বুঝায় রয়েছে বিরাট ভ্রম! কায়িক দাসত্ব অনেক কমে গেছে, কিন্তু ওভারঅল দাসত্ব কমেনি – রূপ পাল্টিয়ে তা এখন বিস্তৃত হয়েছে মানসিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক পরিমণ্ডলে। সভ্যতার প্রতি মোহ আপামর সব মানুষের। তাইতো আমেরিকানের চেয়ে বেশী আমেরিকান কিংবা ব্রিটিশের চেয়ে বেশী ব্রিটিশ হবার প্রতিযোগীতা দেখা যায়।
হলিউডের বিখ্যাত গ্ল্যাডিয়েটর ছবির ম্যাক্সিমাস গ্ল্যাডিয়েটর- একজন দাস! রোমানরা চারপাশের অঞ্চল থেকে দাসসংগ্রহ করত সভ্যতাকে ধরে রাখার জন্য। রোমান কলোসিয়ামগুলো তাদের সভ্যতার জয়গান করে- এগুলোও সেই দাসদের দ্বারা নির্মিত। সভ্যতা গড়ার পিছনের মানুষগুলো এই দাসরাই। রোমান রক্ত বহনকারী ম্যাক্সিমাস আর দশজন সাধারণ দাসের মতো নয়। তার শৌর্য-বীর্য ও রোমান রক্তের কাছে সাধারণ দাসদের গ্ল্যাডিয়েটর হয়ে আত্মাহুতি প্রায় মূল্যহীন! রোমান নাগরিকরা গ্ল্যাডিয়েটরদের জীবণ-মৃত্যুর খেলা পয়সা দিয়ে টিকেট কেটে দেখতো! নাগরিকদের মনোরঞ্জনের জন্য গ্ল্যাডিয়েটররা একে অপরের সাথে রক্তারক্তি করে মারা যেতো – এই রক্ত তখন সভ্যতার ধারকদের আনন্দ দিলেও আধুনিক সভ্যতার অংশীদার হয়ে এখনও দর্শকশ্রোতাদের তা ভাবায় না। কারণ গ্ল্যাডিয়েটরদের পরিচিতির সীমানা এভাবেই টানা হচ্ছে আর শৃঙ্খলিত মানুষ সীমার বাইরে চিন্তা করতে পারে না, তার চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে! (ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর নামে বিপিএল এর একটা ক্রিকেট টিম আছে, তারা কি গ্ল্যাডিয়েটরদের করুণ কাহিনী জানে!)।
জীবণ, স্বাধীনতা এবং সম্পদ মানুষের জন্মগত- এই তিন অধিকার রক্ষা করে যে আধুনিক রাজনৈতিক ধারার প্রচলন হয়েছে এবং এখনো বিদ্যমান আছে এর রূপাকার ব্রিটিশ দার্শনিক জন লক [https://sites.google.com/ site/johnlockerocksocks/ enlight]। জন লক এর এই ধারণার সবচেয়ে সফল প্রয়োগ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা আন্দোলনে। ১৬০০ – ১৭০০ শতাব্দীর দিকে দাসব্যবসা এতো জনপ্রিয় হয়ে যায় যে, ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগীজ এবং অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো আফ্রিকাতে স্বর্ণ বাদ দিয়ে দাস ব্যবসার দিকে ঝুকে পড়ে। প্রথমদিকে রয়্যাল আফ্রিকান কোম্পানী ছিল দাসব্যবসায় একচ্ছত্র একটি প্রতিষ্ঠান। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে দাসদের আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর আশে পাশের উপকূলে নিয়ে এনে বিক্রি করতে এই কোম্পানীর বেশ সুনাম ছিল তখন! জন লক সেই কোম্পানীতে মূলধন খাটিয়ে মুনাফা করতেন! অবশ্য ব্রিটিশ সরকার পরবর্তীতে এই লাভজনক ব্যবসা সামান্য কিছু লোকের মধ্যে কূক্ষিগত না রেখে সাধারণ ব্রিটিশদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার নিমিত্তে এই কোম্পানীর অধিকার খর্ব করেন। ফলে সাধারণ ব্রিটিশরাও দাসব্যবসায় লগ্নি করতে সক্ষম হয়।
রমরমা দাস ব্যবসাই ব্রিটেনের নগররাজ্যগুলো গড়তে সহায়তা করে। রাণী এলিজাবেদ-১ ছিলেন প্রথম দিকের একজন অন্যতম দাস ব্যবসার উৎসাহদাতা! ১৬৬০ এর পর ব্রিটেনের অর্থনীতি বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে যার অন্যতম প্রধান উৎস ছিল প্রশান্ত মহাসাগর দিয়ে করা দাস ব্যবসা! পর্তুগীজ, ফ্রান্স কিংবা অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর চেয়ে ব্রিটিশরা ছিল অগ্রগামী। বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্যাংকগুলো ব্রিটেনের অর্থনীতিকে কেবল চালিতই করছিল না, ফ্রান্স কিংবা অন্যান্য যুদ্ধের প্রধান অর্থের যোগানদাতা। লিভারপুলের দাসব্যবসায় জড়িত ব্যবসায়ীরা প্রতিষ্ঠা করেছিল হেইউড (Heywood), ব্যাংক যা পরবর্তীতে বারক্লেই (Barclay) ব্যাংক এর অংশ হয়। এছাড়া আছে লয়ড (Lloyd) ব্যাংক এবং ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ১৮০০ শতকের ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রধান অর্থের যোগানদাতা। দাসব্যবসাকে চালিয়ে নিতে তাদের ভুমিকা ছিল ব্যাপক।
এই ব্রিটিশদের বংশধরেরা আমেরিকাতে রেডইন্ডিয়ানদের নির্মমভাবে হটিয়ে ভুখন্ড দখল করে সেখানেও দাসত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল। ভার্জিনিয়া জেনারেল এসেম্বলি জুন ১৬৮০ এ ঘোষণা দেয়ঃ “যারা নিজেদের দেশে ধর্ম হিসেবে খৃষ্টান নয় তারা দাস হিসেবে পরিগণিত হবে” এবং “দাস তার মনিবের অবাধ্য হলে, মনিবের কোন দাসকে হত্যা করাটাও আইনত দন্ডনীয় নয়!” একসময় আমেরিকান ব্রিটিশরা নিজেদের স্বজাতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। লিবার্টি, ফ্রিডম এবং মানুষের সাম্য- এই মূলমন্ত্র নিয় স্বাধীনতার জন্য লড়াই করলেও এর মূলে ছিল দাসব্যবসা এবং সম্পদের ভাগাভাগি। আমেরিকান ফাউন্ডিং ফাদার জর্জ ওয়াশিংটন মানুষ হয়েছেন দাসদাসী এবং বিত্তবৈভব এর মধ্যে থেকেই। তার পিতার ১১ জন দাস ছিল! জর্জ ওয়াশিংটন এক ধনী মহিলাকে বিয়ে করার পর তার দাসের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৬ তে। তাছাড়া তিনি ১৭০০০ একর জমি পান, যা তাকে ভার্জিনিয়ার প্রথম দশ জন ধনীর একজন হিসেবে পরিণত করে। দাসদের দ্বারা উৎপাদিত পণ্য ইউরোপের বড় বড় শহরগুলোতে নাগরিকদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দিতো। ১৭৫৯ সালে এই দাসদের দ্বারা তামাক চাষ করে ইংল্যান্ডে বিক্রির জন্য পাঠালে ব্যাবসা সফল হয়নি, আরো অনেক দাসমালিকের মতো জর্জ ওয়াশিংটনও ঋণে জড়িয়ে পড়েন। সেটা ছিল আমেরিকার জন্য এক টার্নিং পয়েন্ট, যা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন পর্যন্ত গড়ায়! ১৭৬৫ সালে পার্লামেন্টে প্রথম ব্রিটেনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া হয় একটি এক্ট এর মাধ্যমে যা ধীরে ধীরে সশস্ত্র আন্দোলনে রূপ নেয়।
১৭৭৬ সালে স্বাধীনতার ঘোষণায় আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদার এবং স্বাধীনতার ঘোষণার প্রধান লেখক থমাস জেফারসন উল্লেখ করেছিলেন “We hold this truth to be self-evident, that all men are created equal, that they are endowed by their creator with certain unalienable rights, that among these are life, liberty and the pursuit of happiness. That to secure these rights, governments are instituted among men, deriving their just powers from the consent of the governed”। থমাস জেফারসন কালো আফ্রিকানদের অবদমিত থেকে ভবিষ্যতে একটি সুস্থ আমেরিকা গঠনের ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু, তিনি কালো আফ্রিকানদের মানুষের চেয়ে নিচুস্তরের বলেই মনে করতেন! দাসরা ছিল তার কাছে, তার সুখের জন্য কাজ করে যাওয়া বেগার খাটা শ্রমিক। জেফারসন তার ৮৩ বছরের জীবণে মোট তিনজন দাসকে মুক্তি দেন এবং আরো ৫ জনকে মুক্ত করার উইল করে যান! তিনি ১৮২৬ সালে যখন মারা যান সেই সময়েও তার ৫ টি ফার্মে মোট ২০০ জন দাস কর্মরত ছিল। জেফারসনের অনেক ঋণ ছিল, এ থেকে মুক্ত হতে তিনি ১৩০ জন দাসকে ১১০০ ডলারে ভার্জিনিয়া বিশব্বিদ্যালয়ে বিক্রিও করেছিলেন যাদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশুও ছিল! মারা যাবার পূর্বে সে তিনটি জিনিষের জন্য স্মরণীয় হবার বাসনা ব্যক্ত করেন, যেগুলো হল – ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতীক ভার্জিনিয়ার স্ট্যাচু, তার নির্মিত ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্বাধীনতার ঘোষণা। সেই স্বাধীনতা কালো দাসদের জন্য না! এখনও যেমন স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং সম্পদের হিস্যা সবার জন্য না!
দাস বিদ্রোহ ও একজন স্পার্টাকাস
তবে দাস প্রথার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন সংগ্রাম হয়নি তা কিন্তু নয়।
প্রাচীনকালের অধিকাংশ বড়মাপের দাস বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৪০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৭০ অব্দের মধ্যে। অর্থাত্ রোমান সাম্রাজ্যের একটি বিশেষ পর্বে। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ক্রমাগত বিদ্রোহের ঘটনা ঘটতে থাকে। যেমন : খ্রিস্টপূর্ব ১৩৬-১৩২ সময়কালে সিসিলির প্রথম যুদ্ধ, ১৩৩-১২৯ সময়কালে এশিয়াতে অ্যারিস্টোনিকাসের অভ্যুত্থান, ১০৪ থেকে ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সিসিলির দ্বিতীয় যুদ্ধ এবং খ্রিস্টপূর্ব ৭৩-৭১ সময়কালে বিখ্যাত স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ। এসব বিরাট দাসযুদ্ধ উসকে দিয়েছিল অনেক ছোট সংঘর্ষকে। যেমন- ইতালির বিভিন্ন শহর, অ্যাটিকার খনি অঞ্চল এবং ডেলস দ্বীপে ঘটে যাওয়া নানা অভ্যুত্থান। তবে স্পার্টাকাসের পরাজয়ের পর এ মাপের দাস বিত্রোহ আর ঘটেনি।
স্পার্টাকাস, ইতিহাসের অনন্য নায়ক। প্রাচীন রোমের এই দাস বিদ্রোহী সম্পর্কে ফরাসি চিন্তাবিদ ভলতেয়ার বলেছেন ‘তার যুদ্ধ ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ— হয়তো ইতিহাসের একমাত্র ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ।’ ইতিহাসে তার প্রিয় চরিত্র কে? কন্যার এই প্রশ্নের জবাবে মহামতি কার্ল মার্কস উত্তর দিয়েছিলেন ‘স্পার্টাকাস’। স্পার্টাকাস ছিলেন একজন গ্লাডিয়েটর। গ্লাডিয়েটরদের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে পালিয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন স্পার্টাকাস। স্পার্টাকাসের দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্পার্টাকাসকে নিয়ে অসাধারণ একটি উপন্যাস লিখেছেন মার্কিন লেখক হাওয়ার্ড ফার্স্ট। স্পার্টাকাসকে নিয়ে হলিউডে চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। আধুনিককালে দাসপ্রথাবিরোধী বিদ্রোহের তাত্পর্যময় দৃষ্টান্ত হাইতির দাস বিদ্রোহ। হাইতির দাস বিদ্রোহ (১৭৯১-১৮০৩) পৃথিবীব্যাপী দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনকে শক্তি জুগিয়েছিল। ইতিহাসবিদ সিএলআর জেমস হাইতির দাস বিদ্রোহ সম্পর্কে বলেছেন, ‘ইতিহাসের একমাত্র সফল দাস বিদ্রোহ।’ হাইতির দাস বিদ্রোহ ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
হাইতির দাস বিদ্রোহ শুরু হয় ১৭৯১ সালের ২২ আগস্ট। ১৮০৪ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম হয় স্বাধীন হাইতির। ফ্রাঙ্কলিন নাইটসের মতে, আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সবচেয়ে নিশ্ছিদ্র বা সর্বাত্মক একটি দৃষ্টান্ত হলো হাইতির বিপ্লব। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে হাইতির এই বিপ্লব দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনকে নতুন গতি এনে দেয়। হাইতি বিপ্লবের প্রভাব পড়ে ব্রিটেনেও। ১৮০৮ সালে ব্রিটিশ সরকার তাদের আটলান্টিক জোড়া দাস ব্যবসা বন্ধ কওে দেয়। আর ব্রিটেনে দাস ব্যবস্থার অবসান ঘটে ১৮৩৪ থেকে ১৮৩৮ সালের মধ্যে। ফ্রান্সে দাস প্রথার বিলোপ হয় ১৮৪৮ সালে।
আমেরিকার দক্ষিণাংশের ১১টি রাজ্যের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল দাসশ্রম। ১৮৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দাসের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ মিলিয়ন। আমেরিকার উত্তরাংশে দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে সমাজ সংস্কারক উইলিয়াম গ্যারিসন, ‘আংকল টমস কেবিন’ এর লেখক হ্যারিয়েট বিচার স্টো প্রমুখের নেতৃত্বে। ১৮৬০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন আব্রাহাম লিংকন। লিংকন আমেরিকার পশ্চিমাংশে দাসপ্রথা প্রসারের বিরোধিতা করেন। ১৮৬১ সালের ১২ এপ্রিল শুরু হয় আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ। ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট লিংকন ‘দাসপ্রথাবিরোধী ঘোষণা’ জারির মাধ্যমে আমেরিকার দক্ষিণাংশের কনফেডারেট রাজ্যগুলোর দাসদের দাসত্ব মোচন করেন। ১৮৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ থেকে দাসপ্রথা বিলোপ করা হয়।
ইউরোপে এই অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে সর্বশেষ যে মানুষটি সংগ্রাম করে তিনি হলেন গ্রানভিলি সার্প। বাবা থমাস সার্পের ৩১ সম্মানের মধ্যে তিনি ছিলেন ২০তম। থমাস ছিলেন মানবতাবাদী, সমালোচক। দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করে আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি এ প্রথাকে ইউরোপ থেকে বিদায় করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
পৃথিবীর কয়েকটি দেশে দাসপ্রথা বিলোপের সময়কাল ঃ সুইডেন ১৮৪৬, আর্জেন্টিনা ১৮৫৩, মেক্সিকো ১৮২৯, ডেনমার্ক ১৮৪৮, কিউবা ১৮৮৬, ব্রাজিল ১৮৮৮, মাদাগাস্কার ১৮৯৬, চীন ১৯১০, আফগানিস্তান ১৯২৩, ইরাক ১৯২৪, ইরান ১৯২৮, মিয়ানমার ১৯২৯, সৌদি আরব ১৯৬২, সংযুক্ত আরব আমিরাত ১৯৬৩, নেপাল ১৯২৬।
কালো আফ্রিকান দাসরা পুরোপুরি মানুষ নয় – অন্যান্য প্রাণীদের মতো তাদেরকে দিয়েও তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে খাটানো যায়! সেটাই হয়েছে। অবশ্য দাসরা একসময় শারিরীকভাবে মুক্ত হয়েছে সফল সামাজিক এবং সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যেম। অবশ্য এর কৃতিত্ব তারা এখনো সেভাবে পায় না! সময় এবং স্থানে দাসত্ব নানাভাবে এসেছে। প্রাচ্যের দাসত্ব (মূলতঃ গৃহদাস), পাশ্চাত্যের দাসত্বের (উৎপাদন দাস) মতোও নয়! দাসত্ব রূপ পাল্টায়, ব্যাপ্তি এবং কৌশল পাল্টায়- কিন্তু আধুনিক দাসরা সেটা বুঝতে পারে না!
দুটি ক্ষেত্র আধুনিক দাসত্ব হিসেবে চিহ্নিত: সরাসরি দাসত্ব ও দাসত্বরূপ কর্মকাণ্ড। দ্বিতীয়টিতে আছে ঋণে জর্জরিত করে শ্রম আদায়, জোরপূর্বক বিবাহ (নাবালক বিবাহসহ), নাবালকদের কেনাবেচা, মানবপাচার (শিশু-নারীসহ) ও জোরপূর্বক শ্রম আদায়। ১৬০টি দেশের ‘দাসত্ব সূচক’ – এ সবচেয়ে মন্দ অবস্থানে আছে পশ্চিম আফ্রিকার মৌরিতানিয়া, তার পরে হাইতি, পাকিস্তান, ভারত ও নেপাল। সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে আইসল্যান্ড, তার ঠিক ওপরে পাঁচটি দেশ হলো- আয়ারল্যান্ড, ব্রিটেন, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও সুইডেন। বাংলাদেশের অবস্থান মাঝামাঝি- ৭১-এ। বাংলাদেশের অবস্থা এই উপমহাদেশ ও অধিকাংশ অতীতের উপনিবেশ দেশগুলো থেকে তুলনামূলকভাবে উন্নত হলেও সংখ্যার দিক দিয়ে দাসত্ব বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশ দশটি মন্দ দেশের মধ্যে একটি। তথ্যটি আমাদের সবার জন্য গভীরভাবে ভাবনার বিষয়।
এই ‘দাসত্ব সূচকে’র উদ্দেশ্য অবশ্যই দাসত্ব উচ্ছেদ করা; কিন্তু সেটা সম্ভব হবে না, যত দিন ব্যক্তিগত লাভ ও লোভের অর্থনীতি প্রচলিত থাকবে।
বিশ্ব অর্থনীতির যে দিকটা সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়, সেটা হচ্ছে লাভের বিষয়। পরিষ্কারভাবে দেখা যায়, লাভের একটা বড় অংশ আসে কাঁচামাল, স্থাপনার খরচ, চলমান খরচ মিটিয়ে দিয়ে পণ্য যে মূল্যে বিক্রি হবে সেই উদ্বৃত্ত অংশ থেকে। একক বা শুধু পরিবারের সদস্য নিয়ে চালানো ক্ষুদ্র শিল্পের বা ব্যবসার ক্ষেত্রে পুরো উদ্বৃত্তটাই লাভ। বড় শিল্পে বা ব্যবসার বাইরের শ্রমের প্রয়োজন হয় ও ওই উদ্বৃত্তের বড় অংশটাই পকেটস্থ করে মালিকরা লাভ করতে পারেন। সবচেয়ে বেশি লাভ করা যায় যদি শ্রমিককে একেবারেই না দেওয়ার মতো করে শুধু গ্রাসাচ্ছাদন বা প্রাণধারণে সম্ভব তেমন সর্বনিম্ন বেতন দেওয়া হয়। এই বিষয়টি বিশ্বের অর্থনৈতিক ইতিহাসে নানাভাবে প্রতীয়মান। প্রথম জমানার এমনকি গ্রিক-রোমান সভ্যতা বা মেসোপটেমিয়ার সভ্যতায় ভিন্ন বর্ণের ও জাতির নর-নারীকে বলপূর্বক খাটিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ইউরোপে ও মধ্যপ্রাচ্যে মানুষ কেনাবেচার বাজার ছিল। উপনিবেশ বিস্তারের সময় দাসপ্রথা রমরমা হয়ে ওঠে। আফ্রিকা মহাদেশ থেকে অস্ত্রের জোরে বন্দি করে বা কখনো কখনো কিনে ইউরোপিয়ানরা দূর-দূরান্তের উপনিবেশে, বিশেষত আমেরিকা ভূখণ্ডে ও আশপাশের দ্বীপে (ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ) ‘প্ল্যান্টেশনে’ (আবাদের স্থানে) ‘ক্রীতদাস’ বা দাস নিযুক্ত করত। এই ক্রীতদাস প্রথা ১৮৩৪ সালে বিলুপ্ত হয়। (সবচেয়ে মজার কথা, দাসপ্রভুদের ক্ষতিপূরণের জন্য ব্রিটেন প্রায় ২০ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়েছিল, দাসরা কিছুই পায়নি, উল্টো দাসদের পরের চার বছর বিনা বেতনে তাদের আগের প্রভুদের খামারে কাজ করতে হয়েছিল।) দাসপ্রথা উঠে গেলেও বিনা বেতনে বা কোনোমতে গ্রাসাচ্ছাদন করার অর্থের বিনিময়ে শ্রমিকের প্রয়োজন মিটে যায়নি। ইনডেনচারড লেবার সিস্টেম (চুক্তিভিত্তিক শ্রমব্যবস্থা) চালু হলো দাসপ্রথা বিলুপ্তির পরপর। এই ব্যবস্থা প্রচলনে ঔপনিবেশিক শক্তি আফ্রিকার দিকে না গিয়ে ভারতবর্ষে আসে। জাতপ্রথার ফলে বৈষম্যে নিপীড়িত ও ব্রিটিশ কর্তৃক সেখানে ভূমি সংস্কারের ফলে হঠাৎ দরিদ্র হয়ে ওঠা জাতিগোষ্ঠী অনেক বড় ছিল। ব্রিটিশরা এদের ইনডেনচারড ব্যবস্থায় আগের প্ল্যান্টেশনে নিয়ে গেল। পরবর্তী পর্যায়ে বিংশ শতাব্দীতে, বিশেষত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরপরই ইউরোপে শ্রমিক ঘাটতি পূরণে অনুন্নত দেশ ও আগের উপনিবেশ দেশগুলোর দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে শ্রমিক আমদানি করা শুরু হয়। সরাসরি না হলেও উভয় পক্ষের নানাবিধ ফন্দিফিকিরে সেই অভিবাসন এখনো চলছে।
এখনো পৃথিবীর দেশে দেশে কমপক্ষে ২৭ মিলিয়ন মানুষ নানাভাবে প্রতারিত হয়ে দাসের জীবন যাপন করছে। নতুন এই দাসত্ব পুরনো ধাঁচের নয়। এই দাসত্ব সস্তায় বিকানো শ্রম, শ্রমিকের প্রতি অকিঞ্চিৎ যত্ন বা দায়বোধ ও সহজেই ছুড়ে ফেলা যায় এমন তাচ্ছিল্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অধিক জনসংখ্যার সুযোগে কম বা সীমাবদ্ধ কাজের অজুহাতে এই বঞ্চনাকে লালিত করা সম্ভব হচ্ছে। এ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশে দ্রুত পরিবর্তনশীল অর্থনীতির ঘনঘটাও শ্রমিক শোষণের বা বঞ্চনার কারণ হয়ে উঠছে। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, সামাজিক নীতি ভেঙে পড়া, আইনের শাসনের অভাব এগুলোর জন্যই শ্রম শোষণ সম্ভব হয়ে উঠছে এবং দাসত্বের রূপান্তর ঘটছে।
শক্তিশালী গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহারে, অর্থকে নিয়ামক শক্তিতে পরিণত করে যথেচ্ছভাবে এখনো গরিব-নিঃস্ব-দুস্থ মানুষদের ব্যবহার করছে কম বা বিনা পারিশ্রমিকে। ভীতি, প্রতারণা, প্রবঞ্চনার মাধ্যমে এখনো কলকারখানায় অদক্ষ শ্রমিকদের খাটানো হচ্ছে অর্ধবেতন বা নামমাত্র বেতনে। অর্থ আয় করতে করা হচ্ছে মানবপাচার। ২০১৪ সালে আইএলও ধারণা করছে, আধুনিক দাসত্বের ছদ্মাবরণে বেসরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনায় মালিকপক্ষ বছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ইউএস ডলারের ব্যবস্থা করছে। গৃহ শ্রমিক হিসেবে যারা কাজ করছে, তাদের বেতন, সামাজিক মর্যাদা বা জীবনযাপনের মানও দাসজীবনের কাছাকাছি। যৌনকর্মীদের জীবন এখনো সেই প্রারম্ভিক দাসপ্রথার কাছাকাছি রয়ে গেছে।
বর্তমান সময়ে গত চার দশক ধরেই অনেক পুঁজিসম্পন্ন দেশে সস্তায় শ্রমিক পাওয়ার ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এখন পুঁজিকেই শ্রমিকদের আদি দেশে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়েছে। নিজ দেশে শ্রমিকদের (সে ইমিগ্র্যান্ট হলেও) ন্যূনতম বেতন সে দেশের আইন অনুযায়ী দিতে গেলে লাভের পরিমাণ কমে যাবে। এ থেকে রেহাই পাওয়ার পন্থা হিসেবে পুঁজিকেই অনুন্নত দেশে পাঠিয়ে দিলে সেখান থেকে স্বল্প খরচে উৎপাদন করা সম্ভব, যেমন পোশাক তৈরি শিল্প, ড্যাটা প্রসেসিং, রুটিন কল আউটসোর্সিং ইত্যাদির কথা আমরা জানি। ইংরেজিতে একে বলে ‘ফ্লাইট অব দ্য ক্যাপিট্যাল ফ্রম সেন্টার টু পেরিফেরি’। অনেকে এটাতে দোষের কিছু দেখবেন না, বরং এসব দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এটা বর হিসেবে গণ্য করা হয়। সমস্যা হচ্ছে, এই পেরিফেরি দেশগুলোতে শ্রমিকের ভাগ্য আবার একই চক্রে পড়ে যায়। যে ব্যবসায়ীরা উন্নত দেশের হয়ে ব্যবসা করার সুযোগ পান, তাঁরা নিজ দেশের শ্রমিকদের যথাসম্ভব কম বেতন দিয়ে নিজেদের লাভ বৃদ্ধি করতে শুরু করেন। ফলে শ্রমিকরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে যায়।
দাসপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার কোনো নির্দিষ্ট বৈশ্বিক তারিখ নেই। একেক দেশে একেক দিন দাসপ্রথাকে বিলোপ করা হয়। প্রাচীন দক্ষিণ এশীয় পণ্ডিত কৌটিল্য দাসপ্রথা তুলে দিতে তার সম্রাটকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সম্ভবত এটাই দাসপ্রথা বিলোপের প্রথম উদ্যোগ। আর সর্বশেষ দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয় ১৯৬৩ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী ২ ডিসেম্বরকে পালন করা হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর দ্য এবলিউশন অব স্লেভারি’ হিসাবে। এদিন মূলত স্মরণ করা হয় সভ্যতা বিকাশে দাসদের অবদানের কথা, স্মরণ করা হয় গ্লানিময় এক প্রথার কথা। এখন সময় এসেছে সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রতিপালন করার। বুদ্ধিজীবী, চিন্তাশীল মানুষ, সমাজকর্মী, মিডিয়া, সবার সম্মিলিত প্রয়াসে সামাজিক অনাচার ও মানুষের প্রতি মানবিক আচরণের বৃহৎ পরিবেশ সৃষ্টি করে আধুনিক দাসত্বের বিলুপ্তি ঘটিয়ে একটি মননশীল পৃথিবী গড়ার। সময় এসেছে সামাজিক, অর্থনৈতিক ভেদাভেদের ‘বার্লিন ওয়াল’ ভেঙে একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ার, যেখানে চিরতরে বিলুপ্ত হবে দাসপ্রথার।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বেতন বকেয়া রেখে উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে চায়। এ নিয়ে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় দ্বন্দ্ব দেখা যায়। তাছাড়া আমাদের দেশে শ্রমিকদের একটি বড় অংশ নারী ও শিশু। এসব নারী ও শিশু বিভিন্ন কল-কারখানা, বিশেষ করে গার্মেন্টশিল্পে তারা বেশি কাজ করে থাকে। অথচ আমাদের সংবিধানে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। তথাপি বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনেকেই আবার জীবন ঝুঁকির মধ্যেও পড়ে যাচ্ছে। মারাও যাচ্ছে অনেক শ্রমিক।
বাংলাদেশের শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার কারণে তারা শারীরিক-মানসিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। শিক্ষাসহ বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা হচ্ছে বঞ্চিত। এসব শিশু স্নেহ-ভালোবাসার অভাবে এক সময় অপরাধ জগতে পা বাড়ায়। তাছাড়া প্রায় প্রতি বছর গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোয় বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এসব দুর্ঘটনায় অনেক নারী-পুরুষ-শিশু মারা যায়। দুর্ঘটনায় যেসব শ্রমিক মারা যায়, তাদের পরিবারের রুটি-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। তারা চোখেমুখে অন্ধকার দেখে।
আসলে আমরা শ্রম বা শ্রমিকের মর্যাদা বুঝেও বুঝতে চাই না। একজন মানুষের জীবনধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন, অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা_ এসবই একজন শ্রমিকের প্রাপ্য। আর এটাই হচ্ছে শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা। একুশ শতকে এসে শ্রমিকরা এর কতটুকু মর্যাদা বা অধিকার ভোগ করছে? বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থ নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। কারণ শ্রমিকরা এ দেশের সম্পদ। তাদের কারণেই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। এ কারণে তাদের অবহেলার চোখে দেখা ঠিক নয়। পাশাপাশি তাদের কাজের ও জীবনের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। মহান মে দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম, বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ, শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক রিসার্চ ইনস্টিটিউট’র প্রতিষ্ঠিতা ।
Discussion about this post