যে কৃতি পুরুষের জন্য ব্রাহ্মণবাড়ীয়া সমগ্র ভারত উপমহাদেশ এবং বিশ্বব্যাপী পরিচিতির সৌভাগ্য অর্জন করেছে তিনি হলেন তিতাস পাড়ের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ।বিশ্ব বরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জন্ম ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে নবীনগরের শিবপুর গ্রামে। তিনি প্রথম তালিম গ্রহণ করেন বড় ভাই সঙ্গীত সাধক ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁর কাছে। পরে বাংলার জনপদে ঘুরে ঘুরে তিনি খুঁজে পান লোক সুরের ভান্ডার। তিনি কলকাতার সঙ্গীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ওরফে নুনো গোপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। অমৃত লাল দত্ত ওরফে হাবু দত্তের কাছে তিনি বাশি, পিক্স, সেতার, মেন্ডোলীন, ব্যাঞ্জো প্রভৃতি যন্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের পরে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ মাইহারের রাজদরবারে সঙ্গীত গুরুর আসন লাভ করেন। বিশ্ববিখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের সঙ্গে তিনি বিশ্ব ভ্রমণে বের হন ১৯৩৫ সালে। এসময়ে তিনি ইংল্যান্ডের রাণী কর্তৃক সুর সম্রাট খেতাব প্রাপ্ত হন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৯৫২ সালে সঙ্গীত একাডেমী পুরস্কার, ১৯৫৮ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কার, ১৯৭১ সালে পদ্ম-বিভূষণ, ১৯৬১ সালে বিশ্ব ভারতী প্রবর্তিত দেশিকোত্তম খেতাব প্রাপ্ত হন। ১৯৭২ সালে ৬ নভেম্বর এই সঙ্গীত সাধক পরলোক গমন করেন।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ব্রাহ্মণবাড়ীয়া সদর থানার রামরাইলে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন । ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধীতার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত । আইন অমান্য আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি কারাবরণ করেন । তিনি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন । তিনি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজী ও উর্দুর সাথে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন । ১৯৫৪ সালে তিনি পুনরায় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন এবং পূর্ব পাকিস্তানে গঠিত মন্ত্রীসভার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হন । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৭ মার্চ রাতে তাঁকে কুমিল্লার বাসভবন থেকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যান এবং পরেরদিন তিনি পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন ।
বিখ্যাত ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ এর জন্ম ব্রাহ্মণবাড়ীয়া সদর উপজেলার গোকর্ণ ঘাট গ্রামে । তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাস লিখে তিনি অর্জন করেছেন বিশ্বখ্যাতি এবং ব্রাহ্মণবাড়ীয়াকে বসিয়েছেন গৌরবের উচ্চ আসনে। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে সাদা হাওয়া, সাগর তীর্থে, নাটকীয় কাহিনী, দলবেঁধে এবং রাঙ্গামাটি। ১৯৫১ সালে ১৬ এপ্রিল অদ্বৈত মল্লবর্মণ নারিকেলবাড়িয়ায় নিজ বাসভবনে পরলোক গমন করেন।
আকবর আলী খান ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন । তিনি একজন সিএসপি অফিসার হিসেবে হবিগঞ্জ এ ১৯৬৯ সালে এসডিও পদে যোগদান করেন । হবিগঞ্জে এসডিও হিসেবে কর্মরত থাকাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারী অস্ত্র সরবরাহ করে দেশাত্মবোধের সর্বোচ্চ প্রমাণ রাখেন । তিনি লিখিতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ ও খাদ্য সরবরাহের জন্য নোট প্রদান করে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন । তখন আকবর আলী খান সরকারী কোষাগার থেকে প্রায় তিন কোটি টাকা মুক্তিযুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য ট্রাকে করে আগরতলা পাঠিয়ে দিয়ে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন । মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে পড়তে যান। পরবর্তীতে পুনরায় তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন । তিনি মন্ত্রীপরিষদ সচিব পদ থেকে অবসর গ্রহণ করার পর বিশ্বব্যাংকে বিকল্প নির্বাহী পরিচালক হিসেবে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন ।
বিপ্লবী উল্লাস কর দত্ত ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ১৬ এপ্রিল কালিকচ্ছ বাঘবাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন । তিনি বিপ্লবী ক্ষুদিরাম এর নিকটাত্মীয় ছিলেন । তিনি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে জড়িয়ে পড়েন । ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল মোজাফফরপুরে ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা প্রচেষ্টার অন্যতম নায়ক ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর নেতৃত্বে উল্লাস করও ছিলেন । এ হত্যাকান্ডের মামলায় অভিযুক্ত হয়ে তিনি বীরেন্দ্রনাথ ঘোষের সঙ্গে দ্বীপান্তরিত হয়েছিলেন এবং ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি লাভ করেছিলেন । ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ১৭ মে তিনি পরলোক গমন করেন ।
আব্দুল কুদ্দুছ মাখন ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া শহরের পুনিয়াউট গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন । ৬ দফা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকাছিল উল্লেখযোগ্য । তিনি ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন । ১৯৭০ সালে তিনি ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন । ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের জন্য তিনি চার খলিফাদের অন্যতম হিসেবে খ্যাত হন । মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান বাংলাদেশের জনগণ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে । ১৯৭৩ সালে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নবীনগর থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন । ১৯৯৪ সালে ১০ ফেব্রয়ারী জাতীয় বীর আব্দুল কুদ্দুস মাখন মৃত্যুবরণ করেন ।
নওয়াব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে নাসিরনগর উপজেলার গোকর্ণ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন । তিনি ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে আইন বিষয়ে ডিগ্রী নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন । ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলা গভর্ণরের শাসন পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন । তিনি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় প্রথম বাঙালী প্রেসিডেন্ট ছিলেন । বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নওয়াব এবং ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কেসিআইই অর্থাৎ নাইট কমান্ডার অব ইন্ডিয়ান এমপেয়ার উপাধিতে ভূষিত করেন । ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন । ভারত খ্যাত এই রাজনীতিবিদ ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৭ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন ।
ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর জন্ম ২৬ এপ্রিল ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর প্রথম তালিম ঘটে তাঁর বড় ভাই আফতাব উদ্দিন খাঁর কাছে। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতনে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন । সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি গভর্ণর পদক, ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তামসা-ই-ইমতিয়াজ খেতাব, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রাইড অব পারফরমেন্স এবং ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে মরণোত্তর শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন । ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে এই মহান সঙ্গীত সাধক পরলোক গমন করেন ।
সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর তৃতীয় কন্যা ও বিশ্ব বিখ্যাত সঙ্গীত সাধক রবি শঙ্করের সহধর্মিনী রওশন আরা ওরফে অন্নপূর্ণা নিজ গুণে বিশ্বখ্যাত হয়েছিলেন। মহিয়সী সঙ্গীত শিল্পী অন্নপূর্ণা ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার সঙ্গীত তীর্থ শিবপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।
অন্নদাচরণ রায় (ছবি পাওয়া যায়নি)
অন্নদাচরণ রায়ের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে। ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন । তিনি ব্রাহ্মণবাড়ীয়া অন্নদা উচ্চ বিদ্যালয় ও সরাইল অন্নদা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন । তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলো জেলা তথা অত্র অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের অন্যতম।
ড. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ (ছবি পাওয়া যায়নি)
উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে ২৪ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়ীয়া সদর থানার বড়হরণ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মেধাতালিকায় স্থানসহ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন । ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্বর্ণপদক সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে দর্শনে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে এমএ পাস করেন । ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন । এই মহান শিক্ষাবিদ বার্ধক্যজনিত কারণে ১৯৭১ সালে ১২ সেপ্টেম্বর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
Discussion about this post